দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৬ মার্চ, ২০২৪ at ৮:২৫ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

থরে থরে সাজানো নানা পণ্য নজর কাড়ছিল, কাড়ছিল মনও। শপিং মলের শোকেসগুলোতে কত রকমারি জিনিসপত্র যে সাজিয়ে রাখা হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই! কী নেই এখানে! মনে হচ্ছিল সূচ থেকে রান্নার হাড়ি পর্যন্ত একটি পরিবারের যা যা লাগে তার সবই ঠাঁই পেয়েছে মলে। কোথাও কাপড়. স্যুট, ব্লেজার, কোথাওবা বালিশকোল বালিশকুশন, সাথে আছে বিছানার ছাদর। কোথাও আবার অলংকার, স্বর্ণের এবং ডায়মন্ডের। একটি কর্ণারে দেখলাম দুনিয়ার প্রায় সব নামি দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি। অন্য কর্ণারে দেখা গেলো মেয়েদের সাতরাজ্যের প্রসাধনী। একদিকে দেখা গেলো থালা বাসন, টি সেট, রাইস কুকার, প্রেসার কুকারসহ নানা গৃহস্থালী সরঞ্জাম। মোবাইল ফোনের দোকানে দুনিয়ার নানা মডেলের সেট। সেলস গার্ল এবং সেলস বয়দের ব্যস্ততার অন্ত নেই। এটা দেখাচ্ছে, ওটা দেখাচ্ছে। কেউ কেউ প্যাকেট করছে।

উপচে পড়া ভীড় শপিং মলে। প্রচুর মানুষ কেনাকাটা করছেন। কেনাকাটা করছেন আমার বন্ধুপত্নী, প্রিয় ভাবীও। আমি পেছনে পেছনে হাঁটছি। ভাবী মাঝে মধ্যে আমাকে কোন একটি জিনিস দেখিয়ে কেমন হবে জানতে চাচ্ছিলেন। শপিংয়ের ক্ষেত্রে আজীবনের বোকামানুষ এই আমি বেশ বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ছিলাম। ভাবী চকলেটের শোকেজ থেকে অনেক রকমের চকলেট নিলেন। ট্রলির উপচে পড়া অবস্থা করে ভাবী ক্ষান্ত দিলেন। বললেন, চলেন, একটা ব্যাগ কিনি। ট্রলি ব্যাগ। আমি আবারো পিছু নিলাম। একই মলে ট্রলি ব্যাগেরও বিশাল কর্ণার। নানা সাইজের এবং নানা রঙের অসংখ্য ব্যাগ। মানেও হেরফের আছে বুঝা যাচ্ছিল। ভাবী দেখে শুনে বেশ শক্তপোক্ত একটি ব্যাগ নিলেন। দারুণ কালার। ফেরার পথে শপিং মলের প্রসাধনী কর্ণার থেকে সাবান স্যাম্পুও কিনলেন বেশ কয়েকটি। ওগুলোর মুখ আবার বেশ ভালো করে ট্যাপিং করিয়ে নিলেন। সবকিছু মিলে ঘন্টা দুয়েকের আলীশান শপিং শেষে ভাবী কাউন্টারে গিয়ে বিল পরিশোধ করলেন। কত ডলারের সওদা করেছেন তা আমি বুঝলাম না। কার্ড থেকেই পেমেন্ট হওয়ায় এটি আমার জানারও কথা না। কাউন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে ভাবী নতুন কেনা ব্যাগটির মধ্যে সব জিনিসপত্র সুন্দর করে গুছিয়ে নিলেন। বললেন, এতো পোটলাপুটলি টানার দরকার কি? ব্যাগে সব ভরে নিলে কষ্ট কমে যাবে। আমিও সায় দিলাম। ভাবীর কাছ থেকে জোর করে ব্যাগটি টেনে নিলাম। ট্রলি টেনে মার্কেটের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ড্রাইভারকে ফোন করা হয়েছে। অল্পক্ষণের মধ্যে ড্রাইভার এসে গেলো। সে ব্যাগটি গাড়ির পেছনে তুলতে তুলতে আমরা গাড়িতে চড়ে বসলাম।

