(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চারদিকে বরফ আর বরফ। দারুণ এক বরফোৎসব সবদিকে। সিমলায়ও প্রচুর বরফ ছিল, কিন্তু এত ছিল না। চেইলের বন জুড়ে যেন বরফের ছড়াছড়ি। আমাদের রিসোর্টের ঘরের দরোজার সামনে থেকে রাস্তা পর্যন্ত বরফে বরফে একাকার। সিঁড়িগুলোতেও চক চক করছে সাদা বরফ। দূর্বাঘাসের উপর বরফের ছাদর। বরফের পুরু আস্তর ভেদ করে হেথায় হোথায় উঁকি দিচ্ছে দু’চারটি করে ঘাস। যেন সাদা জমিনে সবুজের কারুকাজ! আবার ঘরের সামনেই নানা গাছ, ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের গাছের পাতায় পাতায়ও বরফের ছড়াছড়ি। গাছে গাছে থোকায় থোকায় বরফ। যেন গাছেও বরফ ফলে! কি যে অদ্ভুত মুগ্ধতা চারদিকে! সবদিকে!!
প্রচুর শীত। প্রচুর মানে, প্রচুর। কনকনে ঠাণ্ডা। ভয়াবহ এই শীতের মাঝেও আমাদের সহযাত্রী লায়ন নিশাত ইমরান এবং লায়ন রেহেনা চৌধুরী বরফ নিয়ে মেতে উঠলেন। সাত সকালের এই বরফোৎসব আমার স্ত্রীর ঠাণ্ডার অনুভূতিকে আরো উস্কে দিচ্ছিল। শীতের ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকা বেচারির বরফ নিয়ে ভয়টা বরাবরই একটু বেশি। এতে করে দূর থেকে বরফ দেখে মুগ্ধ হলেও মুঠো মুঠো বরফ উড়ানোর যেই আনন্দ তা থেকে সে বঞ্চিত। পতিভাগ্যে পত্নীর ভোগান্তি হয় জানতাম, কিন্তু পত্নীর কারণেও যে পতির সুখ আহ্লাদ জলাঞ্জলি দিতে হয় তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম। ইচ্ছে করলেও বরফ উড়ানোর সুখ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলাম আমি।
হঠাৎ মনে হলো আলোটা বাড়লো। সূর্যের মুখ থেকে মেঘ সরে গেলে যেমন হয়। আর সাথে সাথে ধারে কাছের সবকিছুই খলখল করে উঠলো। বরফের উপর উজ্জ্বলতা বাড়লো। পাহাড়গুলো হেসে উঠলো। পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচের দিকের বেশ কিছু অংশ চকচক করে উঠলো। সূর্যের আলোতে পাহাড়ের উপরিভাগ যেন কলকলিয়ে উঠলো। পাহাড়ের মাথায় যেন হিরের তাজ! পাহাড় চূড়ায় বরফের এমন মাখামাখি অন্যরকমের এক আবহ সৃষ্টি করলো । সুইজারল্যান্ড? জাপানের ফুজি মাউন্টেন? কার সাথে তুলনা করবো বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু অপরূপ এক নান্দনিকতায় মন প্রাণ ভরে উঠছিল।
বরফ এবং পাহাড় নিয়ে আমাদের মাতামাতির মাঝেই এক এক করে খুললো আমাদের পাশের বাড়ির দুইটি রুমের দরোজা। আমার এডিটর স্যার দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক এবং লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া রুম থেকে বের হয়ে আসলেন। চারদিকে বরফের এমন ছড়াছড়িতে দুজনই বেশ মুগ্ধ। আসলে পরিবেশ এমনই। সুন্দর একটি পরিবেশ সবাইকে মুগ্ধ করে। বয়সের উপর খুব বেশি কিছু নির্ভর করে না। আমার ম্যাডাম লায়ন কামরুন মালেক এবং লায়ন সুপ্রভা বড়ুয়া বৌদিও বের হয়ে আসলেন। একটি ঝকমকে সকাল আমাদের উল্লসিত করছিল।
