(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
‘তাবু বিনোদন’ পাশে রেখে সামনে হাঁটছিলাম। বর্ণিল তাবুগুলোর ভিতরে বহু মানুষই রঙিন স্বপ্নে বিভোর। তারা বেশ আয়েশী ভাব নিয়ে সময় কাটাচ্ছে। কেউ কেউ কি ঘুমিয়েও গেছে? আসলে বাইরে থেকে তা বুঝার কোন উপায় নেই। তাবুর ভিতরে কি হচ্ছে, কে জেগে আছে বা কে ঘুমাচ্ছে তার কিছুই বাইরে থেকে দেখার সুযোগ নেই। তবে তাবুগুলোর কোন কোনটিতে দরোজার পর্দাটা খোলা দেখা গেলো। আড়চোখে যা দেখা গেলো তাতে তাবুর তারা বসে আছে, গল্প করছে, খুনসুটি করছে। কোন কোনটিতে তরুণ তরুণীর ছুটিয়ে আড্ডা দেয়ার দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল। আমরা একেবারে তাবুর পাশ দিয়ে হাঁটার ফলে ভিতরের অচিন ভাষার টুকটাক কথাবার্তাও কানে ভেসে আসছিল। তাবুর এমন বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত থাকলে হোটেল টোটেলের আর দরকার কি? এমন তাবুতেই তো রাত–দিন পার করে দেয়া যায়!
ছায়া ঢাকা পাখী ডাকা পথ ধরে হাঁটছি আমরা। আরো মানুষজন হাঁটছে, কেউ কেউ গাছের ছায়ায় বেঞ্চিতে বসে আছে। কেউবা রাস্তার উপরই চাদর বিছিয়ে শুয়ে আছে। আহারে, এদের মনে হয় তাবু নেই। তাবু থাকলে তো আর এভাবে রাস্তার উপর শুয়ে পড়তে হয় না। পার্কের ভিতরে রাস্তাটি মোটামুটি প্রশস্থ। এক দু’জন মানুষ রাস্তার পাশে শুয়ে থাকলেও পথ চলতে কোন অসুবিধা হচ্ছিলো না। রাস্তায় গাড়ি চলাচল না থাকায় গাড়িচাপা পড়ার কোন শংকা নেই। ছিনতাইকারীর দাপট না থাকায় নিরাপত্তারও কোন অভাব নেই। এমন গাছের ছায়ায় পাখির গান শুনতে শুনতে প্রকৃতির কোলে ঘুমিয়ে যাওয়ার যে সুখ তার সাথে কি কোনকিছুর তুলনা চলে! ঘুমের ঘোরে হয়তো কত সুখস্বপ্ন ভিড় জমাবে!
ভিক্টোরিয়া পার্কে মানুষজন যা আছে তার বেশিরভাগই তরুণী। দলে দলে তরুণীরা ঘুরতে এসেছে পার্কে। এতো তরুণী কোত্থেকে যে এলো কে জানে! হংকংয়ে কি পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি! হয়তোবা! এত এত্ত তরুণীর আনাগোনার মাঝে পুরুষের সংখ্যা একেবারে হাতে গোনা। আমাদের দুজনকে ধরলেও এই সংখ্যা তরুণীদের এক চতুর্থাংশের বেশি হবে না! তরুণের সংখ্যা এভাবে হ্রাস পাওয়ার কারণ কি? স্বপনের কাছেও কোন সদুত্তর নেই। বললো, প্রকৃতি। নগণ্য সংখ্যক পুরুষ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে আমরা অনেকটা সংখ্যালঘুর মতো পার্কে হাঁটছিলাম। দলে দলে আসা উচ্ছ্বসিত মেয়েদের দেখে বেশ খটকা লাগছিল। এরা কি স্কুল কলেজ ফাঁকি দিয়ে এসেছে? কে জানে! নাকি অফিস কামাই করে পার্কে বেড়াচ্ছে!
