দারিদ্র্য মোকাবিলায় সময়োপযোগী ও সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে হবে

| সোমবার , ১৭ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:১৯ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শহরের অর্ধেক পরিবারই দরিদ্র হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। আর, শহরের আট শতাংশ দরিদ্র মানুষ, কোনো ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পের সুবিধা পান না। ‘বাংলাদেশ সোশ্যাল প্রটেকশন পাবলিক এক্সপেনডিচার রিভিউ’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণ বাংলাদেশে দারিদ্র্যকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে পারে। এই সুরক্ষা কর্মসূচি বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন নীতির কেন্দ্রে রয়েছে এবং ক্রমাগত দরিদ্র পরিবারের উপকার করছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়, সুরক্ষা কর্মসূচির লক্ষ্যমাত্রা যথাযথভাবে গ্রহণ করা হলে এবং তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ৩৬ শতাংশ ১২ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব। প্রতিবেদনে বলা হয়, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো মূলত গ্রামাঞ্চলকেন্দ্রিক। তবে শহুরে জনসংখ্যার ৫ জনের মধ্যে ১ জন দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে এবং শহরের অর্ধেক পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। গ্রামীণ এবং শহর এলাকায় সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো পুনর্বিন্যাসের তাগিদ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, শহরে ১৯ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে থাকলেও তাদের মধ্যে ১১ শতাংশ সামাজিক সুরক্ষার আওতায় রয়েছে। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে ২৬ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে থাকলেও সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আছে ৩৬ শতাংশ মানুষ। অর্থাৎ গ্রামে দারিদ্র্য হারের চেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ২ দশমিক ৬ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তা বা সুরক্ষা কর্মসূচিতে ব্যয় হয়েছে; যা এই ধরনের আয়ের দেশগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে, কিছু ঝুঁকি-গোষ্ঠী এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশেষ করে সামপ্রতিক বছরগুলোতে এই কর্মসূচিগুলোতে দরিদ্র তরুণ ও প্রাপ্তবয়স্কদের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রতি আট জন দরিদ্র ব্যক্তির মধ্যে একজন শিশু রয়েছে। এরপরেও দরিদ্র শিশুরা সামাজিক সুরক্ষা ব্যয়ের মাত্র ১ দশমিক ৬ শতাংশ পায়। এই ব্যয় আরো কার্যকর হবে, যদি বরাদ্দগুলো বিভিন্ন স্তরের দরিদ্রদের মাঝে ভাগ করে দেয়া যায় এবং সেভাবেই কর্মসূচিগুলো হাতে নিতে হবে।’
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত অন্য এক প্রতিবেদনে জানা যায়, মহামারীর আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু মহামারীতে বহু মানুষ বেকার হয়ে পড়ায় এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ শতাংশে। অর্থাৎ দেশে বর্তমানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ৭৯ লাখ। এর মধ্যে মহামারীতে গত এক বছরে নতুন দরিদ্র হয়েছে প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ। এ অবস্থায় দারিদ্র্য বিমোচনে নতুন করে প্রণোদনা দেবে সরকার, যা আগামী অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে আমাদের দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলের পুনর্বিন্যাস করার সময় এসেছে। নগর দারিদ্র্যকে উপেক্ষার সুযোগও আর নেই। সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন নীতির অগ্রাধিকারেও পরিবর্তন আনতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহরের দারিদ্র্য কমাতে হলে অবিলম্বে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী শুধু বাড়ানো নয়, তাতে অভিনবত্ব আনতে হবে। একই সঙ্গে উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রমও জোরদার করতে হবে। সনাতনী চিন্তা ও গতানুগতিক দারিদ্র্য কৌশল থেকে তাদের বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।
বলা বাহুল্য, দারিদ্র্য বিমোচন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের গত ৫০ বছরের অন্যতম বড় কার্যক্রম। বাংলাদেশের নিজস্ব কিছু দারিদ্র্য দূরীকরণের মডেল আছে, যা বিশ্বে প্রশংসা পেয়েছে এবং কোনো কোনোটি তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশে অনুকরণীয়ও। বাংলাদেশের সমুদয় দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির মৌলিক ভিত্তি হচ্ছে ড. আখতার হামিদের কুমিল্লা মডেলের চার স্তর। দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি হিসেবে বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করেছে শিক্ষা উপবৃত্তি, কাজের বিনিময়ে খাদ্য, বার্ধক্য ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং (ভিজিএফ) কর্মসূচি, মাতৃত্বকালীন ভাতা, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ ভাতা শিক্ষা উপবৃত্তি ও প্রশিক্ষণ, ক্যানসার, কিডনি ও লিভার সিরোসিস রোগীদের সহায়তা, চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি, জন্মনিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কার্যক্রম। কিন্তু গ্রামীণ কিংবা নগর দারিদ্র্য রোধে এই কার্যক্রমের সব কটির প্রভাব দৃশ্যমান নয়। ভাতাগুলোর পরিমাণ আর্থিক মূল্যে নিতান্তই সামান্য এবং প্রার্থী নির্বাচন প্রক্রিয়া মহাদুর্নীতিগ্রস্ত বলে সামাজিক সুরক্ষা খাতের বহু কর্মসূচি মিলেও দারিদ্র্য বিমোচনে টেকসই সাফল্য আনা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, করোনাসৃষ্ট দারিদ্র্য মোকাবিলায় সামাজিক সুরক্ষায় বিরাজমান ঘাটতিগুলোও দূর করা প্রয়োজন। নতুন মাত্রাগুলো চিহ্নিত করে সময়োপযোগী, সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বাড়াতে হবে নগদ সহায়তা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে