দুয়েকটির বিচারকাজ শুরু বাকিগুলো হিমাগারে

চট্টগ্রামে চাঞ্চল্যকর খুনের মামলা বছরের পর বছর ঝুলে আছে কেন

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৪৬ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে চাঞ্চল্যকর খুনের মামলাগুলো ঝুলে আছে বছরের পর বছর। এর মধ্যে দুয়েকটির বিচারকাজ শুরু হয়েছে। বাকিগুলো রয়ে গেছে হিমাগারে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ক্লু-লেস (সূত্রবিহীন) খুনের ঘটনাগুলোর তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে বারবার। অনেক খুনের ঘটনার রহস্য উন্মোচন দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে গেছে। আবার কিছু কিছু চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনায় প্রকৃত আসামিদের বাঁচানোর জন্য তদন্তের গতি কমিয়ে রহস্যের জালে আটকে দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো ঘটনায় খুনিরা এতই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও ধূর্ত যে, খুনের ঘটনা এমনভাবে ঘটানো হয়েছে, আসলেই ক্লু-লেস করে রাখা হয়েছে। এসব ক্লু-লেস খুনের ঘটনা তদন্তের এক পর্যায়ে এসে হাল ছেড়ে দিয়েছে তদন্ত কর্তৃপক্ষ। আবার এমনও হয়েছে, যিনি একটি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা তদন্ত করছেন তার কাঁধে আরও একটি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা চাপিয়ে দেয়ায় তদন্ত কর্মকর্তা আর কূল-কিনারা করতে পারছেন না বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি।

পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ক্লু-লেস মামলাগুলোর তদন্তে সময় বেশি লাগে। একটি ঘটনার তদন্তে একাধিক ইউনিট নিয়োজিত করতে হয়। সবসময়ই তদারকি করতে হয়। সঠিক দিক নির্দেশনার মাধ্যমে রহস্য উদঘাটন করতে হয়। কখনো কখনো এক জায়গার ঘটনার তদন্ত আরেক জায়গায় করতে হয়। বলতে গেলে ঘটনার রহস্য উদঘাটনে নানামুখী কৌশল প্রয়োগ করে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হয়। এসব কারণেই ক্লু-লেস মামলার তদন্তে বেশি সময় লাগে।

পুলিশ সদর দফতরের অপর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, খুনের মামলায় কোনো লিমিটেশন নেই। তবে মামলাগুলোর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ার কারণ তদন্ত কর্মকর্তারাই বলতে পারবেন। অনেক সময় এমন হয় যে, ঘটনা সত্য, কিন্তু সাক্ষী-প্রমাণ নেই। এটি তদন্ত কর্মকর্তারা চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে পারেন। তবে পরবর্তী সময়ে আবারও এসব তদন্ত পুনরুজ্জীবিত করা যায়। আর এই আশায় বুক বেঁধে বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর এই ভেবে যে, একদিন খুনের রহস্য উদঘাটন হবে, খুনি ধরা পড়বে, বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে খুনির শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।

এমনি একজন ছাত্রলীগ নেতা আলী মর্তুজা চৌধুরী। ২০০১ সালের ২৯ ডিসেম্বর নিজের গ্রামের বাড়ি হাটহাজারীর ফতেয়াবাদ ছড়ারকূল এলাকায় একটি সেলুনে দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন ছাত্রলীগ নেতা আলী মর্তুজা চৌধুরী। ওই সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ছিলেন তিনি। এই হত্যাকান্ডে ‘শিবির ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিত আটজনকে আসামি করে মামলা হয়েছিল। তবে ২০ বছর হতে চললেও এখনো শেষ হয়নি বিচারকাজ। মর্তুজার বাবা দেখে যেতে পারেননি ছেলে হত্যার বিচার। তবু আশা ছাড়েননি স্বজনেরা; একদিন বিচার শেষ হবে, শাস্তির আওতায় আসবে খুনিরা।

একই ভাবে আট বছর পেরিয়ে গেলেও চট্টগ্রাম নার্সিং কলেজের জ্যেষ্ঠ শিক্ষিকা অঞ্জলী রানী দেবী হত্যাকাণ্ডের রহস্যই এখন পর্যন্ত উদঘাটিত হয়নি। থানা, ডিবি ও পিবিআই ঘুরে বর্তমানে মামলা তদন্ত করছে ঢাকার এন্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। দীর্ঘ আট বছরেও হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছে অঞ্জলী রানীর পরিবার। ২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি নগরের পাঁচলাইশের তেলিপট্টি লেন এলাকায় দুর্বৃত্তরা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে তাকে। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। স্ত্রীকে হত্যার ঘটনায় একই দিন বিকালেই পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন স্বামী ডা. রাজেন্দ্র চৌধুরী।

