দশচক্রে ভগবান ভূত

মু. সিকান্দার খান | রবিবার , ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১১:১৫ পূর্বাহ্ণ

একসময় ছিল যখন রাতের গভীরে চুরি করার কৌশল ছিল সিঁধ কেটে ঘরে ধুকে যাবতীয় মালামাল নিয়ে রাত থাকতেই গা ঢাকা দেয়া। এরকমটি ছিল বিস্তীর্ণ গ্রাম বাংলায়। শহরে দিনের বেলায় চুরি সেরে ফেলত অনেক বেশি বুদ্ধিমান চটপটে ভদ্রবেশী চোররা। এরা বুদ্ধির জোরে গৃহস্থকে প্রায় বোকা বানিয়ে রেখে ঘরের মূল্যবান সামগ্রী গুছিয়ে নিয়ে সাধারণের সঙ্গে মিশে যেতে পারদর্শী ছিল। একটু বৃষ্টিভেজা খানিক অন্ধকার দিন এরকম চুরির জন্য আদর্শ মৌসুম। সেরকমই এক ডাকসাইটে চোর আলকরণ এলাকার জানে আলম চোরা। সে এরকম চটপট চুরি করার জন্য পরিচিত সারা চট্টগ্রাম শহরে।
সেবার আমাদের মুসলিম হাই স্কুল আঙিনার মধ্যে অবস্থিত অ্যাসেম্বলি হল সংলগ্ন গ্রীন রুমের কক্ষক’টিতে সাময়িক আশ্রয় নিয়েছিলেন এখানে বদলি হয়ে আসা আমাদের এক শিক্ষক পরিবার। উপযুক্ত বাড়ির খোঁজ পেলে একসময় সেখানে উঠে যাবেন এমনটিই ছিল পরিকল্পনা। নতুন জায়গায় এসেছেন। এখানকার শহরের রীতিনীতি কিছুই তাদের জানা নেই। এই নতুন শহরে থিতু হওয়ার আগেই তাঁর ঘরের দিকে চোখ পড়ে জানে আলম চোরার। প্রথমবারে সে বসার ঘর থেকে সব নিয়ে গেছে, কেউ কিছু বুঝার আগেই। এরকম মাঝে মাঝেই এই বাসায় হানা দিতে শুরু করে সে।
এমন একদিন। সকাল এগারোটায় ঐ বাসার দিক থেকে “চোর, চোর” শোর উঠে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন কক্ষ থেকে ক্লাশ ছেড়ে ছাত্ররা স্যারের বাসার দিকে ছুট দেয়। কিন্তু, কোথাও কাউকে পাওয়া গেলনা। স্কুলের এক পিয়ন বলল যে চোর তখনও পালাতে পারেনি। পিছনের ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
আমাদের স্কুলের এদিকটা খুব জঙ্গলাকীর্ণ। এটা একটা ঢালু জায়গা, ক্রমাগত নিচের দিকে নেমে সংলগ্ন চট্টগ্রাম জেলের রাস্তায় গিয়ে শেষ হয়েছে। এদিকে আমরা কখনও যেতামনা। ঘন কাঁটাবন গোটা এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, তাই স্কুলের সীমানা দেয়ালও এদিকে ছিল না। দিনের বেলা সন্দেহভাজন কেউ এখানে লুকিয়ে থাকলে ঠাহর করা সম্ভব না। সকলের অনুমান, অনেকটা নিশ্চিত অনুমান, যে চোর পালাতে পারেনি, এই কাঁটাবনে লুকিয়ে আছে। সিদ্ধান্ত হলো সবাই ক্লাসে ফিরে যাবো। কয়েকজন শুধু পাহারায় থাকবে। আমাদের মধ্যে উঁচু ক্লাশের অপেক্ষাকৃত স্বাস্থ্যবান কয়েকজন এবং দুজন পিয়নকে জায়গা মত পাহারায় বসিয়ে সবাই ফিরে গেলাম। স্কুল যথারীতি শুরু হয়ে গেল। চতুর্থ পিরিয়ডের ঘণ্টা বাজলে শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক পরিবর্তন হলো। সবকিছু এমন স্বাভাবিকভাবে চলতে শুরু করল যে একটু আগেও এখানে এতো হইচই হয়েছে তা বুঝবার উপায় নেই। আমাদের মন কিন্তু চোর ধরার যে ফাঁদ বসানো আছে সেদিকে পড়ে আছে। কখন একটা হাকডাক শোনা যায়! বেশি সময় লাগল না। এই চতুর্থ ঘণ্টায় ক্লাস শিক্ষকের পড়া