সরকারের আলোচিত অতিরিক্ত সচিব, চট্টগ্রামে বিনিয়োগ বোর্ডের সাবেক পরিচালক মাহবুব কবির মিলন এক ফেসবুক পোস্টে দুর্ঘটনার দায় নিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছেন। মাত্র এক ঘন্টায় এগার হাজারেরও বেশি মানুষ ফেসবুক পোস্টটিতে লাইক করেন এবং প্রায় হাজার খানেক মানুষ কমেন্ট করেন, শেয়ার করেন দুই শতাধিক মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সাদিয়ার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দেয়া ফেসবুক পোস্টটি নেট দুনিয়ায় ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে।
আমরা ফেসবুক পোস্টটি নিচে হুবহু তুলে ধরলাম : “ইউএনও হিসেবে প্রথম পোস্টিং পেলাম কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলায়। জয়েন করার পরই দেখলাম সদর বাজারের ভিতর দিয়ে যাওয়া মেইন রোড একেবারে খানাখন্দে ভর্তি। বর্ষায় এক হাঁটু কাদা আর পানি জমে থাকে। শুনলাম অনেক বছর যাবত এইভাবে পড়ে আছে বাজারের প্রধান যোগাযোগ সড়কটি। একেবারেই বেহাল দশা। একদিন চোখের সামনেই দেখলাম গর্তে   মোটরবাইক স্লিপ করে পড়ে বাচ্চাসহ এক পরিবার কাদা পানিতে সাঁতার কাটার অবস্থা।
রাতে শুতে গিয়ে মনে হল, আগে হয়নি, সেটা আমার দায় নয়, কিন্তু আমার সময়ে এই কয়েক লাখ লোকের ভালমন্দ, সুখ দুঃখ, হাসি কান্নার দায় তো আমার উপরই বর্তায়। আজ মোটরবাইক স্লিপ করে যে ওরা কষ্ট পেল, সেটার দায় তো আমার উপরেই আসে। আল্লাহপাকের কাছে জবাবদিহি তো আমাকে করতেই হবে।
জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী, সড়ক ও জনপথ সাহেবের সাথে কথা বললাম। তিনি জানালেন আলাদা বাজেট লাগবে। আলাপ করলাম বিভাগীয় অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এবং ঢাকাস্থ প্রধান প্রকৌশলী মহোদয়ের সাথে। আলাদা বাজেট গেল। উঁচু করে খুব সুন্দরভাবে হয়ে গেল রাজারহাট সদর বাজারের রাস্তা। অনেকদিন যাবত ঝুলে থাকা অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে গেল মাত্র সাড়ে চার মাসে। সারাক্ষণ মাথায় ঘুরত, এই কয়েক লাখ মানুষের দায় আমার মাথায়। ঘুম হত না রাতে।
এরপর পোস্টিং হল চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায়। সেখানে লোক সংখ্যা আরও অনেক বেশি। একদিন কয়েকবাড়িতে আগুন লাগার পর পরিদর্শনে গিয়ে দেখলাম, মানুষের মাতম। সব পুড়ে ছাই। অনেক পরে কালুরঘাট থেকে দমকলের গাড়ি আসল। শুনলাম পটিয়া বা কালুরঘাট থেকে দমকলের গাড়ি আসার আগেই এই উপজেলার বাড়িঘরের আগুন সব পুড়িয়ে নিভে যায়।
কালুরঘাট পটিয়া রোড থেকে উপজেলা সদর যাবার রাস্তা খুবই অপ্রশস্ত এবং রাস্তার সাইড ভেঙে এত নিচে নেমে গেছে যে, বাস ট্রাক প্রায়ই উল্টে পড়ে যায়। আবার চেপে বসল মাথায় সেই দায়, সেই দায়িত্ব। মানুষের হক আদায়ের বোঝা।
সদরে প্রবেশের সংযোগ সড়ক হল প্রায় ১০০ ফিট চওড়া। রাস্তা উঁচু হল। অল্প সময়েই তা করে ফেললাম। দমকলের অনুমোদনের জন্য কী করেছি, সেটার সাক্ষী তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব আবদুল করিম এবং ডিজি ফায়ার ব্রিগেড স্যার। বোয়ালখালীতে হল ফায়ার ব্রিগেড অফিস।
সারাক্ষণ তাড়া করে ফিরত দায়, দায়িত্ব এবং জনগণের হক আদায়ের আতংক এবং দুশ্চিন্তা। আল্লাহপাক ক্ষমা করুন আমায়।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষে এসে দায় আরও বেড়ে গেল। আমি যদি কাজে অবহেলা করি বা তথ্য গোপন করি, তবে সে খাবার খেয়ে দেশের একটি মানুষ অসুস্থ হলে, তার জন্য আল্লাহপাকের কাছে জবাবদিহি করতে হবে আমাকে। প্রায় সব খাদ্য পণ্যই পরীক্ষা করা হল। কোনো তথ্যই গোপন করিনি বা দায়িত্ব এড়িয়ে অন্যের কাঁধে চাপাইনি। শুরু হল আমার সমাধানের পথে যাত্রা, এর পরের অংশ ইতিহাস।
কর্তব্যে অবহেলা করা বা দায়িত্ব ছিল করার, সেটা না করা কিংবা অন্যের উপর চাপিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা অথবা সুখ নিদ্রা যাওয়ার জন্য কারো অসহায় মৃত্যু হলে বা কেউ কষ্ট পেলে বা কারো হক নষ্ট হলে, আমরা কেউই রেহাই পাব না। রেহাই মিলবে না যতোই রশি টানাটানি করি না কেন। একালে পিছলে বের হয়ে গেলেও অনন্ত পরকালে সবাইকেই ধরা খেতে হবে নিশ্চিত। হক নষ্টের ফল পেতেই হবে আমাদের। কথাগুলো বললাম আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। যাদের নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখি।
 
        
