একটি ডিঙি নৌকা।
মাঝনদীতে ভাসছিলো।
মৃদু বাতাসে নদীর বুকে যে তিরতির তরঙ্গ জাগে তার দোলায় দুলছিলো। একা।
চারিদিকে পূর্ণিমা থৈ থৈ। রাত্রি দ্বিপ্রহর।
ঘটনার সপ্তাহখানেক পর খবরটি পেলাম। মুঠোফোনে।
– ভাই, একরাম ভাইতো আর নাই।
– কী বলিস! ক্যামনে অইলো! কখন !
– গত বিষুদবার লাশ পাওয়া গেছে। তিনদিন ধইরা নিখুঁজ আছিলো।
সারাদিন বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে দিন কাটালাম। একটা উপন্যাসের প্রায় শেষদিকে আছি। সমাপ্তিটুকু এখন আর কিছুতেই গুছিয়ে লিখতে পারছি না। এদিকে প্রকাশক ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে।
গ্রামের আত্মীয়স্বজনের সাথে আমার তেমন যোগাযোগ নেই। বাপ দাদার একসময়ের সুনামের কারণে এখনো অনেকেই মাঝেমধ্যে ভালো মন্দ খবরাখবর নেয়। আদতে নেয়ার চেয়ে দেয় বেশি। ওদের ধারণা গ্রামের সবার ব্যাপারে শহরের মানুষের ভীষণ কৌতূহল। কার গরু চুরি গেল, কার মেয়ে কোন বাড়ির ছেলের সাথে পালালো, কার বাড়ির হাঁড়ির খবর কী… এসব তথ্য দিয়ে তারা অবস্থাপন্ন বাড়ির লোকেদের ঘনিষ্ট থাকতে চায়।
তবে আমার ব্যাপারটা ভিন্ন। বরং আমাকে নিয়েই ওদের ভীষণ কৌতূহল। কেননা ভুঁইয়া বাড়ির সবাই নানান পেশায় দেশের সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে গেলেও এক আমিই ওদের ভাষ্যে কিছু হতে পারলাম না।
“এসব ছাতাফাতা লিকে কিচু হয়!” – ওদের অবাক জিজ্ঞাসা আর আফসোস।
একরাম নেই– এই নিঠুর সত্য আমার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগলো। কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। উপন্যাসের শেষটা কেমন হবে ভাবতে বসলেই একরামের নানা স্মৃতি মনে ভীড় করে। কী করলো ও! শেষ পর্যন্ত মায়ের মতোই…
একরামের সাথে ঝোড়ে জঙ্গলে, নদীতে আলে–বিলে দৌড়–ঝাঁপের আশৈশব অভিজ্ঞতা আমার। বড় হতে হতে আমার অন্তর্জগত কিছুটা অন্তর্গত হয়ে গেলে সম্পর্কে ভাটা পড়েছিল কিছুটা তবে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়নি।
ভার্সিটিতে পড়ার সেই অস্থির দিনগুলোতে যখন রাজনীতি ও লেখালেখি মাথায় জেঁকে বসেছিল, সমাজ পরিবর্তনের ভূত মাথায় নিয়ে ডাক দিয়েছিলাম লড়াইয়ের, সেইসব শহর পালানো দিনগুলোতে একরামের কাছে ঠাঁই মিলেছিল।
কত কত রাত একরামের ডিঙি নৌকায় আমরা ভেসে বেড়িয়েছি ডাকাতিয়ার বুকে তার হিসেব নেই। ও–ই আমাকে চিনিয়েছে রাতের ডাকাতিয়া।
এ নদী দিয়ে একসময় মগ–ফিরিঙ্গি জলদস্যুরা নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলায় প্রবেশ করত এবং নদীতে ডাকাতি করত। ডাকাতের উৎপাতের কারণে এর নাম ডাকাতিয়া। আবার মুরুব্বিরা এ–ও বলে, এ নদীর করাল গ্রাসে দুই পাড়ের মানুষ সর্বস্ব হারাতো। জীবন বাঁচাতে এ–নদী পাড়ি দিতে গিয়ে বহু মানুষের হয়েছে সলিলসমাধি। ডাকাতের মতো সর্বগ্রাসী বলে এর এমন নাম।
ডাকাতিয়া আসলে বাংলাদেশ–ভারতের আন্তঃসীমান্ত একটি নদী। মেঘনার এ উপনদী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে কুমিল্লা জেলার বাগসারা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং পরবর্তীতে চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
ছোটবেলায় শেষবার মাকে দেখার সেই দৃশ্য সারাজীবন সে ভুলতে পারে নাই। পূর্ণিমায় আমরা যখন মাতাল হয়ে ডাকাতিয়ার খোলা বুকে ডিঙি ভাসাতাম,একরাম তখন হাউমাউ করে কাঁদতো আর বলতো, “আইচ্চা, মায়ের একটুও আমার কতা মনে অইলো না। মাসুম বাচ্চা রাইখা কুনো মা এমুন করতে পারে। একটু ধৈর্য ধরলেইতো আইজ মার পায়ে পিতিবির সব সুক আইন্না দিতাম। মায়ে ক্যান অপেক্ষা করলো না।”