কিছুদূর আসার পর ভাবী বললেন, আরে আপনাকে তো কিছু খাওয়ালাম না। চলেন, কোথাও বসে কিছু খেয়ে নিই। আমি বাসায় গিয়ে ডিনার করবো বলায় ভাবী বললেন, তা তো করবেনই। কোন ক্যাফেতে বসে কফি খাওয়ার সাথে কি আর বাসায় ডিনার খাওয়ার বিরস সময়কে এক করা যাবে! চলেন, কফি খাই। বন্ধুর বউকে নিয়ে ক্যাফেতে বসে ধুমায়িত কফি খাওয়ার লোভ ছাড়া কঠিন। তাছাড়া কফির নাম শুনলে যেখানে আমার নেশা জেগে উঠে, সেখানে এমন প্রস্তাবে না করারতো প্রশ্নই উঠে না।

ড্রাইভারকে কি একটা জায়গার নাম বলে দেয়া হলো। গাড়ি ছুটছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে ড্রাইভার গতি কমিয়ে ইন্ডিকেটর দেয়ায় বুঝতে পারলাম যে, ক্যাফের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। আমার ধারণাই ঠিক। আলোকোজ্জ্বল একটি ক্যাফে। শুধু ভিতরে নয়, বাইরেও বসার চমৎকার ব্যবস্থা। কিছুটা দূরত্ব রেখে স্থাপিত চেয়ার টেবিলগুলোতে বহু মানুষ বসে খাওয়া দাওয়া করছেন। ভিতরেও অনেক মানুষ। কোন টেবিলে বেশ কয়েকজন, আবার কোন কোন টেবিলে জোড়ায় জোড়ায় বসে থাকা তরুণ তরুণী। প্রেমের দৃশ্য পুরো পৃথিবীতেই একই। দেখলেই বুঝা যায়। প্রেমের সময় চেহারা থেকে খুশীর ঝিলিক বের হয়, যা খুব সহজেই চোখে পড়ে। সংসারে গিয়ে ঠেলাঠেলিতে একেক দেশের দৃশ্যপট একেকভাবে পাল্টে যায়। আমরা বাইরের একটি টেবিলে বসলাম। মাথার উপর ছাতার মতো বর্ণিল আচ্ছাদন। এক তরুণী এগিয়ে আসলো। ম্যানু বাড়িয়ে দিয়ে মাথা ঝুকালো। আমি তাড়াতাড়ি ভাবীকে বললাম যে, শুধু কফি খাবো। ল্যাতে বা ক্যাপাসিনো। ভাবী হাসলেন। কিচির মিছির করে কি কি সব বললেন। মেয়েটি আবারো পুরো শরীর বাঁকিয়ে মাথা ঝুকিয়ে হাসিমুখে চলে গেলো। ভাবী ড্রাইভারকে ফোন করে রেস্টুরেন্টে এসে কিছু খেয়ে নিতে বললো।

কিছুক্ষণ পর মেয়েটি ফিস ফিঙ্গার টাইপের একটি খাবার নিয়ে হাজির হলো। টেবিলে রাখা একেবার ঝাল সসটি বেছে নিয়ে তাতে মুড়িয়ে মুড়িয়ে ফিস ফিঙ্গার সাবাড় করতে লাগলাম। দারুণ স্বাদ। তবে আমাদের ফিস ফিঙ্গারের মতো নয়। ভাবী আমার মনের অবস্থা বুঝলেন। বললেন, মাছের তৈরি। তবে সাথে আরো কিছু মিক্সড করা হয়। মসলাপাতিও একটু আলাদা। বেশ মজা লাগে। এটি আমার এবং আপনার ভাইয়ের খুবই পছন্দের একটি খাবার। খুবই ভালো বানায় এরা। এদিকে আসলে আমরা অবশ্যই এটি খেয়ে তারপর বাসায় যাই। আমি বর আর দেবরের পার্থক্য নিয়ে ভাবীকে দারুণ মজার একটি কৌতুক শুনালাম। ভাবী হাসতে হাসতে কুটিকুটি হতে লাগলেন। আমি আলতো আলতো কামড়ে ফিস ফিঙ্গার (!) সাবাড় করতে লাগলাম।

কফিও দারুণ বানিয়েছে। স্টারবাকসের কফির মতো মনে হচ্ছিল। নানা গল্পে গল্পে আমরা কফি খেলাম। বহুভাবে কফির বিলটি দেয়ার চেষ্টা করেও সফল হলাম না। ভাবীই দিলেন। সুন্দরী মহিলা নিয়ে কফি খেয়ে বিল দিতে না পারার কষ্ট বেশ টের পাচ্ছিলাম!

