(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পাহাড় থেকে পাহাড়ে ঘুরছিলাম। ঘুরছিলাম বন থেকে বনানীতে। অবশ্য গাড়িতে। বিশাল গাড়িতে আমরা যাত্রী মাত্র দুজন। দলের বাকি সবাই রিসোর্টে, শুধু আমরা স্বামী স্ত্রী দুজন শুধু ঘুরতে বের হয়েছি। ভিনদেশী ড্রাইভার। ভিন্নভাষী। কথাবার্তাও তেমন একটি হচ্ছিল না। আমার স্ত্রীকে কিছুটা ভীত সন্ত্রস্ত বলেও মনে হচ্ছিল। তাকে অভয় দিলাম। নামে ভার্জিন ফরেস্ট হলেও এই বনে বাঘ ভাল্লুক নেই বলেও তাকে আশ্বস্ত করলাম। তবে হেথায় হোথায় ছোটাছুটি করছিল বানর, হনুমান। গাছে গাছে পাখীর কলকাকলী। ডানা ঝাপ্টানোর ভয়ার্ত চিৎকার! আমরা নিজেদের মতো করে গল্প করছিলাম। মুগ্ধতায় ভরপুর আমাদের অন্তর। বুক জুড়ে ভিন্নমাত্রার অনুভূতি। ভার্জিন ফরেস্ট এমন মোহনীয় হয়! পাহাড়ও এমন মুগ্ধতা ছড়ায়! বন জঙ্গলের ভিতর চলতেও বুঝি এমন ভালো লাগে!
বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। উঁকি দিতে শুরু করেছে সন্ধ্যা। দলের অন্যান্য সদস্যদের সাথে কোন যোগাযোগও নেই। খোঁজখবরও নেয়া হয়নি অনেকক্ষণ। তাই রিসোর্টে ফেরার তাড়া অনুভব করছিলাম ভিতরে। ড্রাইভারের অবস্থাও মনে হলো ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’। আমাদের পুরো টিম থাকলে না হয় একটি কথা ছিল, এখন শুধু দুজনকে ঘুরাতে তিনিও মনে হয় ঘোরার আনন্দ পাচ্ছিলেন না। তাই আমাদের নামিয়ে দিতে পারলেই তিনি আজকের মতো বেঁচে যান। শীতে কাবু পাহাড়ের নানা ঘরে নাকি জমজমাট হয়ে উঠে মদের আসর। আমাদের ড্রাইভার ওগুলোর কোন একটিতে নিজেকে উজাড় করে দেন কিনা কে জানে! অবশ্য, বোতল টোতল তার গাড়িতেও থাকতে পারে। দক্ষিণ ভারতীয় কুচকুচে কালো বর্ণের ড্রাইভারের ভীষণ লাল চোখই জানান দিচ্ছিল, মদে উনার আসক্তি না থাকলেও আপত্তি থাকে না।
ফিরে আসলাম আমরা। রিসোর্টে। রিসিপশনের সামনে আমাদের স্বামী স্ত্রীকে নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভার ইউ টার্ণ নিলেন। রিসিপশনের সেই ভদ্রলোক আমাদের দেখলেন। হাসলেন, হাতও নাড়লেন। আমিও।
রুমে ফিরে আসলাম। দারুণ মুগ্ধতা ছড়ানো চারদিকে। সন্ধ্যা নামার আগে পৃথিবী এত সুন্দর হয়! লালসে আভা খেলা করছে পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায়। কি যে, অপরূপ। বরফে ঢেকে থাকা হিমাচল প্রদেশের পাহাড়ের চূড়াগুলো কি মুগ্ধতা যে ছড়াচ্ছিল। আমাদের রুমের পাশেই ছোট্ট গলফ কোর্সের মতো একটি মাঠ। একেবারে ছোট। কয়েক শতক হতে পারে। তাতে সিমেন্ট দিয়ে তৈরি লম্বা একটি বেঞ্চ বসানো হয়েছে। টিলার উপর বসে পাহাড় দেখার ব্যবস্থা। দারুণ এক আয়োজন। আমি বেঞ্চে বসে পড়লাম। হাত বাড়ালাম স্ত্রীর দিকে। কপট রাগে রাগান্বিত স্ত্রী রুমেই ঢুকে পড়লো। আমি বসে থাকলাম বেঞ্চে। হাতওয়ালা বেঞ্চ। হেলান দেয়ার দারুণ ব্যবস্থা। শীত শীত আবহ। কিছুটা বাড়ছে বলেও মনে হলো। আমি বেশ জড়োসড়ো হয়ে বসে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে।
অল্পক্ষণ পরই ফিরে আসলো ঘরণী। দুহাতেই ধুমায়িত কফি। একটি মগ আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো, ‘খাও, ভালো লাগবে।’ শীতের পড়ন্ত বিকেলে খোলা মাঠে বসে ধুমায়িত কফিতে চুমুক দেয়ার আনন্দ অন্যরকম। আমার মুগ্ধতা কেবলই ডালপালা বিস্তার করছিল। কি যে ভালোলাগা চারদিকে। আমাদের রুমেই কফি মেকার থেকে শুরু করে সবই দিয়ে দেয়া হয়েছে। এসবের জন্য বাড়তি কোন বিল পরিশোধ করতে হবে না। না খেলেও বিল কম নেবে না। শুধু নিজে বানিয়ে খেতে হয়। এখন অবশ্য আমার সেই কষ্ট নেই। স্ত্রী বেশ সুন্দর করে বানিয়ে এনে হাতে তুলে দিয়েছে।
কতদিন এভাবে বসে আমরা গল্প করিনি। কতদিন এত নিশ্চিন্তে সময়ও কাটাইনি। এক কাপ কফি এত তৃপ্তি দিতে পারে! শীতের তীব্রতা টের পাচ্ছিলাম ধীরে ধীরে। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই বাড়ছিল শীত। আমরা রুমে ঢুকে গেলাম। সন্ধ্যার আগে শীতের এমন তীব্রতা, রাতে কী হবে কে জানে!
আমার এডিটর স্যার দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক এবং ম্যাডাম কামরুন মালেক কি করছেন খবর নেয়া দরকার। ইন্টরকমে ফোন করলাম। স্যার ধরলেন। বললেন, রুমেই আছেন। এখন আর বের হবেন না। আমাদের গল্প করার জন্য রুমেই যেতে বললেন। ফোন করলাম লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়ার রুমেও। তিনি এবং সুপ্রভা বড়ুয়া বৌদি টিভি দেখছেন বলে জানালেন। এডিটর স্যারের রুমে আসার জন্য বললাম উনাদের। লায়ন নিশাত ইমরান এবং লায়ন গুলশান আখতার চৌধুরী রেহেনাকেও একই কথা বললাম। জমে উঠবে আড্ডা। ভ্রমণকালে এই ধরনের আড্ডা আমাকে মুগ্ধ করে। ভীষণ উপভোগ করি।
স্যারের রুমে গেলাম। একই ধরনের রুম। বসার ব্যবস্থাও একই। আমরা কেউ সোফায়, কেউ ডিভাইনে, আবার কেউবা একেবারে বিছানায় উঠে বসলাম। শুরু হলো গল্প। ক্রমে বাড়ছিল গল্পের ঢালপালা। এমন বনবাঁদাড়ে শীতের রাত কত তীব্র হয় তা নিয়ে গল্প হচ্ছিল। শীত আরো জেঁকে বসবে বলেও আশংকা করা হচ্ছিল। ভুটানের বনের ভিতরে এমন শীতার্ত এক রাতের কথা মনে পড়লো আমার। মনে পড়লো এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। শীত যে কত তীব্র হতে পারে তা মনে পড়তেই অন্তর যেন কেঁপে উঠলো। স্যার আশ্বস্ত করলেন যে, এখানে ভুটানের মতো হবে না। ভুটান এখান থেকে অনেক উত্তরে। হিমালয়ের একেবারে পাশে। অনেকটা বুকের ভিতরে। এতে করে ওখানে শীতের তীব্রতা এখানের চেয়ে অনেক বেশি হবে। ভূগোলের উপর প্রচুর লেখাপড়া আমার এডিটর স্যারের। কোন দেশ কোথায় তা জানতে ম্যাপে চোখ বুলাতে