(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হংকংয়ের ভবনগুলোর সিংগভাগই উঁচু উঁচু। এতো বেশি উঁচু যে যা শুধু এই লেখা পড়ে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। ঘাড় বাঁকা করে দেখা কিংবা মাথা থেকে টুপি পড়ে যাওয়াসহ নানা ধরণের কথার মাধ্যমেও বিষয়টি পুরোপুরি তুলে ধরা অসম্ভব। সারাক্ষন মেঘের সাথে খেলা করে হংকংয়ের অগুনতি ভবন। ভূমির অভাব যে কী করে মোকাবেলা করতে হয় তা হংকং বেশ ভালোভাবে রপ্ত করেছে। আর এই অভাব থেকে বাঁচতে হংকংয়ের এক একটি ভবন যেনো আকাশ ছুঁতে চাচ্ছে। ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে বের হওয়ার পর মার্কেটে অনেকক্ষন ঘোরাঘুরি করলাম আমরা। নানা ধরণের পণ্য দেখলাম, মানুষ দেখলাম। কেনাকাটায় ব্যস্ত নারী পুরুষ দেখলাম। স্থানীয় চ্যাপ্টা নাকের মানুষগুলোর পাশাপাশি প্রচুর পশ্চিমারও দেখা মিললো। কী যে সুন্দর একএকটি দোকান, কী যে সুন্দর দোকানে দোকানে ঘোরা মানুষগুলো! সেলসগার্লগুলো চোখে মুখে হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে এমন করে তাকিয়ে থাকে যে দোকানটিকে না ঢোকা বা কিছু কেনাকাটা না করাকে অপরাধের মতো মনে হচ্ছিল। যেনো অনেকটা কোন সুন্দরীর প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার মতো কষ্টের ব্যাপার। একটির পর একটি দোকান পার হয়ে আসার সময় দোকানিদের আহ্বান উপেক্ষা করে সামনে হাঁটাকে বেইজ্জতি কারবারের মতো লাগছিল। কিন্তু আসলেই আমার কেনাকাটার কোন ইচ্ছে হয়না, কিনতে গেলে পণ্যের সাথে ঠকে আসাটা মাগনায় জুটে যায়। অতএব…।
মার্কেটে ঘোরাঘুরি করে বের হয়ে আসলাম। বাইরে বের হয়ে মার্কেটটির উচ্চতা বুঝার চেষ্টা করলাম। উপরের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হলেও ভবনটি ঠিক কত তলার তা আঁচ করতে পারলাম না। হংকংয়ের মাটি নিশ্চয় ভালো। নাহয় এত বিশাল বিশাল ভবনের চাপ সয়ে টিকে থাকতে পারতো না। সাগরকুলের মাটি এত মজবুত! অবশ্য অদূরে অনেক পাহাড়ও রয়েছে। পাহাড় এবং সাগরের অপার মিলনে গড়ে উঠা হংকংয়ের কোন পাহাড়েই চোখ পড়েনি ভূমিখেকোদের। পাহাড়কে পাহাড়ের মতো রেখেই উন্নয়ন হয়েছে, রাস্তা–ঘাট, ফ্লাইওভার, এমআরটি সবই হয়েছে। গাছগাছালীতে যেনো চারদিক ভরে আছে!
