দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৮ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:১৪ পূর্বাহ্ণ

এমন একটি ফোন পেলাম যে মন মেজাজ নিমিষেই ফুরফুরে হয়ে উঠলো। ফোন করেছেন আমার বন্ধু এবং আমার লায়ন্স ক্লাবের প্রভাবশালী সদস্য লায়ন ফজলে করিম লিটন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি আমার বেশ ভালো এবং শুভাকাঙ্খী একজন বন্ধু। বিভিন্ন সময়ে লায়নিজমের নানা খবরাখবর তিনি আমাকে দেন, আমিও। তবে এখন যে খবরটি তিনি দিলেন তা যেন হাতে আকাশের চাঁদ তুলে দেয়ার মতো ব্যাপার। আমার মনে হচ্ছিল লিটন ভাই ফোন নয়, আমার হাতে স্বর্ণালী এক দুয়ারের চাবি তুলে দিলেন!
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। বিদেশ সফরের প্রস্তাব। বিদেশ যাওয়ার জন্য আমি তো সবসময় এক পা বাড়িয়ে রাখি। এই আগ বাড়িয়ে থাকা অবস্থায় কেউ যদি সত্যি সত্যি বিদেশ যাওয়ার প্রস্তাব দেন তখন আগপিছ কোন কিছু না ভেবেই লাফিয়ে উঠি। নাচুনে বুড়ির ঢোলের আওয়াজ শোনার মতো ব্যাপার স্যাপার। ফজলে করিম ভাই আমাকে চীন সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে পাসপোর্ট দেয়ার অনুরোধ করলেন।
চীন নিয়ে দুয়েকটি কথা আগে বলে নিই। বিদেশ সফরের জন্য আমি তো বরাবরই আগ্রহী, চীন সফরের জন্য আরো একটু বেশি আগ্রহী। বলতে গেলে বহু বছর ধরে এই আগ্রহের লালন করছি আমি। প্রথমত আমাদের নবিজী (সাঃ) চীন সফরের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন ‘জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে চীনে যাও।’ আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে তিনি চীনে যাওয়ার পরামর্শ কেন দিয়েছিলেন তা নিয়ে ধর্মীয়ভাবে হয়তো কোন ব্যাখ্যা থাকতে পারে। আমি সেদিকে যাচ্ছি না। চীনারা যে জ্ঞানী তা আজ প্রমানিত। পুরো পৃথিবী নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে এসে সুপার পাওয়ারে পরিণত হয়েছে চীন। এক বিশাল পরাশক্তি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির এই দেশটি শুধু সুপার পাওয়ারই নয়, একই সাথে পৃথিবীর ব্যবসা বাণিজ্যও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। আমি কোন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ নয়, নয় অর্থনীতিবিদ। চীন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি সাধারণ একজন পর্যটক। বেড়াতে ভালোবাসি। যা দেখি তা লিখি। চীনের পরাশক্তি কিংবা পৃথিবীর সুপার পাওয়ার হয়ে উঠার পোস্টমটমে আমার কোন আগ্রহ নেই। ওসব নিয়ে আমি লিখবোও না। তবে জ্ঞানবিজ্ঞান যে তারা করায়াত্ত করেছে, বিশ্ব অর্থনীতিকে যে তারা নিজেদের হাতের পুতুলে পরিণত করেছে তাও অস্বীকার করবো না।