বাসায় ফিরে ড্রয়িংরুমেই বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেল। সোফায় হেলান দিয়ে টিভি দেখছিলেন তিনি। গায়ে ছাদর দেয়া। অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট। মন খারাপ হওয়ার জন্য এমন একটি দৃশ্যই যথেষ্ট। প্রাণবন্ত এবং বন্ধুবৎসল একটি মানুষ কেমন যেনো অচিন হয়ে যাচ্ছেন। বন্ধুর কপালে হাত দিয়ে দেখলাম। হালকা জ্বর। তিনি হাসলেন। বিষণ্নতার হাসি।

সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠে গেলাম। তিন তলায় আমার রুমে এসে ফ্রেশ হলাম। একটু পর ড্রাইভার সদ্য কেনা ব্যাগটি মাথায় নিয়ে হাজির হলো রুমে। একপাশে রেখে সে নেমে যাচ্ছিলো। আমি হৈ হৈ করে উঠলাম। আরে ব্যাগ এখানে কেন? এগুলো আমার নয়, ভাবীর বাজার। সংসারের জিনিসপত্র। ব্যাগ দোতলায় নিয়ে যাও। ড্রাইভার বললেন, ম্যাডামই তো আপনার রুমে দিয়ে যেতে বলেছেন। আমার বেশ খটকা লাগলো। ব্যাপার কি জানার জন্য আবারো নিচে নেমে এলাম। দেখি টুনাটুনির মতো দুজনে বেশ হেসে হেসে গল্প করছেন। আমাকে দেখে ভাবী একটু সরে বসলেন। বললেন, বসেন।

আমি ব্যাগের প্রসঙ্গ তুলতেই ভাবী বললেন, ওগুলো তো আপনার জন্যই কিনেছি। ভাবী এবং বাচ্চাদের জন্য। আপনি শুধু একটু কষ্ট করে নিয়ে যাবেন। কেবিন ব্যাগ নিয়ে ঘুরেন, তাই লাগেজ ব্যাগ নেই বলে নতুন ব্যাগও কিনতে হলো। আমি থতমত খেয়ে গেলাম। কি বলে! এতো শপিং আমার জন্য! আসলে বিদেশ গেলে শপিং করা আমার ধাতে সয় না। করিও না। একটি ক্যাবিন ব্যাগ নিয়ে ঘুরে ফিরে চলে আসি। বিদেশে আমার একমাত্র লোভ থাকে দেখায়, আর কিছুরই নয়। খাওয়া কিংবা শপিং কোনটিই আমাকে টানে না। শুধু নতুন নতুন জায়গাগুলো আমাকে হাতছানি দেয়, বুকের একদম গভীরে গিয়ে টানতে থাকে। আমি চরকার মতো ঘুরি, রাতে দিনে ঘুরি। সকাল থেকে গভীর রাত অব্দি ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে যাই, পরদিন সকালে আবারো নতুন কোন পথে নামি। শপিংমলেও যাই, দেখতে। কিন্তু ওই যে কেনাকাটা সেটা ঠিক আমার হয়ে উঠে না। করি না। আমার বউ বাচ্চাও কিছু আশা করে না। এয়ারপোর্ট থেকে বাচ্চাদের জন্য কিছু চকলেট কিনে নিই, সেটাই আমার শপিং। ভাবী হাসলেন। বললেন, দেখবেন এরূপ করলে ভাবী একসময় আর আপনাকে বিদেশ যেতে দেবে না। বিদেশ থেকে ফেরার সময় ঘুষ নিয়ে যেতে হয়। সেটা আমি শিখিয়ে দিলাম। শিখিয়ে দেয়ার জন্য নয়, অসুস্থ স্বামীর টেনশনে প্রায় দিশেহারা থাকার মাঝেও ভাবী যে আমার বাচ্চাদের কথা মনে করে শপিং করলেন, এতগুলো জিনিস গিফট করলেন, আমার ব্যাগ নেই দেখে ব্যাগ কিনে এমন যত্নে সবকিছু গুছিয়ে দিলেন সেজন্য ভাবীকে ধন্যবাদ দিলাম। টিভিতে একটি নাটক চলছিল। বাংলা নাটকের মান দিন দিন ভালো হচ্ছে। নাটকটি দেখতে আমাদের বেশ ভালোই লাগছিল। ভাবী ভিয়েতনামি মেয়েটিকে কি যেনো বললেন, একটু পর ধুমায়িত চা নিয়ে সে হাজির হলো। আমরা তিনজনে জমিয়ে চা খেতে লাগলাম। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ আল রায়হান স্মরণ
পরবর্তী নিবন্ধ৭ই মার্চ : ইতিহাসের সেই বজ্রকণ্ঠ