দুটি অণু গল্প

রঞ্জনা ব্যানার্জী | শুক্রবার , ২৩ এপ্রিল, ২০২১ at ৭:২২ পূর্বাহ্ণ

সেই সময়
তখন আমাদের ফ্রক-পরা বয়স। আমরা মানে মিলি, দূরদানা, লোপা, ফারজানা, রূপা, লিনেট এবং আমি। তখন বিজয়ার ফুলকো-লুচি, লাবড়া কিংবা শবেবরাতের হালুয়া-রুটি ধর্মের বেড়া টপকে পৌঁছে যেত এবাড়ি-ওবাড়ি। লিনেটদের বাড়িতে মোরব্বা জড়ানো ক্রিস্টমাস-কেইক চেটেপুটে সাবাড় করতাম নিঃসংকোচে। তবে সুতপা দিদিরা আসার পরেই আমাদের জীবনের সেরা ঘটনাটি ঘটেছিল এবং সেবারই প্রথম বৌদ্ধমন্দিরে ফানুস ওড়ানো দেখেছিলাম আমরা।
বাড়ির লাগোয়া মাঠটাতেই খেলতাম আমরা। জানতাম কোথায় ঘাসে হাত ছোঁয়ালেই ফড়ফড়িয়ে উড়বে প্রজাপতি। আকাশে মেঘেদের গল্প খোঁজাও ছিল আমাদের প্রিয় খেলা। অথচ এই আকাশেই ক’দিন আগে গোত্তা মেরেছে বোমারু-বিমান। সেইসব ভয়ঙ্কর স্মৃতি আমরা ভুলেও মনে করতাম না। মাঠের পূব-কোণের বাড়িটার পাঁচিল পেরিয়ে লেবুফুলের গন্ধ ভেসে এলেই আমাদের মন কেমন করত। মাঠের ওদিকটায় যাওয়ার অনুমতি ছিল না আমাদের।
বাড়িটার আদি মালিক ছিলেন দেবেশ সেন। পঞ্চাশের দাঙ্গায়, সীতাকুণ্ড স্টেশনের সেই বর্বর হত্যাকাণ্ডে নিহত তীর্থযাত্রীদের মধ্যে দেবেশবাবুর স্ত্রী এবং কন্যাও ছিল। দেবেশবাবু দেশ ছেড়েছিলেন। বাড়িটার দখল নিয়েছিল অবাঙালি ইসহাক খান। আশ্চর্য কী বড়োরাও আমাদের মতোই এইসব ভয়ঙ্কর স্মৃতি এড়িয়ে যেত। কেবল ছোটো-মাছের চচ্চড়িতে কাঁচা লঙ্কা মেশাতে মেশাতে ঠাম্মা বলতেন, ‘ঐ বাড়ির দুইখানা লেবুপাতা দিলেই বুঝতা সোয়াদ কী!’
ইসহাক খানের সঙ্গে কারো খাইখাতির ছিল না। তাই যেদিন পাড়াতে মালপত্র বোঝাই ট্রাকটা থামল, সেদিনই জানা গেল বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেছে। এরা ভাড়াটে। নতুন মালিক অন্য শহরে থাকেন। আমরাও খেলা ছেড়ে ভিড়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ওদের। মায়ের গলা আঁকড়ে থাকা ফুটফুটে বাচ্চাটাকে দেখে আমাদের আর চোখ সরে না! কিন্তু আমাদের চেয়ে একটু উঁচু মেয়েটা যেই চোখ মেলাল অমনি লেবুগন্ধী হাওয়া উড়ে এসে জানিয়েছিল, এদিকে আসার অনুমতি নেই আমাদের। আমরা তক্ষুনি হাওয়ার বেগেই বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিলাম।
পরদিনই আমাদের মায়েরা সকল বৃত্তান্ত জেনে এসেছিল। আমরা গিয়েছিলাম আরও পরে। মেয়েটা ততদিনে আমাদের সুতপা দিদি। বাচ্চাটার নাম বিজয়, দেশ স্বাধীনের ঠিক চারদিন পরেই ওর জন্ম।
সেদিন পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখেছিলাম আমরা! চকমেলানো মেঝে। উঁচু সিলিং। পেছনের লেবুবাগানে পা দিয়েই আমরা থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। ডাল-পাতা জড়াজড়ি করে কী সুন্দর সামিয়ানা বানিয়েছে! হাওয়ায় ভাসছে সুবাস! ঠাম্মার জন্য দুটো পাতা চেয়ে নিয়েছিলাম আমি। পাতা হাতে দিতেই ঠাম্মার চশমার কাঁচ পেরিয়ে জল গড়াচ্ছিল।
অতঃপর এই লেবুতলাই আমাদের খেলাঘর বনে গিয়েছিল। দুপুরের রোদ্দুর কী সুন্দর আলোছায়ার সুজনী বুনতো! সেই আলিম্পনের নকশা ছেঁকেই আমরা গল্প শোনাতাম বিজয়কে…
আমাদের আনন্দময় দিনগুলো বেশিদিন টেকেনি। পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট কাকিমার চিৎকারে ঘুম ভেঙেছিল : ম্যাসিভ হার্টঅ্যাটাকে সুতপা দিদির বাবা নেই হয়ে গেছেন! আমরা তখনও জানি না, একই সময়ে রাজধানীতে পিতৃহন্তার কলঙ্কে হাত রাঙাচ্ছে জাতি।
ক’দিন পরেই বাড়িটা ফের হাতবদল হলো। এবার মাঠসহ। সুতপা দিদিরা চলে গেল।
এরপরে হাওয়াতে আর লেবুর সুবাস নয় বালি ভাসত এবং আমাদের দিকে পিঠ দিয়ে নির্মিত হলো এক বিশাল মার্কেট।
একসময় আমাদের চারপাশটাই বদলে গেল। বদলালাম আমরা; এমনকি সংবিধানও…

