দুর্নীতির শিকড় উৎপাটনে দুদকের ভূমিকা আরো শক্ত হোক

এম.এ. মাসুদ | সোমবার , ২৫ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:২৩ পূর্বাহ্ণ

২০১৯ সালের শেষার্ধে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের শুরু করা অভিযানে কতিপয় দুর্নীতিবাজ ধরা পড়েছিল এবং তাদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ ও সম্পদ উদ্ধার করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতি বিরোধী সেই অভিযান এখন স্থিমিত। দেশে যে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল একটি নূতন শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছে তা সাধারণ বোধ বুদ্ধি সম্পন্ন যে কোন মানুষই বুঝতে পারেন। শুধু মাত্র শহরে নয়, সারা দেশের উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে এই শ্রেণির মানুষের জীবন যাপনের চিত্র চোখে পড়ে। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ও স্বনির্ভর এই নূতন শ্রেণিটি কিন্তু অবৈধ পথের ধনী নয়। তাদের আর্থিক সচ্ছলতার পিছনে রয়েছে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের নিরলস প্রচেষ্টা ও সরকারের অনুসৃত জনবান্ধব আর্থিক নীতি। বিগত দিনের নিজেদের অসচ্ছল আর্থিক অবস্থার বিষয়টি স্মরণে থাকায় এই শ্রেণিটি তাদের দৈনন্দিন জীবানাচারে নিজেদেরকে যথাসম্ভব সংযত এবং পরিমিতির মধ্যে রাখেন। এই শ্রেণির সমান্তরালে দেশে আর একটি নূতন সম্পদশালী সম্প্রদায়ের উত্থান ঘটেছে। তাদের উত্থান বেআইনী, অনৈতিক ও ট্যাঙ ফাঁকি দেওয়া পথে। অতি অল্প সময়ে এরা এত বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন যে যা অত্যন্ত বিস্ময়কর। আলাদিনের চেরাগ ঘষেও এত সম্পদ-অর্থের মালিক হওয়া যাবে না। ২০২০-২০২১ সালে করোনা কালে যেখানে মানুষের জীবনের প্রশ্ন জড়িত সেখানে স্বাস্থ্য প্রশাসনের মদদে কতিপয় ব্যক্তি ভুয়া ডায়াগনষ্টিক সেন্টার খুলে করোনায় আতংকগ্রস্থ মানুষকে করোনা পরীক্ষার নামে জালিয়াতি করে ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এসকল মানুষরূপী জানোয়ারদের মধ্যে দু’একজন ধরা পড়েছে, কিন্তু বেশীর ভাগই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রী মহতি উদ্যোগ ‘আশ্রয়ন’ প্রকল্পের টাকা যারা চুরি করেছে তারা এবং করোনার ভুয়া রিপোর্ট প্রদানকারী ভুয়া ডায়গনস্টিক সেন্টারের সাথে সংশ্লিষ্টরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় লালিত।
অবিশ্বাস্য দ্রুততম সময়ে অঢেল অর্থ সম্পদের অধিকারী হয়ে ফুলে-ফেঁপে ওঠা এই শ্রেণির ব্যক্তিরা তাদের জৌলুসপূর্ণ বিলাসী জীবনাচার, উদ্ধত ও অহমিকাপূর্ণ আচরণে মানুষের কাছে সহজেই চিহ্নিত হয়ে যান। শর্টকাট পথে সম্পদের মালিক হওয়া এই শ্রেণির মধ্যে কেউ কেউ সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে জনদরদী হওয়ার প্রয়াসী হন। আবার কেউ কেউ স্কুল-মসজিদ-মাদ্রাসা ধরনের কিছু প্রতিষ্ঠা করেন। কেউ বছর বছর বিশাল আকারের মেজবানীর আয়োজন করে হাজার হাজার মানুষকে আপ্যায়ন করেন এবং তাদের কেউ ঘটা করে ঢাক-ঢোল পিটিয়ের ঈদের আগে জাকাতের টাকা-কাপড় বিতরণ করে জনগণকে তাদের বিত্ত-বৈভবের জানান দেন। আবার কেউ একাধিকবার হজ্ব পালন করে ধার্মিক সাজেন। এই শ্রেণির কিছু লোক ইউপি, উপজেলা এবং সংসদ নির্বাচনে লড়ার জন্য নগদ অর্থে, জনসমর্থন আছে এমন দলগুলোর মনোনয়ন কেনার চেষ্টায় থাকেন। মনোনয়ন কেনার প্রতিযোগিতায় কামিয়াবী হলে এবং নির্বাচনী লড়াইয়ে সফল হতে পারলে তারা আম জনতা তথা এদেশের বিশাল নীরব জনগোষ্ঠীর মাথার উপর ছড়ি ঘোরান। সমাজের অভিজাত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য এরা সফল না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন।
