ওদের দাপট ও তৎপরতা যুগে যুগে

রেজাউল করিম স্বপন | বুধবার , ৭ অক্টোবর, ২০২০ at ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ

এরশাদের আমলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আন্দোলনের আলটিমেটাম দিলেন। তখনকার খাদ্যমন্ত্রী খাদ্যবিভাগের কর্মচারী ইউনিয়নের মহাসচিবসহ তিনজনকে তাঁর অফিসে ডাকলেন। কর্মচারীরা মন্ত্রীর অফিসে যাওয়ার পর মন্ত্রী কর্মচারী নেতাদের গেটআপ দেখে আশ্চর্য হলেন। আলোচনা করে আশার পর মন্ত্রী নেতাদের মধ্যে বিশেষ করে মহাসচিবের ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়া শুরু করলেন। খোঁজ নিয়ে দেখলেন, মহাসচিবের কাছে বাড়তি কোন টাকা পয়সা নেই এবং বেতনের বাইরে কোন আয় নেই। অতি কষ্টে পরিবার নিয়ে সরকারি কোয়ার্টারে থাকেন। অফিস সময়ের পর খাদ্য বিভাগের লোকজনের বিভিন্ন কাজ ও যুক্তিসংগত তদবির নিয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকেন। বিভাগের কর্মচারীরা কিভাবে একটু ভাল থাকতে পারে, সব সময় সেই চেষ্টা করতেন। গরীব ও দুস্থ সহকর্মীদের সাধ্যমত সহযোগিতা করতেন। কেউ কোন বিপদ বা অসুখে পড়লে তার জন্য কিছু করতে চাইতেন। কোনদিন হয়ত কোন গরীব কলিগের সাথে হাসপাতালে বসে রাত পার করে দিতেন। কখনোই নিজের ধান্ধার জন্য কিছু করেন নি। তাঁর সেই সততা ও ত্যাগের জন্য এতো বছর পরেও মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গভর্নর হিসাবে চাকরির মেয়াদ শেষের আগের দিন ব্যাংকের কর্মচারী ইউনিয়নের নেতারা তাঁর রুমে গিয়ে তাঁকে অপদস্থ করলো, কারণ তিনি গভর্নর থাকা অবস্থায় ওদের অন্যায় আবদার শুনেন নি। ভাবতে পারেন, একজন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের গভর্নর যার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও মেধা ঈর্ষা করার মত। যিনি ষোল কোটি মানুষের মধ্যে অন্যতম জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব। তাঁকে অপদস্থ করে অস্টম শ্রেণী পাস কর্মচারীরা। যারা তাঁর সামনে চেয়ারে বসার যোগ্য নয়।
প্রায় বছর দশেক আগে আমার এক বন্ধুসহ শাহবাগ শিশুপার্কে গিয়েছিলাম। সেখানে হঠাৎ এক পূর্ব পরিচিত লোকের সাথে দেখা। তিনি শাহবাগে একটি সরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। কথা প্রসঙ্গে জানলাম তাঁর শ্বশুর যে ব্যাংকে চাকরি করেন, তিনি সেই ব্যাংকের সিবিএর সাধারণ সম্পাদক। কথা প্রসঙ্গে আরো জানলাম, তাঁর শ্বশুরসহ আত্মীয় স্বজনের মধ্যে মোট একুশ জনকে ঐ ব্যাংকে চাকরি দিয়েছেন। চিন্তা করুন, এভাবে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে সিবিএ নেতারা চাকরি দিতে পারেন।
বছর তিনেক আগে আমরা বন্ধুরা মিলে সিলেট যাব। ট্রেনের একবগির পুরো টিকিট দরকার। সিআরবি অফিসে গিয়ে টিকিটের জন্য ধর্না দিলাম, পেয়েও গেলাম। সেখানে জানতে পারলাম, ট্রেনের টিকেট বাণিজ্যের সঙ্গে রেলের শ্রমিক নেতারা জড়িত। প্রতিটা টিকিটে ওরা একশত টাকা করে পায়।
কয়েকদিন আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজির ড্রাইভার যিনি ওখানকার ড্রাইভার সমিতির সভাপতি তাকে আটক করা হয়। যিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রায় ত্রিশ জনকে চাকরি দিয়েছেন এবং সবাই তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, তার সম্পদের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার উপর। ভাবতে পারেন, একজন সাধারণ অষ্টম শ্রেণী পাস ড্রাইভারের সম্পদ ১০০ কোটি টাকার বেশি। আচ্ছা বলতে পারেন, সেই ড্রাইভার কি এতো বিপুল টাকা একদিনে আয় করেছেন? অবশ্যই না। কেউ কি আগে তার এই সম্পদের কথা জানতো না? অবশ্যই জানতো। তাহলে কিভাবে এতো দিন সে নির্বিঘ্নে এভাবে টাকা আয় করতে পারলো? কিভাবে এতোজনকে চাকরি দিতে পারলো?