আমরা নাস্তার জন্য তৈরি হলাম। রেস্টুরেন্টে গিয়েই নাস্তা করতে হবে। এখানেও নাস্তার ফ্রি আয়োজন। রুম ভাড়ার সাথেই নাস্তার টাকা আদায় করা হয়, কিন্তু বলা হয় ‘কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট’। ব্যবসার নানা ধরন। কত রকমের ব্যবসা যে দুনিয়াতে রয়েছে! আমরা রেস্টুরেন্টে গেলাম। ব্যুফে ব্রেকফাস্ট। সাত হাজার ফুটেরও বেশি উচ্চতার পাহাড় চূড়ার গহীন অরণ্যে যেখানে ‘দানা-পানি’ পাওয়াটাই কঠিন, সেখানে থরে থরে সাজানো এত খাদ্য! ধারণার চেয়ে বেশি আয়োজন নাস্তার। আমরা রয়ে সয়ে নানা কিছু খেলাম। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে মনে হলো পৃথিবীকে সবার বাসযোগ্য করতে কত মানুষকে কত ঘামই না ঝরাতে হয়।
আমাদের গাড়ির চালক ফোন করে বললেন তিনি এসে গেছেন এবং তাড়াতাড়ি না করলে সময়মতো পৌঁছানো কঠিন হবে। আমি ড্রাইভারের কথাটি আসরে বলতেই আমার এডিটর স্যার বলে উঠলেন, বেড়াতে এসেছি। এত সময়ের হিসেব করে লাভ কি! একসময় পৌঁছলেই হলো। হুড়োহুড়ি করে বেড়ানো হয় না। অন্যরা সকলেই আমার স্যারের কথাই সায় দিলেন। বিশেষ করে মহিলারা। আমরা রয়ে সয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডের কফির কাপে চুমুক দিতে শুরু করলাম। রেস্টুরেন্টে আমরা ছাড়াও আরো কয়েকজন লোক ছিল। নারী পুরুষ। কোনার দুইটি টেবিল দখল করে তারা নাস্তা করছেন। সকলেই পশ্চিমা। ইউরোপীয়ান। বরফের দেশের মানুষ কেন যে এখানে এসেছেন তা আমার মাথায় ঢুকলো না। তবে তাদেরকে বেশ উচ্ছ্বসিত মনে হচ্ছিল। ভারতীয় পর্যটনকে টিকিয়ে রাখার পেছনে পশ্চিমা বিশ্বের বড় ভূমিকা রয়েছে। ভারতের এক তাজমহল দেখতেই প্রতিদিন যে পরিমাণ ইউরোপীয়ান কিংবা আমেরিকান ট্যুরিস্ট আসেন আমাদের দেশে পুরো বছরেও তা আসেন না। ভারতের নানা অঞ্চলে ঘুরেটুরে তারা আবার ফিরতি পথ ধরেন, আমাদের এখানে আসেন না। আমার মনে হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় সি বিচ কঙবাজার কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ আমাদের পর্যটন সম্পদগুলো যথাযথভাবে উপস্থাপন করা গেলে ভারত সফরে আসা ট্যুরিস্টদের একটি অংশকে অনায়াসে এদেশে আনা যেতো! কিন্তু বিশেষ কিছু কারণে বিশ্বব্যাপী আমাদের দেশটি ঝড় জলোচ্ছ্বাস এবং বন্যায় কবলিত একটি দেশ হিসেবে পরিচিত। অভুক্ত এবং অভাবী মানুষদের কাফেলা সারাক্ষণই ঘুরঘুর করে আমাদের পথে ঘাটে, হাটে মাঠে। নানা প্রচারে অপপ্রচারে আমাদের অভাগা দেশটির পর্যটন ইমেজ একেবারে তলানিতে। আমাদের দূতাবাসগুলো পর্যটনের বাজার সৃষ্টিতে নানাভাবে কাজ করতে পারলেও কেন যে তা হচ্ছে না। আর এই ‘না হওয়ার’ খেসারতই আমাদের দিতে হচ্ছে।