শেয়ার বাজার লুট করে যারা শূন্য থেকে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন, তাদের এই লুণ্ঠন-অর্জিত অর্থের প্রকৃত মালিক এদেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এসব মানুষ, যারা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন, তাদের পথে বসিয়ে কিছু দুর্বৃত্ত বিলাসী জীবন যাপন করছে। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা অর্থ হারিয়ে এই শ্রেণির মধ্যে আত্মহত্যার মত ঘটনাও ঘটেছে। সর্বসান্ত হওয়া এ সকল মানুষের জীবন যন্ত্রণা, তাদের অন্তরের গহীন থেকে নির্গত মর্মবেদনা আর অভিশাপের দীর্ঘশ্বাস শেয়ার বাজার লুটেরাদের একটুও বিচলিত করে না। শেয়ার বাজার লুট করে আখের গোছানো এই নব্য ধনীদের নাম পরিচয় সবারই জানা। ঋণ নেওয়ার ছদ্মাবরণের অন্তরালে যারা ব্যাংক ঝাঁঝরা করেছেন, সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংক লুণ্ঠন করেছেন এবং হলমার্ক-ডেসটিনি কেলেংকারীর সাথে যারা জড়িত, তাদের সবাই চেনেন। এতসব অপকর্ম করেও তারা অধরাই থেকে গেলেন। ইদানীং ই-কমার্সের নামে কোম্পানী খুলে নাগরিকদের প্রতারণার বেশ কয়েকটি ঘটনা জনসমক্ষে এসেছে। এসব অপকর্মের সাথে জড়িতরাও কিছু দিন জেলে থেকে বেরিয়ে এসে জনগণের কাছ থেকে লুণ্ঠিত অর্থে বাকী জীবন বিলাস-ব্যসনে কাটাবেন এতে কোন সন্দেহ নেই।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আমাদের প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন যে, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের উদ্দেশ্যে বলেছেন, মানুষের হক যারা আত্মসাৎ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। ২০১৯ সালের ৩০শে ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর কঠোর অবস্থানের কথা বলেছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার প্রধানের এই দৃঢ় অবস্থান দেশবাসীর মনে আশা জাগিয়েছে। জনগণ এখন ভাবছে যে, দুর্নীতি দমনে প্রধানমন্ত্রীর এই দৃঢ় প্রত্যয়ে উজ্জীবিত হয়ে দুর্নীতির শিকড় উৎপাটনে দুদক আরো বেশি সক্রিয় হবে। জনগণের প্রত্যাশা এই যে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ এবং বিবেক দ্বারা চালিত হয়ে দুদক এবং এ জাতীয় অন্যান্য সরকারী সংস্থা চূড়ান্ত সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করবে। মানুষ এটা ভেবে আশাবাদী হয়েছে যে, শেয়ার বাজার থেকে তাদের অর্থ লোপাটকারী দুর্বৃত্ত এবং ঋণের নামে ব্যাংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়া সাধুবেশী ‘সাগর চোর’দের আইনের আওতায় আনা হবে। দেশবাসীর প্রত্যাশা, দুর্নীতি দমন কমিশন কঠোর অবস্থানে থেকে দায়িত্ব পালনে অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে এবং এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দুদক দেশবাসীর কাছে তাদের গর্বের ও অনন্য গৌরবের জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মর্যাদায় অভিষিক্ত হবে।