এ রকম বিত্তশালী ও প্রভাবশালী সিবিএ নেতা বা কর্মচারী সমিতির সভাপতি আমাদের দেশে আরো রয়েছে। বিশেষ করে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ব্যাংক, বীমা, ওয়াসা, বিটিটিবি, ওয়াপদা, গ্যাসকোম্পানী, বন্দর, বিটিএমসি, বিজিএমসিসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। যারা ঠিকমতো অফিস করেন না। সারাক্ষণ দেনদরবার ও তদবির নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। নামে বেনামে বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকেন। বিলাস বহুল জীবন যাপন করেন। প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তার মত দামী গাড়ি ব্যবহার করেন।এসব নেতারা আবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংগঠন ও শ্রমিক সংগঠণের সঙ্গে জড়িত। নিয়মিত বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে উঠাবসা করেন। ফলে সবকিছু জানার পরেও কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না।
যে কোন অফিসে নতুন কোন কর্মকর্তা বদলি হয়ে আসলে তিনি প্রথমে ঐ অফিসের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী বা তাঁর জন্য নিযুক্ত পিয়ন বা ড্রাইভারের কাছে ঐ অফিসের ভাল মন্দ খবরাখবর নেন। এ সুযোগে ঐসকল কর্মচারীরা অফিসারের উপর একধরনের প্রভাব বিস্তার করেন এবং অফিসারেরা ঐ সকল কর্মচারী বা পিয়ন বা ড্রাইভারের মাধ্যমে ঘুষ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সেজন্য তাঁরা ঐ কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। ফলে তারা এক সময় বিষফোঁড়া হয়ে ওঠে।
এখনো আমাদের দেশে বিভিন্ন অফিসে কর্মচারীরা যে ভাবে ফাইল রেডি করে দেন, অফিসারেরা সেভাবেই শুধু সিগনেচার করেন। দুকলম লেখার দরকার হলে কোন মতামত না দিয়ে ফাইল আবার নিচের দিকে পাঠিয়ে দেন। অথচ অফিসারেরা হচ্ছেন ঐ অফিসের সবচেয়ে মেধাসম্পন্ন কর্মকর্তা। কিন্তু তাঁরা কিছু লিখেন না। অনেক সময় অসৎ উদ্দেশ্যে ‘আলোচনা দরকার’ লিখে ফাইল নিচে পাঠিয়ে দেন। এ ধরনের প্রবণতায় কর্মচারীদের দাপট আরো বাড়ে। তারা এ সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।
বাংলাদেশের মাঠ পর্যায়ের প্রায় সব অফিসে বাইরের লোক (একেক অফিসে একেক নাম) কাজ করে। বাইরের লোক হওয়াতে এই লোকগুলোর কোন জবাবদিহিতা নেই। ওরাই অফিসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস (নথি) সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকে। কোন কোন অফিসের এই বাইরের মানুষগুলো বাড়ি গাড়িসহ প্রচুর টাকার মালিক। কারণ গুরুত্বপূর্ণ সব নথি ওদের নখদর্পণে। অনেক সময় টাকার বিনিময়ে তারা ঐসব নথি পাচার করে। এসব অফিসে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা সবসময় বিভিন্ন গ্রুপিং তদবির দলাদলি ও আরাম আয়েশে সময় পার করেন।এভাবেই যুগ যুগ ধরে চলছে আমাদের সরকারি দপ্তরগুলোর কাজকর্ম। যা হয়ত ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারীর নিরাপত্তা কোথায়?
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে