(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হংকংয়ের মেট্রো স্টেশনে চক্কর মারছিলাম। মানুষে মানুষে গিজগিজ করলেও কোন বিশৃংখলা নেই। কানে লাগার মতো শব্দ দূষণেরও কোন আলামত নেই চারদিকে। সব যেনো ছিমছাম, গুছানো। স্টেশনটি বেশ লম্বাটে, ফ্লোরজুড়ে টাইলস বসানো। চকচক করছিল। শত শত মানুষের আনাগোনার মাঝেও ফ্লোরের কোথাও যেনো একটি বালিও নেই। এত বড় একটি স্টেশনকে কী করে এমন তকতকে রাখা সম্ভব কে জানে!
আগেই বলেছি যে, যে যার মতো করে গন্তব্যে যাচ্ছেন। এক একটি ট্রেন আসছে, বহু লোক উঠে পড়ছেন। আবার প্রতিটি ট্রেন থেকে নতুন লোক নেমে সামনের দিকে ছুটছেন। আবালবৃদ্ধবনিতার এক মহামিলন যেনো স্টেশনটিতে। চোখে পড়ার বিষয় হলো, অসম্ভব রকমের পরিচ্ছন্নতা। কোথাও একটি টিস্যুও পড়ে থাকতে দেখা গেলো না। কফির খালি মগ বা পানির বোতল তো দূরের কথা। আমার হাতে খালি মগ, স্টেশনে ঢোকার সময় যে কফিটি আমার বন্ধু স্বপন নিয়ে দিয়েছিল চুকচুক করে সেটি আমি শেষ করেছি। এখন খালি মগটি আর ফেলতে পারছিলাম না। মগটি ফেলার জন্য বিন খুঁজছিলাম। হাতের কাছে একটি পিলারের পাশে সুদৃশ্য একটি বিনও পেয়ে গেলাম। বিনটির অভিনবত্বে চমকিত আমি। হাসছেন? হাসারই কথা। বিনের আবার অভিনবত্ব কি? আছেই বলেই তো হংকংয়ের মেট্রো স্টেশনের একটি বিন এই কলামে উল্লেখ করার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছি। বিনটি বর্গাকারের। উচ্চতা একেবারে কম। আমার মনে হলো, যাতে ছোট্ট শিশুও অনায়াসে বিনে ময়লা ফেলতে পারে সেজন্য এটির উচ্চতা বড়দের বুক সমান করা হয়নি। বর্গাকৃতির বিনটির ভিতরে একটি কালো পলিথিন দেয়া। যেটিকে বিনের সাথে সেঁটে দেয়া। ময়লা পুরে গেলে পলিথিনটি তুলে নেয় কর্মীরা। নতুন পলিথিন দেয়, আবারো ময়লা জমলে সরিয়ে নেয়। আমার হাতে থাকা কফির মগটি বিনে চালান করে দিয়ে বেশ স্বস্তি পেলাম। আমার মনে হলো, বিনটির দাম খুব বেশি নয়। নিশ্চয় আমাদের দেশেও অনায়াসে এই বিন ব্যবহার করা সম্ভব। আমাদের বহু জায়গায় এমন আকৃতির না হলেও নানা ধরনের বিনের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে দেশে হলে কী মগটি আমি বিনে ফেলতাম, নাকি ছুঁড়ে মারতাম? নিজেকে প্রশ্ন করে উত্তর পেয়ে নিজেরই যেনো লজ্জা লাগছিল। জাতি হিসেবে আমাদের অবস্থা এবং অবস্থান যে কোন পর্যায়ে তা বেশ বুঝতে পারছিলাম।
স্টেশনে দোকানপাট রয়েছে। রয়েছে খাওয়া দাওয়ার দারুণ সব ব্যবস্থা। দোকানগুলোতে বিকিকিনি চলছে, খাওয়া দাওয়ার দোকানগুলোতেও ভিড় দেখা গেলো। ট্রেনের সময়সূচি ডিজিটাল স্কিনে দেখানো হচ্ছিল। কোন ট্রেন কোথায় যাবে তাও সম্ভবত প্রদর্শিত হচ্ছিল। তবে ভাষাগত সমস্যার কারণে আমার পক্ষে কোন কিছুরই পাঠ উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছিল না।