শার্ট বা কিছু একটা কিনতে জোরাজুরি করা বন্ধু স্বপনকে অনেকটা টেনে মার্কেটের বাইরে নিয়ে আসলাম ঠিকই, কিন্তু এখন কোথায় যাবো বা কি করবো তা পুরোপুরিই আমার অজানা। পথঘাটতো কিছুই চিনি না, জায়গার নামও জানি না। গাড়িও ছেড়ে দিয়েছি। অতএব স্বপনই আমার ভরসা। তার দিকে তাকালাম। সে মনে হয় বুঝতে পারলো। বললো, এমনিতেই ঘুরবো, তোকে হংকং দেখাবো। নির্দিষ্ট কোন কাজ নেই। আমি মাথা নাড়লাম।
মার্কেটের সামনে থেকে ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করলাম আমরা। স্বপন বললো, সামনে গিয়ে মেট্রোতে চড়বো। তোকে ট্রেনে চড়াবো। আমি হাঁটতে পারবো কিনা জানতে চাইলো স্বপন। বললো, দেশের মতো এখানে হাত ইশারায় যেখানে সেখানে টেক্সি দাঁড়ায় না, নিজের গাড়িও দাঁড়াবে না। নির্দিষ্ট পয়েন্টে গিয়েই গাড়িতে উঠতে হবে। ‘বুঝেছি’ বলে সামনে পা চালালাম।
রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটছি। টাইলস করা ফুটপাত। আমাদের পাশেই অগুনতি সুউচ্চ ভবন। অসংখ্য দোকান, শোরুম। কী যে সুন্দর! চওড়া ফুটপাতে অনাহুত উপদ্রপ নেই। হকার নেই, ভিক্ষুক নেই, রাস্তা এবং ফুটপাতে রিক্সা টেক্সির অনাহুত জটলা নেই। তকতকে ঝকঝকে বলতে যা বুঝায়, ঠিক তাই। এমন ফুটপাতের যেকোন স্থানে আপনি চাইলে শুয়ে পড়তে পারবেন, ঘুমাতে পারবেন। অবশ্য, আপনাকে ফুটপাতে বসার বা শুয়ে পড়ার কোন সুযোগই দেয়া হবে না। ফুটপাত যে শুধু হাঁটার জন্য তা এখানে শতভাগ নিশ্চিত করা হয়েছে। ইউরোপ আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলোতে জনসংখ্যা কম। তারা ফুটপাত নিজেদের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে পেরেছে। কিন্তু হংকংয়ের মতো ঘনবসতির বিপুল মানুষের আনাগোনার মাঝে এমন সুন্দর করে ফুটপাত রাখতে হলে কী পরিমান প্রশাসনিক দক্ষতা লাগে তা অনুধাবন করা কঠিন। এখানে মনে করিয়ে দেয়ার জন্য উল্লেখ করতে পারি যে, হংকং পৃথিবীর অন্যতম একটি ছোট্ট দেশ। ২৬০টির মতো দ্বীপ নিয়ে গঠিত দেশটিতে ভূমির বড়ই আকাল। মাত্র ২৯৩৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশটিতে ভূমি রয়েছে মাত্র ১১০৮ বর্গকিলোমিটার। সাগর নদী রয়েছে ১৮৩০ বর্গকিলোমিটার। এতেই বসবাস করে আশি লাখেরও বেশি মানুষ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি মানুষের বসবাস। এর বাইরে বিশ্বের বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত হংকংয়ে তাবত দুনিয়ার লাখো মানুষ প্রতিদিনই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কেউ ব্যবসার জন্য, কেউবা হানিমুনে, আবার কেউ কেউ শুধু ঘুরে দেখার জন্য। এতে করে লোকে লোকারণ্য হংকং। কিন্তু রাস্তা বা ফুটপাতে কোন জটলা নেই, নেই কোন অনাচার। আমাদের দেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ১৩শ’ জনের মতো মানুষ। আমাদের পাঁচগুণেরও বেশি মানুষের চাপ নিয়েও হংকংয়ের ফুটপাত কী করে যে এমন নান্দনিক থাকে তা মাথায় ঢুকলো না। শুধু সুউচ্চ ভবনই নয়, হংকংয়ের ফুটপাতের সৌন্দর্যও চোখ কপালে তুলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
ফুটপাত ধরে হাঁটছি আমরা, পাশের দোকানগুলোতে থরে থরে সাজানো নানা পণ্য। খাবারের দোকান টোকানও রয়েছে। আমরা হাঁটছিলাম। হাঁটছিলেন আরো অনেকেই। আমরা স্বাভাবিকভাবে ধীরলয়ে হাঁটলেও অন্যরা যেনো দৌড়াচ্ছিলেন। পৃথিবীর দেশে দেশে মানুষকে এভাবে দৌড়াতে দেখে বেশ মজা লাগে আমার। তাদের হাতে যেনো একটুও সময় নেই। কী পরিমাণ দৌড়ের উপরে যে মানুষ বেঁচে থাকে! কতটুক হাঁটলাম কে জানে! রয়ে সয়ে হাঁটার ফলে সময় এবং দূরত্ব কোনটিই মাথায় নেই। কোন তাড়া না থাকায় সেদিকে আমাদের খেয়ালই ছিল না। জেব্রাক্রসিং ধরে রাস্তা পার হলাম। নির্দিষ্ট পয়েন্ট ছাড়া এখানে কেউ রাস্তা পার হয়না। গাড়ির সামনে দিয়ে হাত তুলে দৌঁড় দেয়ার নজির হংকংয়ে নেই।