আমাদের মধ্যে যারা ডাক্তার এবং যারা ডাক্তার নন এবং আমরা আম জনতারা সবাই জানি যে, গাঁজা, তামাক, পেনসিডিল, ইয়াবা, বিড়ি, সিগারেট, গুল, জর্দা, খৈনি, হেরোইন ইত্যাদি যারা সেবন করে তারা নির্দিষ্ট সময়ের আগে মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানায়। আমাদের পুলিশ, র‌্যাব, মাদক নিয়ন্ত্রণ দপ্তর – এসব বিভাগ মাদক নিয়ন্ত্রণ কাজে নিয়োজিত। এতগুলো বিভাগ মাদক নিয়ন্ত্রণ কাজে নিয়োজিত থাকার পরও দেশে মাদকের প্রবেশ এবং ব্যবহারের উপর দৃশ্যমান নিয়ন্ত্রণ পরিলক্ষিত হয় না। নিত্য নতুন ও অভিনব কৌশলে মাদক কারবারীরা দেশে মাদক নিয়ে ঢুকছে। কিছুদিন আগে কয়েকজন ক্যাসিনোর হোতাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাদের আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাদের জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু তারা জেল হাজতে না গিয়ে পুলিশ প্রহরায় দেশের উন্নতমানের হাসপাতলের কেবিনে আরাম আয়েশে অবস্থান করে। নাগরিক সমাজ জানতে চায় কেন এবং কিভাবে এটা সম্ভব? দুদক অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা করে, কিন্তু মামলা পরবর্তী ফলোআপের বিষয়ে করে অলসতা।
আমাদের দেশের পরিবেশের দেখভাল করার জন্য রয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। প্রকৃতির হাতে গড়া পরিবেশের ক্ষতি করার বা প্রাকৃতিক অবয়ব নষ্ট করার মত অপকর্মে যারা নিয়োজিত তারা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধী এবং দেশের আইন অনুযায়ী শাস্তি পেয়ে জেলেই তাদের ঠিকানা হওয়া উচিত। কিন্তু পাহাড়ের পর পাহাড় কেটে, বনভূমি উজাড় করে, সরকারী জমি দখল করে যে সব ভূমিদস্যু ভালো মানুষ সেজে, আইন কানুনকে কেয়ার না করে বহাল তবিয়তে সমাজে বিচরণ করছে তাদের কেন সাজা হয় না বা তারা কেন জেলে যায় না? দেশের প্রতিটি জেলায় নদী, খালের জায়গা দখল এবং এর দূষণ চলছেই। পাহাড় কাটার জন্য আদালত চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (সিডিএ) দশ কোটি টাকা জরিমানা করেছে। এই জরিমানার টাকা কি আদায় হয়েছে? যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দেয় না তাদের কেন পুনরায় ঋণ দেওয়া হয়? প্রতিবছর বন্যায় দেশের উপকূলীয় জেলা সমূহে নদী ও বেড়িবাঁধ ভাঙ্গে, বর্ষার পর আবার মেরামত বা নতুনভাবে তৈরী করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই ভাঙ্গা-গড়ায় সরকারে কোটি কোটি টাকা প্রতি বছর ব্যয় হয়। নবনির্মিত বেড়ীবাঁধ এক বছরের মধ্যে ভাঙ্গে কেন আর এই বাঁধ ও নদীভাঙ্গন মেরামতে সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচে লাভবান হচ্ছে কারা? টেকসই এবং দীর্ঘস্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য কি বিদেশী প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায় না? দুদক এবং অন্যান্য সরকারী সংস্থা নজর এদিকে আছে কি? পলিথিনের পরিবর্তে পাটের বহুমুখী ব্যবহার এবং দৃষ্টিনন্দন শপিং ব্যাগ তৈরীর মত সাধারণ প্রযুক্তিজ্ঞান কি আমাদের নেই?
মানুষ আশাবাদী হতে চায় যে, দুদকের তৎপরতার মাধ্যমে দেশে দুর্নীতির পরিমাণ অনেক কমে আসবে। যত বড় অর্থ-বিত্তের মালিকই হোক না কেন বা যত বড় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিই হোক না কেন দুদক তার কর্তব্য পালনে পিছপা হবে না এবং এসব দুর্নীতিগ্রস্তদের অকুতোভয়ে পাকড়াও করে আইনের কাছে সোপর্দ করবে। সরকার এ কাজে সার্বক্ষণিকভাবে দুদকের সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।
দেশবাসীর প্রত্যাশা দুদক কঠোর অবস্থানে থেকে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দেশের নাগরিকদের সম্ভ্রম আদায় করে নেবে। দেশবাসীর প্রত্যাশা দুদক পরিণত হবে সিবিআই বা এফবিআইয়ের মতো অপরাধ বিজ্ঞানে পারঙ্গম এবং অপরাধী ধরার বিষয়ে হবে চৌকষ। আমাদের দুদক হবে বাংলাদেশের অহংকার এবং অপরাধীদের জন্য হবে চরম আতংক। লেখক: সমাজকর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধধার্মিকেরা অন্য ধর্মের ক্ষতি করতে পারে না
পরবর্তী নিবন্ধস্মরণ : রফিকুল আনোয়ার