স্বপন প্রশ্ন ছুড়ে দিল, আরো ঘুরবি? আমি মাথা নাড়লাম। না, এবার চল। এক মিনিটেরও কম সময়ে একটি ট্রেন এসে দাঁড়ালো। একেবারে নিঃশব্দে যেনো কানের পাশে এসে থামলো ট্রেনটি। একটির পর একটি ট্রেন আসা যাওয়া করলেও ট্রেনের কান ঝালাপালা করে দেয়া কোন শব্দ ছিল না। যাত্রীদের মতো ট্রেনগুলোও যেনো একেবারে চুপচাপ, অথবা ট্রেনের মতো যাত্রীর। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। অনাহুত বাক্য বা শব্দবানে কাউকে জর্জরিত করার ইচ্ছে যেনো ট্রেন কিংবা যাত্রীদের নেই। ট্রেনটি থামলে খেয়াল করলাম যে, ট্রেনের বিশাল দরোজার উচ্চতা একেবারে প্লাটফরমের সমান। এক সিঁড়িও বেশ কম নয়। যেনো রাস্তায় হাঁটছে এমন করে ট্রেন থেকে নেমে আসলো যাত্রীরা। একইভাবে ট্রেনে চড়ে বসলাম আমরা, সাথে আরো অনেকেই।
ট্রেনে চড়েও মন ভালো হয়ে গেলো আমার। কী যে সুন্দর একটি ট্রেন। একেবারে চকচক করছে, যেনো সবেমাত্র কারখানা থেকে বের করে কমিশনিং করা হচ্ছে। ট্রেনে বসার যেমন চমৎকার সিট রয়েছে, তেমনি দাঁড়িয়ে থাকার ব্যবস্থাও। উপরে থেকে ঝুলে থাকা হাতল কিংবা ট্রেনে মাঝখানে দেয়া স্টিলের স্ট্যান্ডগুলো ধরে অনায়াসে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। কেউ কেউ সিট খালি থাকলেও না বসে ভ্রমণ করেন। আমি এবং স্বপন জানালার পাশে টুলের মতো লম্বা আসনটিতে গিয়ে বসলাম। জানালাগুলো বিশাল, কাচের। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রেনটির জানালা খোলার কোন ব্যবস্থা নেই। তবে জানালা না খুলেও বাইরের সবকিছু চমৎকারভাবে দেখছিলাম আমরা।
মেট্রো ছুটছিল। কত গতি বুঝতে পারছিলাম না। তবে বেশ ভালোই গতিতে দৌড়াচ্ছে বলে মনে হলো। মেট্রো স্টেশনের অদূরেই গাড়ি চলাচলের রাস্তা। প্রচুর গাড়িও রাস্তা ধরে ছুটছিল। কোথাও রাস্তা, কোথাও পাহাড়, কোথাও যেনো বনভূমি পার হচ্ছিলাম আমরা। কিন্তু চারদিকে একটি সুনসান ভাব, গুছানো, পরিচ্ছন্ন। পাহাড়কে পাহাড়ের মতো রেখে গড়ে তোলা হয়েছে ঘরবাড়িসহ নানা অবকাঠামো। কোথাও পাহাড় কেটে ফেলার কোন চিহ্ন মেট্রো থেকে চোখে পড়লো না। এমন স্বল্পভূমির একটি দেশে এতগুলো পাহাড় এমন অক্ষত থাকা আমাকে বিস্মিত করছিল। ট্রেনের ভিতরে হকারের কোন উৎপাত নেই। যাত্রীদের মধ্যেও নেই কোন অস্থিরতা। অনেক যাত্রীকে দেখলাম বই পড়ছে, তবে বেশিরভাগের চোখই মোবাইলে। জানালায় চোখ দিয়ে গল্প করছিলাম আমরা। অনন্য সুন্দর একটি ট্রেন যাত্রা চলছিল আমাদের। কেন যে ছাত্রজীবনে এমন একটি ভ্রমন করতে পারলাম না খুব আপসোস লাগছিল। ‘এ জার্নি বাই ট্রেন’ রচনা লেখার জন্য এমন দারুণ একটি অভিজ্ঞতা বেশ কাজে লাগতো।