বেশ কয়েক বছর আগে আমি তাইওয়ান গিয়েছিলাম। চীনেরই অংশ বলে দাবি করা হয় তাইওয়ানকে। অবশ্য আমেরিকার অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়ে তাইওয়ান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের মতো করে পরিচালিত হচ্ছে। তবে চীনের সামরিক অস্ত্রের বহু কামানের মুখই তাইওয়ানের দিকে তাক করা বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। তাইওয়ান নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র বলে দাবি করলেও চীন যখন তখন এই দেশটি দখল করে একটি প্রদেশে পরিণত করতে মরিয়া। সুযোগ পেলে যে চীন ঘটনাটি ঘটাবে তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় নেই। তবে তাইওয়ানের পাশে আমেরিকার মতো দেশ থাকায় বিষয়টি খুব সহজে ঘটবে বলেও অনেকে মনে করেন না। যাক, চীন তাইওয়ানের ভবিষ্যত নিয়ে আমার বিশেষ কোন আগ্রহ নেই। আগ্রহ নেই তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়েও। তবে তাইওয়ানের ১০১ তলা উচ্চতার ‘ওয়ান ও ওয়ান’ মলের উপর দাঁড়িয়ে আমি খুব লোভাতুরভাবে তাকিয়েছিলাম চীনের সীমান্তের দিকে। মনে হয়েছিল যদি দেশটিতে যেতে পারতাম! যদি তাইওয়ানের ভিসায় চীনে প্রবেশ করতে পারতাম! দেশ দুইটির সম্পর্ক বাঘে মোষে, তাই এক ভিসায় দুই দেশ ভ্রমণের সুযোগ কল্পনার ফানুস উড়ানোর মতো! অতএব আমি চীন সফরের আশা বাদ দিয়েই তাইওয়ান ভ্রমণ সম্পন্ন করেছিলাম।
এর কয়েক বছর পর গিয়েছিলাম হংকং। হংকং-এর অলি গলিতে প্রচুর চীনা লোক গিজগিজ করছিল। হংকং-কেও চীনের অংশ বলে মনে করা হয়। সুযোগ পেলে চীন হংকং-এর দিকেও হাত বাড়াবে বলে অনেকে মনে করেন। চীনের বেশ বড় নিয়ন্ত্রন রয়েছে দেশটির উপর। হংকং স্বাধীনতা ভোগ করলেও তা বেশ শর্তসাপেক্ষ। আমি হংকং এর দ্য পিক- থেকে চীন সীমান্তের দিকে তাকিয়েছিলাম। আহা, যদি হংকং এর ভিসায় চীন ঘুরে আসতে পারতাম। দেশ দুইটির মধ্যে ট্রেন চলাচলও রয়েছে। রয়েছে স্বাভাবিক ব্যবসা বাণিজ্য। হংকং-এর হারবারে আমি যখন ইয়টে ভাসছিলাম তখন মনে হয়েছিল যদি একুলে না ভিড়ে চীনের উপকুলে গিয়ে ইয়টটি নোঙর করতো! আমার সেই আশা পূরণ হয়নি। হংকং এর অলিগলি এবং সাগরে কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করে আমি থাইল্যান্ড হয়ে ফিরে এসেছিলাম দেশে। চীন নিয়ে একটি হাহাকার বুকের একদম গভীরে লালন করছিলাম সযতনে। সেই চীনে যাওয়ার প্রস্তাবটি যখন বন্ধু লায়ন ফজলে করিম লিটন করলেন তখন হাতে আকাশের চাঁদ পাওয়ার আনন্দ তো হতেই পারে! ফজলে করিম ভাই আমাদের ক্লাবের আরো কয়েকজন লায়ন সদস্য এবং ঢাকার তিন ব্যবসায়ীকে নিয়ে একটি টিম গঠন করলেন। সবাই গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। একমাত্র সাংবাদিক আমি। চীনের একটি বড় কোম্পানির আমন্ত্রনে আমাদের চীন সফরের আয়োজন করা হয়েছে বলেও জানানো হলো। আমি পাসপোর্টসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজে ঘুরতে লাগলাম।
চীন অত্যন্ত কনজারভেটিভ একটি রাষ্ট্র, রক্ষণশীল। বাইরের কোন সাংবাদিককে তারা পারতপক্ষে নিজেদের দেশে ঢুকতে দিতে চায় না। নিজেদের মতো করে নিজেরা থাকে। এমনকি ফেসবুক ট্যুইটারের মতো এ্যাপসগুলোও চলতে দেয়া হয়না। নিজেদের উইচ্যাটসহ কি কি সব এ্যাপসের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আমার পাসপোর্টসহ সব কাগজপত্রেই সাংবাদিক পরিচয় রয়েছে। ইচ্ছে করলেও গোপন করার সুযোগ নেই। তাই ফজলে করিম ভাই আমার জন্য বড় কোম্পানির আমন্ত্রনপত্র আনালেও শেষতক চীন সরকার ভিসা দেয় কিনা তা নিয়ে সন্দিহান ছিলাম।