চেইল ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করছিল না। গহীন অরণ্যের ভয়ংকর নান্দনিকতায় রাত কাটানোর মজাটা অনুভব করার আগেই ফিরে যাওয়ার তাড়া শুরু হলো। প্রথম দিনতো ভয়ে ভয়ে ছিলাম, ভয় জয় করে উপভোগ করার সময়ই ফিরতে হচ্ছে। মনে হচ্ছিল এখানে আরো দু’চারদিন থাকতে পারলেই ভালো হতো, মজা হতো। রুমে ফিরে ব্যাগ গোছাতে খুব বেশি সময় লাগলো না। রিসিপশনে ফোন করে আমাদের ব্যাগগুলো নেয়ার ব্যবস্থা করার অনুরোধ করলাম। ব্যাগ রুমের সামনে রেখে আমরা রিসিপশনে চলে আসলাম। চাবি বুঝিয়ে দিলাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমাদের ব্যাগ গাড়িতে বোঝাই করা হলো। আগের মতো সবই ট্রাভেলার্সের পেটে ঢুকে গেল। রিসোর্টের লোকজন এবং ড্রাইভার মিলে কাজটি করে ফেললেন। আমাদের হাতই লাগাতে হলো না। আমাদের গাড়ি স্টার্ট করার ঠিক আগ মুহূর্তে এক ভদ্রলোক আসলেন। চমৎকার স্যুট পরিহিত। গায়ের রঙ কিছুটা বাড়তি রকমের কালো, কিন্তু বেশ স্মার্ট। ভদ্রলোক দুহাত জোড় করে মুদী কায়দায় এগিয়ে এলেন এবং নিজের পরিচয় দিলেন। বিজনেস কার্ডও দিলেন। বললেন, তিনি রিসোর্টের ম্যানেজার। অনেক কষ্ট করে রাত কাটিয়েছি। তিনি শুনেছেন যে আমরা ঠাণ্ডায় কষ্ট পেয়েছি। বিষয়টির জন্য তিনি বেশ দুঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন, তাদের আরো সতর্ক থাকা উচিত ছিল। তবে ভবিষ্যতে কখনো এলে যাতে কোন কষ্ট না হয় সেদিকে তিনি সজাগ থাকবেন। তিনি আমাদেরকে অনেক ধন্যবাদ জানালেন। তাদের রিসোর্ট পছন্দ করায় কৃতজ্ঞতাও জানালেন। ভদ্রলোক যতক্ষণ কথা বলছিলেন ততক্ষণই তার মুখে লেগে ছিল হাসি। মুগ্ধ হচ্ছিলাম নিচু স্বরের কথাগুলো শুনে। তিনি এই রিসোর্টের মালিক নন, কর্মকর্তা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটিকে তিনি নিজের মতো করে যেভাবে ভালোবেসে কাস্টমার হ্যান্ডলিং করছিলেন তাতে মুগ্ধ হলাম আমি। এই ধরনের কর্মকর্তা বা কর্মচারী যাদের থাকে সেসব প্রতিষ্ঠানই ব্যবসা সফল হয়। জীবনে আর কখনো চেইল আসবো কিনা জানি না, তবে আসলে আমি বারবারই এই রিসোর্টে আসবো। বারে বারেই আসবো। ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানিয়ে যাত্রা করলাম আমরা।
আমাদের নতুন গন্তব্য চন্ডিগড়। চেইল থেকে ১০৫ কিলোমিটার দূরত্ব চন্ডিগড়ের। এই পথের একটি বড় অংশ পাহাড়ি রাস্তা। সিমলা থেকে চেইল আসার সময় যেমন পাহাড়ি সব ভয়ংকর রাস্তা পার হয়ে এসেছিলাম এখন আবার তেমনি সব রাস্তা পার হয়ে চন্ডিগড় মহাসড়কের নাগাল পাবো। তবে আমরা আর সিমলা যাবো না। অন্যপথ ধরে এগুতে থাকবো।
আমাদের গাড়ি ছুটছিল। আবারো সেই পাহাড়ি রাস্তা। আবারো ভয়ংকর সব পথ। পথের দুই ধারে গহীন অরণ্য, খাড়া পাহাড়। বন-বনানীর ভিতর দিয়ে এগুচ্ছিলাম আমরা। পথে পথে বানর হনুমান খেলা করছিল। গাছে গাছে পাখি। কত ধরনের পাখির উড়াউড়ি যে চোখে পড়তে লাগলো! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।