মামলায় সন্দেভাজন কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। প্রথমে মামলাটি তদন্ত করে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। পরে তদন্ত শুরু করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবি পুলিশের নিষ্ফল তদন্ত শেষে তদন্ত ভার যায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্রোর হাতে। দুই বছরে তারাও অগ্রগতি করতে পারেনি। বর্তমানে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে মামলাটি ঢাকায় এন্টি টেররিজম ইউনিটকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অঞ্জলী রানীর স্বামী ডা. রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী আজাদীকে বলেন, দীর্ঘ আট বছরেও হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন না হওয়ায় আমরা হতাশ। আমার বয়স হয়েছে, কখন মারা যাই, ঠিক নেই। মৃত্যুর আগে হত্যাকারীদের দেখে যেতে চাই।

কাস্টমস কর্মচারী রিপন সিংয়ের পরিবারকেও অঞ্জলী রানীর ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে। নগরীর আসকার দীঘির পশ্চিম পাড়ে তাদের বাসা। বাবা ক্ষুদিরাম সিংহ বলেন, তিন ছেলে এক মেয়ের মধ্যে রিপন ছোট, সবার আদরের। তদন্ত যেভাবে চলছে, বিচার দূরে থাক, ছেলের খুনিদের দেখে যেতে পারেন কি না, সন্দিহান তিনি। থানা পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এই তিন সংস্থায় ঘুরপাক খাচ্ছে মামলার তদন্ত। চার বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো সংস্থাই রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি।

চট্টগ্রামের চাঞ্চল্যকর মিতু হত্যা মামলাটিও এখনো বিচারাধীন। ছয় বছর ধরে চলছে এর বিচার প্রক্রিয়া। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (প্রসিকিউশন) কামরুল ইসলাম বলেন, গত ১৩ সেপ্টেম্বর মিতু হত্যা মামলায় বাবুল আক্তারসহ ৭ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পিবিআই।

২০১৭ সালের ৬ অক্টোবর সকালে নগরীর সদরঘাট থানার দক্ষিণ নালাপাড়ার নিজ বাসার সামনে মহানগর ছাত্রলীগের সহসম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাসকে পিটিয়ে খুন করা হয়। এ ঘটনায় তার বাবা মেঘনাথ বিশ্বাস বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেছিলেন। হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছরের মাথায় এসে সুদীপ্ত বিশ্বাস খুনের মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা দিদারুল আলম মাসুমসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে আদালত। অভিযোগ গঠনের সময় দিদারুল আলম মাসুম সহ ২৩ জন আসামি হাজির ছিলেন। আবু জিহাদ সিদ্দিকী নামে এক আসামি অনুপস্থিত থাকায় আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। সুদীপ্ত বিশ্বাসের বাবা মেঘনাথ বিশ্বাস বলেন, অনেকদিন পর অভিযোগ গঠন হল। আসামিরা অনেক ক্ষমতাবান ও টাকাওয়ালা। আমি শিক্ষক মানুষ। আর্থিক অবস্থাও ভালো না। অনেক কষ্টে একজন উকিল দিয়েছি। আমি সবার সহযোহিতা চাই যেন ছেলে হত্যার বিচার পাই।

২০১৩ সালের ২৪ জুন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তর সিআরবি এলাকায় রেলের ৪৮ লাখ টাকার দরপত্র নিয়ে বাবর ও লিমনের অনুসারীদের বিরোধের জেরে গোলাগুলি হয়। সে সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সাজু পালিত (২৪) ও স্থানীয় সিআরবি বস্তির শিশু আরমান (৮)। এদের মধ্যে সাজু পালিত ছিলেন বাবরের অনুসারী। সিআরবিতে জোড়া খুনের এ মামলায় নয় বছর পর ৬৩ আসামির বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন আদালত। যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক উপ-অর্থ বিষয়ক সম্পাদক হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর এবং ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত নেতা সাইফুল ইসলাম লিমনও রয়েছেন অভিযুক্তদের তালিকায়। ৬৩ জনের প্রায় সবাই যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মী।