হয় না। শুধু নাম বললেই বলে দিতে পারেন। বলতে পারেন ওসব দেশের অনেক কিছু। ভুটানের শীত নিয়ে স্যারের অভিজ্ঞতা কেমন আমি জানি না, তবে আমার ভয়াল অভিজ্ঞতা কোনদিনই ভুলবো না। রাতও এমন বিবর্ণ হয়! হিটার লাগানো বিছানায় শুয়েও পুরো রাত কুণ্ডুলী পাকিয়ে ছিল আমার ঘরণী। অবশ্য, ইউরোপ আমেরিকাসহ বহু দেশে ঘুরেছি। কিন্তু বিছানায় হিটার লাগানো কোন তোষক আগে কোনদিন দেখিনি। ভুটানের তোষকে হিটার লাগানো ছিল। তবুও শীতে ঘুমাতে পারি নি।
যাক, জমে উঠেছে আমাদের আড্ডা। গল্প। শীতের তীব্রতাও বাড়ছিল। রুমের ভিতরেও আমাদের হাত পা কেমন যে অবশ করে ছাড়তে শুরু করলো শীত। রাত নামার সাথে সাথে যে আকাশ থেকে শীতও নামে সেই অভিজ্ঞতা আমার জন্য নতুন নয়। তবুও কিছুটা আশা ছিল হয়তো শীত ভুটানের চেয়ে কম হবে। কিন্তু হিমালয় থেকে দূরে হলেও শীত থেকে যে দূরে নয় তা বুঝতে বেশিক্ষণ সময় লাগলো না। জেঁকে বসতে শুরু করেছে শীত। রুমের ভিতরেও বুঝি দাঁতে দাঁত লেগে যাবে।
আমার ম্যাডাম লায়ন কামরুন মালেক বললেন, এমন শীতে আমি আর বের হবো না। তোমরা খেয়ে আসার সময় আমার জন্য হালকা কিছু নিয়ে আসিও। আমরা রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য বের হলাম। দরোজা খুলতেই কে যেন মুঠো মুঠো শীত আমাদের নাকে মুখে ছড়াতে লাগলো।
কিন্তু দরোজা থেকে একটু এগুতেই আমার অন্তর নেচে উঠলো। নেচে উঠলো বলতে, সত্যি সত্যিই নেচে উঠলো। আমি হাত বাড়িয়ে আমার স্ত্রীর হাতটি মুঠোয় নিয়ে নিলাম। এমন সুন্দরও চারপাশ হয়। এমন সুন্দর হয়! মন ভরিয়ে দেয়ার মতো সুন্দর। আকাশজুড়ে বিরাট এক চাঁদ। উদোম থালার মতো নিজেকে মেলে ধরেছে। তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। বিশাল চাঁদ। বিশাল মানে, বিশাল। ঝলসানো লোহার মতো রঙ। শীতের রাত হলেও কুয়াশা যেন উবে গেছে। পরিষ্কার আকাশে উদোম চাঁদ। মনে হচ্ছিল কলকল করছে। চারপাশ হাসছে। আমাদের বরণ করার হাসি। চাঁদের হাসি বাঁধ ভাঙার কথা শুনেছি, কিন্তু বনে বনে যে সেই হাসি এমন সুন্দর হয় তা আমার জানা ছিল না। ভুটানের বনের গল্প করলাম, শীতের গল্প করলাম। কিন্তু সেদিন আকাশে এমন চাঁদ ছিল না। এমন চাঁদের গল্প থাকলে বুঝি অন্য কষ্টগুলো আর কষ্ট থাকে না। ভরা জ্যোৎন্সায় আমার কেবলই রবি ঠাকুরের কথা মনে পড়ছিল। ‘আজ জ্যোৎন্সা রাতে সবাই গেছে বনে’ নাকি ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে’- কোন গানটি গুনগুন করলে বা শুনলে মন ভরবে বুঝতে পারছিলাম না। আমি কেবলই চাঁদ দেখছিলাম। আকাশ দেখছিলাম। জ্যোৎন্সার জোয়ার দেখছিলাম। সেই জোয়ারে ভেসে বেড়ানো অদূরের পাহাড় দেখছিলাম। দেখছিলাম চারপাশের নানা কিছু। অন্তর জুড়ে থাকা মুগ্ধতায় আমি যেন কেবলই হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।