দুপুরে ভাত খাওয়ার পর আয়েশ করে ঘুমুচ্ছিলাম। হাতে তেমন কোন কাজ না থাকায় দিবানিদ্রা পেয়ে বসেছিল। অপরিচিত নম্বর থেকে একটি ফোন আসলো। হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসলো তরুণীর কণ্ঠ। কোন নিউজের জন্য নাকি ফ্ল্যাট বা গাড়ির বিক্রির জন্য ফোন করেছেন বুঝতে পারছিলাম না। অসময়ে এই ধরনের ফোনগুলোই বেশি আসে। ‘কিনবো না’ বলার পর অনুরোধের মাত্রা আরো বাড়তে থাকে। যাক আমি কিছুটা বিরক্তি নিয়েই ‘হ্যালো’ বললাম। অপরপ্রান্ত থেকে তরুণী বললেন, আমি চীনা দূতাবাস থেকে বলছি। আপনি হাসান আকবর? পরিস্কার বাংলায় চীনা দূতাবাস থেকে! কিছুটা অবাক হলাম। আমি নড়েচড়ে বসলাম, উবে গেল ঘুম। বললাম, জ্বী, বলুন। তিনি নানা বিষয়ে জানতে চাইলেন। কেন চীন যেতে চাচ্ছি তাও। আমি সব প্রশ্নেরই উত্তর দিলাম। তরুণী আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রাখলেন।
আমার মনে হলো, ভিসা হয়ে যাবে। কারণ তরুণীর সব প্রশ্নের উত্তরই আমি অত্যন্ত সাবলীলভাবে দিতে পেরেছিলাম।
দিন তিনেক পর ফজলে করিম ভাই ফোন করলেন। বললেন, আমাদের সবার ভিসা হয়ে গেছে। কাউকে আটকায়নি। করিম ভাইকে কিছুটা খুশীও মনে হলো। এক পর্যায়ে তিনি বলেই ফেললেন যে, আমার ভিসার ব্যাপারটি নিয়ে তিনি কিছুটা শংকিত ছিলেন। সাংবাদিক মানুষ, যদি না দেয়!
ভালোয় ভালোয় আমাদের বিমান টিকেট থেকে শুরু করে সব আয়োজনই গোছানো হলো। করিম ভাই সবকিছু করে আমার হাতে একটি ফাইল ধরিয়ে দিলেন। যাতে ভিসা থেকে শুরু করে আসা যাওয়ার টিকেটসহ সবই রয়েছে। তবে টিকেট করার আগে করিম ভাই আমার কাছ থেকে ফেরার তারিখটি জেনে নিয়েছিলেন। ওই কোম্পানি আমাদেরকে আট দিন রাখবে। এর থেকে বেশি থাকতে হলে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আয়োজন করতে হবে। তাই বাড়তি থাকবো কিনা তা করিম ভাই আমার কাছ থেকে আগেই জেনে নিয়েছিলেন। আমি কোন কিছু চিন্তা না করেই ১৫দিন পরে ফিরতি টিকেট করতে বললাম। মনে পড়লো আমার এডিটর স্যার দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেকের কথা। তিনি আমাকে একবার বলেছিলেন, ‘কোথাও গেলে ধারে-কাছের সবই দেখে আসবা। দ্বিতীয় বার আর ওইদেশে যেতে পারবা এমন কোন গ্যারান্টি নেই।’ তাই চীনে একটি কোম্পানির আমন্ত্রনে গেলেও শুধু ধারে কাছেরই নয়, দূর দূরান্তের সবই দেখে আসতে হবে, দেখে আসতে হবে যতটুকু পারা যায়। তাই আমি বাড়তি সময় হাতে নিয়েই ফিরতি টিকেটের ব্যবস্থা করতে বললাম। আর ছুটিছাঁটা নিয়ে কখনো আমাকে চিন্তা করতে হয়নি। দৈনিক আজাদীতে গত তেত্রিশ বছরে কোনদিন ছুটি নিয়ে কাউকে সমস্যায় পড়তে দেখিনি, আমাকেও পড়তে হয়নি। চিকিৎসা এবং বিদেশ ভ্রমণের ব্যাপারে আজাদীর ছুটি যেন উন্মুক্ত। আমি খুব অনায়াসে ১৫দিন চীন ভ্রমণের অনুমতি নিয়ে ফ্লাইটে উঠার অপেক্ষা করতে লাগলাম। (চলবে)।
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘কলেজিয়েটস’ : কেন এতো ভালোবাসি তারে
পরবর্তী নিবন্ধএক ব্যক্তি কোম্পানী