২০০৩ সালের ১৩ জুলাই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে চট্টগ্রামে অপহৃত হন ব্যবসায়ী জামালউদ্দিন চৌধুরী। অপহরণের পর তাকে হত্যা করা হয়। এই অপহরণ ও হত্যার অন্যতম খলনায়ক ছিলেন ফটিকছড়ি উপজেলার কাঞ্চননগর ইউনিয়নের এক সময়কার চেয়্যারম্যান আবুল কাশেম চৌধুরী ওরফে কাশেম চেয়ারম্যান। প্রায় ২০ বছর আগে চাঞ্চল্যকর ‘জামালউদ্দিন অপহরণ ও হত্যা মামলা’র ঘটনাটি অনেকেই হয়তো ভুলতে বসেছেন। তবে এরই মধ্যে কাশেম চেয়ারম্যান আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। আদালত তা নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে ‘জামালউদ্দিন অপহরণ ও হত্যা’ মামলাটি আবারো আলোচনায় এলো। এ ঘটনায় জামালউদ্দিনের ছেলে চৌধুরী ফরমান রেজা লিটন বাদী হয়ে নগরীর চান্দগাঁও থানায় মামলা করেছিলেন। মামলার সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী ফরিদ আহমেদ জানান, মামলায় মোট ৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। বাদীকে বারবার সমন দেয়ার পরও হাজির হচ্ছেন না। এজন্য সাক্ষ্যগ্রহণও এগোচ্ছে না। মামলার ১৪ আসামির মধ্যে এতদিন কারাগারে ছিলেন শুধু মো. আলমগীর নামে এক আসামি। এবার কাশেম চেয়ারম্যান কারাগারে গেলেন। বাকিরা জামিনে আছেন।

২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর রাতে বাঁশখালীতে মা-বাবাসহ বিমল শীলের পরিবারের ১১ সদস্যকে ঘরের মধ্যে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল ১৯ বছর আগে। স্বজন হত্যার বিচারের জন্য এত বছর ধরে আদালতে ঘুরছেন বেঁচে যাওয়া একমাত্র সদস্য বিমল। কিন্তু মামলার কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় হতাশ তিনি। সেই সঙ্গে আছেন সংশয়েও। বিমল তাই বলছিলেন, বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছি। জানা গেছে, তৃতীয় অতিরিক্ত চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটির বিচার চলছে। ৫৭ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। ৩৮ আসামির ৩৭ জনই জামিনে। বছরের পর বছর শুধু মামলার তারিখ পড়ছে। কিন্তু সাক্ষীরা হাজির হচ্ছেন না। মামলার খোঁজ নিতে নিতে ক্লান্ত বাদী বিমল শীল।

২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীকে হত্যার রহস্যজট ছয় বছরেও খোলেনি। এখনও মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্বজনরা। ঘটনার পর থেকে পরিবার ও তার অনুসারীরা দাবি করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন নির্মাণ কাজের দরপত্র নিয়ে কোন্দলের সূত্র ধরে পরিকল্পিতভাবে এই ঘটনা ঘটেছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সিআইডির চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আবদুস সালাম মিয়া বলেন, মামলাটি তদন্ত চলছে। কবে নাগাদ তদন্ত শেষ হবে তা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে তদন্তে অগ্রগতি আছে।

দিয়াজের বড় বোন জুবাঈদা ছরওয়ার চৌধুরী নিপা বলেন, গত ছয় বছর ধরে আমার ছোট ভাই দিয়াজ হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলাটির তদন্ত চলছে। কবে তদন্ত শেষ হবে তা তদন্ত সংস্থাও বলতে পারছে না। সিআইডিতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু মামলার অগ্রগতি হচ্ছে না।

এছাড়া কয়েক যুগ কেটে গেলেও ১৯৮১ সালে সিটি কলেজ ছাত্রসংসদের এজিএস তবারক হোসেন হত্যা মামলা এখন হিমাগারে। এছাড়া বহদ্দারহাটে এইট মার্ডার, এমইএস কলেজের পুলক বিশ্বাস হত্যা, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মেহেদি হাসান বাদল হত্যা, চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দীন সোহেল হত্যা মামলার মতো চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য চলছেই। কবে আসামিদের শাস্তি দেখবেন কিংবা আদৌ দেখবেন কিনা সে বিষয়ে হতাশায় ভুগছেন নিহতদের পরিবারের সদস্যরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে কার্যক্রম চালাতে হিমশিম
পরবর্তী নিবন্ধআমি তোদের ছাড়া বাঁচতে চাই না