ট্রেনের গতি কমে আসলো। বুঝতে পারছিলাম যে ট্রেনটি থামবে। অল্পক্ষণের মধ্যে ট্রেন একটি স্টেশনে প্রবেশ করলো। আমাদের বগি থেকে অনেক যাত্রী নেমে গেলো। আবার নতুন করে যাত্রী উঠলো। এই স্টেশনটিও দেখলাম, চকচক করছিল। প্রচুর লোকজন, দোকানপাট। লোকজন হাঁটাহাটি করছে, করছে দোকানে দোকানে কেনাকাটাও। কাউকে কাউকে দেখা গেলো বেশ দৌঁড়ের উপর এসে মেট্রোতে চড়লো। আবারো ট্রেন চলতে শুরু করলো। কোন শব্দ নেই, কোন হৈ চৈ নেই। ট্রেনের ভিতরে বাহিরে যে যার মতো।
আরো কয়েকটি স্টেশনে ট্রেনটি একইভাবে থামলো। যাত্রী উঠানামাও করলো। আমরা আমাদের সিটেই বসে আছি। স্বপন বললো, পরের স্টেশনে আমরা নামবো। ওখানে ঘোরাঘুরি করে দেখবো। সে বললো, সিনেমা দেখবি নাকি? হলে বসে কবে যে সিনেমা দেখেছি মনে করতে পারলাম না। একসময় প্রচুর সিনেমা দেখতাম, কিন্তু কেমোন করে যেনো সিনেমার ওপর থেকে মন উঠে গেছে। তবে হংকংয়ে সিনেমা কেমোন সেটা দেখার জন্যই মনে হয় হলে যাওয়া যায়। নতুন একটি অভিজ্ঞতা হবে। তাই স্বপনকে বললাম, দেখা যায়। তবে ভালো সিনেমা কোথায় হচ্ছে দেখ, সেই হলে যাবো। স্বপন তার মোবাইলে কি কি সব দেখতে লাগলো। ট্রেন চলছিল।
আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেলো ট্রেন। স্বপন আমাকে বলল, চল, নামবো। আরো অনেক যাত্রীর সাথে আমরাও নেমে পড়লাম। নেমে পড়ে মনে হলো, কোথায় এসে পড়লাম? এটা কি হংকং বিমানবন্দর? এক চোখের পথ স্টেশনে। শেষ মাথা দেখা যাচ্ছিল না। হাজার হাজার মানুষ। স্টেশনটিতে রেললাইনের পাশ ঘেঁষে পুরোটাই কাচে ঘেরা। প্লাটফরম থেকে কেউ ইচ্ছে করলে রেললাইনে যেতে পারবে না। শুধু ট্রেনের দরোজা যেখানে সেখানেই কাচ নেই, দরোজার মতো খোলা। ট্রেনটি ঠিকঠিক সেই দরোজায় নিজের দরোজা লাগিয়ে দাঁড়ায়। এতে করে যাত্রীদের উঠানামায় কোন সমস্যা হয় না। আগেই বলেছি যে, ট্রেনের দরোজা এবং প্লাটফরম একই লেভেলে। এতে করে ট্রেন থেকে নামতে হুমড়ি খেয়ে পড়ার কোন সম্ভাবনা নেই, বয়স্ক বা শিশুদের জন্য নেই কোন কষ্ট। ট্রেন থেকে নামার পর স্বপন আমি কফি খাবো কিনা জানতে চাইলো। আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। নিকটেই একটি কফিশপে গিয়ে স্বপন দুইটি কফি নিলো। বললো, তোর সাথে ঘুরতে গিয়ে আমিও তো কফিতে আসক্ত হয়ে গেলাম! আমি হেসে উত্তর দিলাম, কফিতে থাকিস, আর কিছুতে আসক্ত হোস না।
সামনের দিকে হাঁটছিলাম, শত শত যাত্রীও একই সাথে হাঁটছিল। কেউ কেউ ঝড়ের বেগে দৌড়ে আমাদের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিলো। ভীষণ এক ব্যস্ততা চারদিকে, কিন্তু কোথাও বিশৃংখলা নেই, হুড়োহুড়ি নেই। বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাবলিক ট্রান্সপোর্টের মালিক হংকংয়ের সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনে দেখার এবং শেখার অনেক কিছু ছিটিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। মুগ্ধ হয়ে সে সব দেখতে দেখতে আমি কফির মগে চুমুক দিচ্ছিলাম। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।