১৩ হাজার ১৯০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানসহ তিন পার্বত্য জেলা প্রায় ১৫ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত। সদর উপজেলাগুলোতে বিদ্যুৎ সুবিধা থাকলেও তিন পার্বত্য জেলার অধিকাংশ মানুষ এখনো বিদ্যুৎ সুবিধাবঞ্চিত। ব্যয়বহুল সোলার সিস্টেমের মাধ্যমে একটি অংশের মানুষ আলোকায়ন সুবিধা পেয়ে আসলেও নতুন করে বিদ্যুৎ সুবিধা সৃষ্টিসহ পাহাড়ে পুরাতন সরবরাহ ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। এজন্য প্রায় ৫৬৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পিডিবি। পিডিবি জানিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে পার্বত্য জেলাগুলোতে বিদ্যুতের গ্রাহক তৈরি হবে প্রায় পৌনে দুই লাখ। এতে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ২৭৯ মেগাওয়াট।
দুর্গম পাহাড়ের যেখানে মানুষের যাতায়াত দুরূহ, সেই পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে এখন বিদ্যুতের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (পিডিবি)। ১৮শ ফুট উঁচুর সাজেক ভ্যালিতেও পৌঁছে গেছে পিডিবির বিদ্যুৎ সুবিধা। শুধু সাজেক নয়, পার্বত্য অঞ্চলের তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে বাসিন্দাদের বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনার লক্ষ্যে বাস্তবায়নাধীন ‘তিনটি পার্বত্য জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্প’ শীর্ষক প্রকল্পটির ইতোমধ্যে ৮০ শতাংশ ভৌত অগ্রগতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ৫৬ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসবেন। ইতোমধ্যে প্রায় ১৫ হাজার নতুন গ্রাহক বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়েছেন। তবে এ প্রকল্পের পরেও পুরো পার্বত্য এলাকাকে বিদ্যুৎ সুবিধায় আনার জন্য নতুন আরো একটি প্রকল্প নেওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছে পিডিবি।
পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটন ও শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার অবকাঠামোগত উন্নয়ন করার লক্ষ্যে দুর্গম এলাকায় বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রকল্প নেয় পিডিবি। ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি প্রায় ৫৬৫ কোটি টাকার প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পটি প্রথম পর্যায়ে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। পরে প্রকল্প বাস্তবায়নে ভৌগলিক অবস্থানগত জটিলতার কারণে ইতোমধ্যে দুই দফা সময় বাড়ানো হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক পিডিবির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী উজ্জ্বল বড়ুয়া।
বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটিতে তিন পার্বত্য জেলায় ৩৩ কেভি সক্ষমতার ২৫২ কিলোমিটার, ১১ কেভি সক্ষমতার ৪৬৭ কিলোমিটার, ১১কেভি/৪৪০ ভোল্টের ২৩১ কিলোমিটার এবং ৪৪০ ভোল্টের ৩৬০ কিলোমিটার নতুন লাইন নির্মাণ করা হবে। তাছাড়া ৩৩ কেভি’র ৮২ কিলোমিটার, ১১ কেভি’র ৮৭ কিলোমিটার, ১১কেভি/৪৪০ ভোল্টের ৮৬ কিলোমিটার এবং ৪৪০ ভোল্টের ৯১ কিলোমিটার পুরোনো লাইন নবায়ন (সংস্কার) করা হচ্ছে। সবমিলিয়ে প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১৯শ কি.মি. নতুন লাইন স্থাপন করা হচ্ছে। এসব লাইনে ১৭৭টি থ্রি-ফেইজ ট্রান্সফরমার ও ১৪৭টি সিঙ্গেল-ফেইজ ট্রান্সফরমার স্থাপন করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় ৩৩/১১ কেভি’র ১২টি উপকেন্দ্র (সাব-স্টেশন) নির্মাণ এবং ৩৩/১১ কেভি’র পুরোনো ৪টি উপকেন্দ্রের ক্ষমতাও বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১১টি সাব স্টেশন চালু হয়েছে। অন্য সাব স্টেশনগুলোর কারিগরি কাজ চলমান রয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক পিডিবির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী উজ্জ্বল বড়ুয়া দৈনিক আজাদী বলেন, ‘প্রকল্পাটি বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়। বিদ্যুতের অবকাঠামো তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল পরিবহনে অনেক বেগ পেতে হয়। বিশেষ ভারি পোলগুলো (খুঁটি) পরিবহন করা খুবই কষ্টকর। যেসব পাহাড়ে মানুষ যেতে পারছে না, সেখানকার দুর্গম এলাকায় বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য লাইন তৈরি করছি। উঁচু নিঁচু এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে খুঁটি বসিয়ে লাইন তৈরি করতে হচ্ছে।’
প্রকল্প পরিচালক বলেন, তিন পার্বত্য উপজেলার ২৬ উপজেলার প্রত্যেকটি উপজেলায় প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পের আওতায় ২৬টি সাব স্টেশন নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। বিভিন্ন ভোল্টের ১৯শ কিলোমিটার লাইন তৈরি করা হচ্ছে। প্রকল্পের ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পটি শেষ হলে ৫৬ হাজার নতুন গ্রাহক তৈরি হবে। ইতোমধ্যে ১৫ হাজার গ্রাহক নতুন সংযোগ পেয়েছে।
তিনি বলেন, রাঙামাটির সাজেক, কাপ্তাই, রাজস্থলি, রাঙামাটি সদর, খাগড়াছড়ির তবলছড়ি, মানিকছড়ি, মাটিরাঙা, পানছড়ি, বাঘাইছড়ি, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, বান্দরবান, লামায় সাব স্টেশনগুলো বসেছে। ইতোমধ্যে ১১টি সাব স্টেশন চালু করা হয়েছে। প্রকল্পটির মাধ্যমে পুরো পাহাড়ে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হচ্ছে বলে জানালেন এ তড়িৎ প্রকৌশলী।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (বিতরণ) মো. সামছুল আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বিগত ১২ বছরে দেশ অভূতপূর্বভাবে এগিয়ে চলেছে। বিদ্যুৎ খাতের চিত্র আমূলে পাল্টে গেছে। একদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ছে, অন্যদিকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সাধারণ মানুষের দৌরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।’ তিনি বলেন, দেশের মোট আয়তনের এক দশমাংশ এলাকা হচ্ছে তিন পার্বত্য জেলায়। পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষগুলোকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনতে সরকার নিবিড়ভাবে কাজ করছে। এলক্ষ্যে তিন পার্বত্য জেলায় ৫৬৫ কোটি টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ওইসব এলাকায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটবে। নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠবে। এ বোর্ড সদস্য বলেন, আমি দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী থাকার সময়ে পার্বত্য জেলার দুর্গম উপজেলাগুলো ভিজিট করেছি। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও পাহাড়ের পুরো জনগোষ্ঠীকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা যাবে না। এর বাইরেও আরো প্রায় ৪০ হাজার পরিবার পিডিবির সেবার বাইরে থাকবে। সবাইকে পিডিবির বিদ্যুৎ সুবিধায় আনতে হলে আরো একটি প্রকল্পের প্রয়োজন হতে পারে।