আমি জবাব দিতাম না। এর জবাব হয় না। আমি রুশু ফুপুর মুখ মনে করার চেষ্টা করি। স্পষ্ট নয়। কেবল সকালে বাড়ির আঙিনার বেল গাছ থেকে শাড়ির আঁচল প্যাঁচানো জিহ্বা বের করা আলুথালু চুলের একটা মুখ ভেসে ওঠে। এ–ঘটনার কিছুদিন আগেই রুশু ফুপু তার একমাত্র সন্তানকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে এক কাপড়ে চলে এসেছিল।
একরামের পড়াশোনা হয়নি। তবে নানাবাড়িতে মানুষ হওয়া একরাম অন্য সব কাজেই ওস্তাদ ছিল। বাজার সদাই থেকে শুরু করে ক্ষেত–খামার, সবকিছুতেই ও বাড়িতে ও ছিল অপরিহার্য।
নানাবাড়ি ভাগাভাগি হয়ে গেলে পরে নিজের জমানো টাকা দিয়ে ডাকাতিয়ার লঞ্চঘাটে একটা হোটেল দেয়। নাম “জননী হোটেল”। লঞ্চঘাটে নাকি হোটেল ব্যবসা সবসময় জমজমাট থাকে।
মামারা আলাদা একটা ঘর তুলে দিয়েছিল ওকে। কিন্তু চেষ্টা করেও বিয়েটা করাতে পারেনি। মায়ের আত্মহনন শিশুবেলাতেই বিয়ে নিয়ে, নারী পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে ওর মনে ভীতি তৈরি করেছিলো।
জীবন যাপনের চাপে যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। তবে, মাস ছয়েক আগে কল দিয়েছিল। সেদিনই শেষ কথা আমাদের। বললো, বর্ষায় আহো। ডাকাতিয়ায় মাছ খলবল করে বর্ষায়। বাটামাছ খাওয়ামু তোমারে। রাঁধার পর প্যাটের দিকে কেমুন সুন্দর গোলাপি হয়া থাকে জানোইতো।
একরামের কথা শুনে আনমনা হয়ে পড়েছিলাম সেদিন। দীর্ঘসময় কথা বলেছিলাম। যেন কথা ভর করেছিল আমাদের মাঝে। জীবন নিয়ে, রোজকার সংগ্রাম নিয়ে। দু’ুজনের শ্রেণীব্যবধান আমাদের আলোচনায়, মেলামেশায় প্রভাব কোনদিনই ফেলেনি। বরং একরামের জীবনবোধ অন্য অনেক শিক্ষিতের চেয়ে শানিত মনে হতো। সেদিন সে বলেছিল “জীবন হইলো গিয়া ইঞ্জিন। এরে চালায়া নিতেও লাগে ফুয়েল। আর সেই ফুয়েল হইতাসে গিয়া তোমার রিপু। কাম–ক্রোধ–লোভ–মোহ–মদ–মাৎসর্য– এই ছয়জনারেই বশে আনতে গিয়া জীবন চলতে থাকে। চিন্তা কইরা দেখো, যার এইসব কিছুই নাই তার এই দেহ খাঁচার প্রতি কোন আকর্ষণ নাই। শত্রুও তোমারে লড়াইয়ের প্রেরণা দেয়। দেয় না?
সেদিন এমনকি খাতুনের কথাও উঠলো।
– খাতুন কেমন আছে। খোঁজখবর জানো কিছু?
খাতুনের কথা উঠলেই কিছুক্ষণ ও চুপ হয়ে যায়।
পাশের বাড়ির মেয়ে খাতুন। একরামের যাকে দেখলেই দম বন্ধ বন্ধ লাগে। আবার না দেখেও পারে না। বরং দেখার জন্য চোখ আঁতিপাতি করে খোঁজে।
একরাম তার প্রেমের কথা এমনভাবেই বলতো।
ওকে কতভাবেই না সাহস দিয়েছি, খাতুনকে মনের কথা বলার জন্য। কিন্তু তার সাহসে কুলোয়নি। কে বলবে প্রমত্ত ডাকাতিয়ার বুকে ভরা বর্ষায় এই একরামই একটা ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কত রকমের মাছ ধরে!
খাতুনের বিয়ের পর বাকী জীবনে সে আর কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। অদ্ভুত নিরাসক্তি নিয়ে নারীবিহীন জীবন কাটিয়ে দিলো।
তবে কি একরামের জীবনে লড়াইয়ের আর কিছু ছিলো না? রিপুরে সে পরাস্ত করতে পেরেছিলো না ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল এ–জীবনের ভার বইতে বইতে। নইলে মানুষ কী করে এমন অবলীলায় জীবন ভাসিয়ে দেয় ভরা পূর্ণিমায়.. বোধগম্য হয় না আমার।
ঘোরের মধ্যে আমি খাতা টেনে নতুন উপন্যাস লিখতে শুরু করি।