ঊনিশ বছর পর

সেই মর্মন্তুদ ঘটনার পরে প্রথম ক’বছর শোকে-ক্ষোভে দিনটিকে স্মরণ করত পুরুষ। পরে পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই-বাছাইয়ে খুঁজেছে গুঢ় কারণ। নথি ঘেঁটে নানা অনাচারে পার পাওয়া পুরুষদের শাস্তি নিশ্চিত করেছে। অতঃপর ভরা সভায় পুরুষ ঐকমত্যে পৌঁছেছে: নারীকে সে ‘মানুষ’ ভাবেনি কোনোকালে।
সেবারের বর্ষাও ছিল এমন বৃষ্টিময়। আকাশের বায়নাতেই ঘোর বরিষণ কিংবা রোদ্দুর। তবুও ছাতা নিতে ভুলত লোকজন। মেয়েটা সেইদিন ঐ গাছের নিচেই নেমেছিল বাস থেকে। ছুটে রাস্তা পার হয়েছিল। লিয়াকত তখন কেন্টিলিভার ঘেঁষে রিকশার অপেক্ষায়। মেয়েটা সিঁড়ি টপকাতেই ভিজে একশা। ওর ওড়না লেপ্টে ছিল বুকে। সব ক’টা চোখ ওকে চাখছিল। লিয়াকতের দিকেই এগিয়ে এল সে। ব্যাগ থেকে চিরকুট বার করে ভিজে হাতে বাড়িয়ে ধরেছিল ঠিকানা। দুটো গলি দু-ধারে, কোন গলিতে এই বাড়ি জানতে চাইল সহজ গলায়। কোণে দাঁড়ানো রতনের চোখে চোখ পড়েছিল লিয়াকতের । মহল্লার সব দোকান রতনকে চাঁদা দেয়। রিকশাটা যেন আশির্বাদ হয়ে উদয় হয়েছিল। ‘জানি না’, বলেই উঠে পড়েছিল রিকশায়। বুঝতে পারছিল হতভম্ভ মেয়েটা দেখছে ওকে। তিন দিন পরে মেয়েটার লাশ গন্ধ ছেড়েছিল রহমান সাহেবের পাতকুয়ায় ।
নারী-নির্যাতনের নানান সংবাদে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল মানুষ। সেই ভোরেও পত্রিকা জুড়ে ছিল ধর্ষণের খবর। বাড়ির পুরুষ বোঝেনি ঘুম ভাঙে-নি নয়, চিরঘুমে ঘুমায় কন্যা-জায়া-জননী সকল নারী!
ক্রমশ জ্ঞাত হলো- একই দিনে একই সময়ে নারীশূন্য হয়েছে বিশ্ব।
আজ সেই দিন। লিয়াকত আজ এই চায়ের দোকানে বসেই কাটাবে। এই শহরের পুরুষেরা কেউ আজ বাড়ি ফিরবে না। দোকানে ঠাঁই নেই কিন্তু চারপাশ বড় বেশি নিস্তব্ধ যেন বরফের নিচে জমে আছে মরা মাছ। হঠাৎ চোখ যায় অদূরে লাইটপোস্টের নিচে,কী আশ্চর্য! একটা একলা মেয়ে!
চোখ সরু করে ফের দেখে লিয়াকত। বৃষ্টির প্রকোপে মেয়েটাকে ঘষা কাঁচের ভেতর দেখার মতোই ঝাপসা লাগছে তবুও এই ঋজুতা লিয়াকতের ভীষণ চেনা। লিয়াকত বেরিয়ে আসে। ল্যাম্পপোস্টের তারে মুক্তোমালার মতো বৃষ্টির জল ঝুলছে; মেয়েটা সেদিকে তাকিয়ে হাসছে খিলখিল। সেই হাসি বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়ে সবার কানে পৌঁছে গেল কীভাবে যেন! দোকান ছেড়ে অন্যেরাও নেমে এলো বাইরে। অমনি মেয়েটা হাত ঘুরিয়ে নাচতে নাচতে এগোলো ওদের দিকে। ওর গায়ের রঙে মেঘলা আকাশ, পরনের পোশাক যেন জলের সবুজ। শরীরের বাঁক- ঈশ্বরের নিজ হাতে গড়া। মেয়েটার গা থেকে এক এক করে পোশাক খসে পড়ে। মেয়েটার শ্যামলা স্তন মোমের মসৃণতা নিয়ে আকাশমুখি হলে ঊনিশ বছর আগের মাতৃহারা যুবকেরা মায়ের জন্য বুক ভেঙে কাঁদে। মেয়েটার নাভিমূল থেকে চন্দন সুবাস পাক খেয়ে উঠে কন্যাহারা পিতাদের বুকে মাতম তোলে। ওর জঙ্ঘার ঘর্ষণে আগুনের ফুলকির জৌলুসে হারানো সঙ্গীর জন্য বুকের পাঁজর ভাঙে অনেকের। লিয়াকত হাত জোড় করে মিনতি করে, ‘ ক্ষমা কর। ফিরে এসো’-
মেয়েটা আনমনে ঘুরে ঘুরে নাচতেই থাকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগল্পে কল্পে সাইবার সিকিউরিটি
পরবর্তী নিবন্ধশঙ্খ ঘোষ : মৃত্যু হলেও সঙ্গে আছেন তিনি