বিশাল পার্কটি আসলেই সুন্দর। হংকংয়ের মতো উন্নত দেশের পার্ক সুন্দর হবে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকবে এটা স্বাভাবিক, কিন্তু এই সুন্দর এতো বেশি যে বড় বেশি চোখে লাগছিল। নাকি হিংসে হচ্ছিল। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তবে হংকংয়ের ভিক্টোরিয়া পার্ক আমার ভীষণ ভালো লাগলো।
প্রায় ৫০ একর জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে ভিক্টোরিয়া পার্ক। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই জায়গার প্রায় পুরোটাই সাগর ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে। রিক্লেম ল্যান্ড! একসময় এই পার্কের এমন জৌলুশ না থাকলেও দিনে দিনে এখন হংকং দ্বীপের প্রধান পার্ক হয়ে উঠেছে ভিক্টোরিয়া কিংবা কাছের সেন্ট্রাল। এছাড়া আরো কয়েকটি পার্ক এবং বিনোদন স্পট থাকলেও ভিক্টোরিয়া যেনো স্বতন্ত্র। পার্কের ভিতরে কিছুটা পাহাড় পাহাড় আদল রয়েছে, উঁচু নিচু। অদূরে মাঝারী উচ্চতার একটি পাহাড়ও দেখা যাচ্ছিলো। পার্কের ভিতরে অনেকটা অভয়ারণ্যের মধ্যে গাছগাছালী রয়েছে। একটি এলাকাকে মনে হচ্ছিল গভীর অরণ্য। নাম না জানা বিশাল সাইজের উঁচু গাছগুলো সূর্যের আলো ঠেকিয়ে দিয়েছে। কিছু কিছু গাছের ঝুল বটগাছের মতো নিচে নেমে এসেছে। আবার সুপারি গাছ এবং খেঁজুর গাছের মতো অনেকগুলো গাছও দেখা গেলো। কত হাজার রকমের গাছ যে পার্কটিতে রয়েছে!
মতো হেথায় হোথায় বিছানা করে বহু লোক পরিবার পরিজন নিয়ে পিকনিক করছে। কেউ কেউ দিব্যি ঘুমিয়ে গেছে। মোলায়েম টাইপের পরিবেশ পার্কের পরতে পরতে। একটি বাচ্চা ছেলে সাইকেল চালাচ্ছিল। কোথায় গিয়ে যে পড়বে সেই খেয়াল ছেলেটির নেই। সে বেশ জোরেই ছুটছে। একদল তরণীকে দেখা গেলো টিকটক টাইপের কিছু একটা করছে। হংকংয়ের ভাষা না বুঝার কারনে তাদের বহু কিছু বুঝতে পারছিলাম না। স্বপন বললো, ‘এগুলো দুষ্টু প্রকৃতির মেয়ে! চলে আয়।’
পার্কে ঢোকার সময় স্বপন আমার হাতে একটি জুস ক্যান ধরিয়ে দিয়েছে। ক্যানটি বেশ সুন্দর। অনেকটা বিয়ার ক্যানের মতো। আমি একটু চমকে উঠে ‘বিয়ার টিয়ার’ খাবো না দোস্ত বলায় সে বেশ শব্দ করে হাসলো। বললো, আরে বিয়ার হবে কেন? খেয়ে দেখ। সে নিজের ক্যানটির পিন খুলে চুকচুক করতে লাগলো। স্বপন নিজেকে নন–এ্যালকোহলিক বলে উল্লেখ করে বললো, হংকং এক আজব জায়গা বন্ধু। হরেক রকমের মদ বিয়ার তুই খেতে চাইলে মোড়ে মোড়ে পাবি। কিন্তু তুই যদি না খেতে চাস তাহলে কেউ তোকে জোর করে খাওয়াবে না। মদ বিয়ারের পাশাপাশি হরেক রকমের জুসও বিক্রি হয় জুসবার বা মদের বারে। দোকানে একই ফ্রিজে বিয়ার মদ এবং জুস ঠান্ডা করে রাখা আছে। তোর যেটা ইচ্ছে সেটা খাবি, কেউ বাধা দেবে না। জোর করবে না। তোর খাবারে কেউ ভাগও বসাবে না।