রাস্তার অপর পাড়েই মেট্রোস্টেশন। মেট্রো স্টেশনের প্রবেশ মুখেই আমার ঘোর লাগতে শুরু করলো। এতো সুন্দর হতে পারে রেলস্টেশন। হংকংয়ের গণপরিবহন ব্যবস্থার অন্যতম এই এমআরটি শুধু সেরাই নয়, যেনো সেরাদের সেরা। এই গণপরিবহন অসম্ভব রকমের জনপ্রিয়ও। যাত্রীদের সুযোগ–সুবিধার জন্য যা যা করা দরকার তার সবই রয়েছে হংকংয়ের এমআরটি স্টেশনে। ব্যাংকিং বুথ থেকে শুরু করে খাবার দোকান। বইপত্র এবং সাময়িকীর স্টলও রয়েছে। যাত্রীবান্ধব এমন সব পরিকল্পনাই হংকং এমটিআরটিকে পৃথিবীর সেরাদের কাতারে নিয়ে গেছে। ২১১ কিলোমিটার রেল লাইনের মাধ্যমে প্রায় পুরো হংকংকেই এমআরটি নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। স্টেশন রয়েছে ১৫০টি। প্রতিদিন অন্তত ৩৫ লাখ যাত্রী হংকংয়ের এমআরটি ব্যবহার করেন। এই তালিকায় নিজেদের গাড়ি আছে এমন হাজার হাজার মানুষও রয়েছেন। প্রতিটি স্টেশনে রয়েছে বিনামূল্যের ওয়াই–ফাই সুবিধা। গণশৌচাগার বাসার ওয়াশরুম থেকে পরিষ্কার। টিস্যু থেকে শুরু করে ওয়াশরুমে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার সব আয়োজনই দেখা গেলো। স্টেশনের নানা পয়েন্টে বয়স্ক এবং শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্যও রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। স্টেশনে মানুষ গিজগিজ করলেও যেনো হৈ চৈ নেই, নেই ধাক্কাধাক্কির মতো চিরচেনা ঘটনা। সবাই যেনো নিজেদের সামলে নিয়ে পথ চলায় অভ্যস্ত।
প্রতি মিনিটেই ট্রেন। যেনো দম ফেলার সময় নেই। শত শত মানুষ ট্রেনে চড়ছেন, ট্রেন থেকে নামছেন। কিন্তু সবই অত্যন্ত শৃংখলিত। কুলি কিংবা হকারদের কোন ঠেলাঠেলি চোখে পড়লো না। স্টেশনে ঢোকার প্রায় সাথে সাথে ট্রেনে চড়ার সুযোগ। টিকেট কাটার জন্যও স্বয়ংক্রীয় ব্যবস্থা। সবকিছু মিলে আলীশান এক আয়োজন। এমন আয়োজন ঠিকঠাকভাবে সামাল দিতে কী পরিমান দক্ষতা লাগে তাও আমাকে চিন্তায় ফেলে দিল।
স্বপন আমার জন্য একটি টিকেট কিনে নিলো। মেশিনে তার ব্যাংক কার্ড দিয়েই পেমেন্ট দিয়েই মেশিন থেকেই টিকেট নিয়ে নিল। কোন মানুষের সাহায্য লাগলো না। কোথায় থেকে কোথায় যাবো তা নিয়েও যেনো কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। স্বপনের নিজের পুরো মাসের টিকেট রয়েছে। স্টেশনে প্রবেশের সময় স্বপন আমার জন্য এক মগ কফিও নিয়েছিল। ইতোমধ্যে সে বুঝে গেছে যে, দুনিয়াতে আমার কফি ছাড়া অন্য কোন নেশা নেই। তাই স্টেশনের প্রবেশমুখের খাবারের আউটলেট থেকে সে ওয়ান টাইম মগে কফি নিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিল। ঢাকনা দেয়া মগটিতে চুকচুক করতে করতে আমি চারপাশের অপরূপ সব আয়োজন দেখতে লাগলাম।
স্বপন বললো, নেক্সট ট্রেনে উঠবি, নাকি একটু ঘুরে ফিরে স্টেশন দেখবি। আমি সমস্যা না হলে স্টেশন ‘দেখে টেকে’ যেতে চাই বলে জানালাম। স্বপন, আশ্বস্ত করলো যে সমস্যার কিছু নেই। প্রতি মিনিটেই ট্রেন আসবে। যখন খুশি উঠে পড়লে হবে। এক টিকেটেই পুরোদিন যে কোন স্টেশন কিংবা ট্রেনে চড়া যাবে। আমার মগজে ঝড় শুরু হওয়ার জন্য স্বপনের কথাগুলো যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছিল। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।