আমি ক্যানের পিনে টান দিলাম। বেশ শব্দ করে ক্যানের ঢাকনাটির আগল আলগা হলো। আমি মুখে দিয়ে ফ্লেভার বুঝার চেষ্টা করছিলাম। তীব্র ঠান্ডা পানি, তবে মনে হলো ডাবের পানি। পানির ভিতরে ডাবের সাস কুচি কুচি করে কেটে দেয়া। চুকচুক করে পানি টানার সাথে সাথে দুয়েক কুচি করে নারিকেলও আসছে। যা ড্রিংকসের স্বাদ অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে। ড্রিংকসের ক্যানে চুমুক দিতে দিতে আমরা পার্কের এদিক ওদিক হাঁটছিলাম। স্বপন জানালো যে, এই পার্ক মূলত একটি সাইক্লোন শেল্টার হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। সেটি অন্তত একশ’ বছর আগে। পরবর্তীতে উপসাগরের এই অংশটি ভরাট করে ফেলা হয়। সে ভরাটকৃত জমিতেই পাবলিক পার্কটি নির্মাণ করা।
বাহ, দারুণ একটি স্ট্যাচু। রানী ভিক্টোরিয়ার। ভিক্টোরিয়ার নামে ধন্য পার্কে রাণীর স্ট্যাচু। আচ্ছা, রাণী কি কোনদিন এই পার্কে এসেছিলেন। স্বপন বললো, না। এসেছেন বলে শুনিনি। তবে বহু বছর ধরে উনার স্ট্যাচু দেখছি। বহু বছর মানে আমি হংকং আসার পর থেকে রাণী এভাবে সিংহাসনে বসে আছেন!
রানীর মূর্তিটির বেশ জৌলুশ চোখে পড়ছিল। মেলটিং করা স্টিলের মূর্তিটি তৈরি করা হয় ইংল্যান্ডে। ওখান থেকে আনা হয় হংকংয়ে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি চলে গিয়েছিল জাপান। যুদ্ধ শেষে সেটি উদ্ধার করে ১৯৫৫ সালে পার্কে স্থাপন করা হয়। সেই তখন থেকে রানীর স্ট্যাচু পার্কের বেশ বড়সড় একটি জায়গা দখল করে বসে আছে। সাগর ভরাট করে গড়ে তোলা অনন্য পার্কটি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৫৭ সালের অক্টোবর থেকে সবার জন্য চালু রয়েছে।
হংকং জুড়ে জায়গা–জমির ভয়াবহ আকাল। পাহাড় এবং সাগর বাদ দিলে বাড়িঘর করার মতো জায়গা হংকং দ্বীপে খুব বেশি নেই। দেশটির মাটি একেবারেই কম, অনেকটা ফুরিয়ে গেছে বলা চলে। এমতাবস্থায় সাগর ভরাট করে তুলে আনা প্রায় ৫০ একর জমি পার্কের নামে ফেলে রাখা বোকামি বলে মনে হচ্ছিল। আমাদের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ এমন জায়গা পেলে বহু আগেই দোকানপাট নির্মাণসহ নানা পন্থায় জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতেন। কিন্তু এখানে সাগর ভরাট করে তুলে আনা এতো কষ্টের ভূমিতে মানুষ চাদর বিছিয়ে শুয়ে আছে!
জুসের ক্যানে চুমুক দিতে দিতে হাঁটছিলাম। পার্কের ভিতরে দারুণ একটি সুইমিং পুল। সাঁতার কাটতে পারলে মন্দ হতো না। টেনিস কোর্টের কথা আগেই লিখেছি, এখন খেয়াল করে দেখালাম যে একেবারে নীলনয়না একটি সুইমিং পুল। আরো কত কি সুবিধা যে পার্কটিতে নাগরিকদের জন্য করে রাখা হয়েছে কে জানে! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।