দেয়া-নেয়ার চেয়েও অনেক বেশি মনোযোগ ঐদিকে, কখন একটা শব্দ শোনা যায় সবাই উৎকর্ণ হয়ে আছি। ক্লাশের মাঝামাঝি সময়ে অতি প্রতীক্ষিত সেই শব্দ “চোর ধরা পড়েছে” কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে দুই তলা বিল্ডিং এর সব কক্ষ থেকে হুড়মুড় করে আমরা কয়েকশো মানুষ নিচে নেমে এলাম। সিঁড়িতে আমাদের কতজন যে আছড়ে পড়েছিল মনে নাই। সবার পুরো মন জুড়ে শুধু চোর দেখার ব্যস্ততা।
স্কুলের পেছন থেকে ধরে আনা হয়েছে চোরকে। তখন সেই পেছনের স্বল্প পরিসর জায়গায় দাঁড়ানো অবস্থায় দেখলাম। এর মধ্যে যারা ধরে নিয়ে এসেছে তাদের হাতে একবার তার দলাই-মলাই হবার চিহ্ন সারা দেহ জুড়ে। খালিগায়ে বেশ বড়সড় গড়নের মানুষ। মুখে চোখে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আছে। কোন কথা নেই। ছোট ছোট ছেলেদের চড়-থাপ্পড় যেন তার তেমন গায়ে লাগছে না। এরমধ্যে জটলা ভেদ করে শিক্ষকদের কয়েকজন কাছাকাছি পৌঁছেছেন। তারাও হাত ছুঁড়ে যেন মারতে উদ্যত। কিছুক্ষণ পর সে জটলা থেকে আমাদের হেড মৌলভি সাহেবকে নিয়ে দুজন বেরিয়ে এল। বারোয়ারি মারামারিতে তিনিও অংশ নিয়েছেন। দুর্ভাগ্যবশত কারও যেন মুষ্টি চোরের গায়ে না পড়ে তাঁর ডান হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুলের ডগায় লেগে আঙ্গুলটি বিগড়ে যায়। সাথে সাথেই কঁকিয়ে উঠলেন। পরে শুনেছি আঙ্গুলের আঘাতটি বেশ বেশি। নানা জায়গায় এরকম আঘাতে প্রায় সবাই কমবেশি আহত। আমি গ্রামে বড় হয়েছি। সেখানে “হাতের লাঠি, পথের কিল” এমন একটা প্রবচন চালু আছে। প্রায় হাটবারে দু’একজন পকেটমার ধরা পড়ে। হাটে কিছু মানুষ যায় এইরকম পকেটমার ধরা পড়ার আশায়। দু’ঘা দিয়ে নিজের বাহাদুরি জাহির করার জন্য। আবার অনেকের শুনেছি এই সুযোগের জন্য হাত-পা নিশপিশ করে। তারা এই কাজটি নিয়মিত করে বলে অন্যের কিল-ঘুষি ফসকে গিয়ে তাদের গায়ে লাগেনা। কিন্তু, অনিয়মিতদের নিজের আঙ্গুল কিংবা আঙ্গুলের গিরা সারাবার জন্য ডাক্তার বৈদ্যের শরণাপন্ন হতেও দেখেছি। তবুও এ আশায় তাদের হাটে পকেটমার ধরার উৎসাহ বেড়েছে বৈ কমেনি। সুযোগ পেলেই নিজের প্রজাতিকে আঘাত করার এই প্রবৃত্তি মানুষের মতো অন্য কোন পশুর মধ্যে এতটা প্রবল বলে মনে হয় না। বরং কাক-পক্ষীদের কেউ বিপন্ন হলে দলবেঁধে তার জন্য আহাজারি করতেই দেখেছি।
যাহোক, শাস্তি দানের প্রথম পর্ব শেষ হলে চোরকে উপরতলায় হেড স্যারের পাশের ছোট কামরায় নিয়ে গেল পিয়নরা ধরাধরি করে। তার হাত পা শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে কামরার এক পাশে বসিয়ে রাখা হলো। আমরা সবাই সারিবদ্ধ হয়ে একবার তাকে এ অবস্থায় দেখে এলাম। জানলাম, সিদ্ধান্ত হয়েছে দুপুর ছুটির পর তাকে থানার লোক ডেকে হস্তান্তর করা হবে। এর মধ্যে তাকে হালকা কিছু খাবার দিলেন হেডস্যারের পিয়ন। সে তখন পিয়নকে অনুরোধ করল এ অবস্থায় তাঁকে ওদের হাতে তুলে না দিয়ে তার বাসা থেকে কিছু জামাকাপড় এনে একটু ভদ্রস্থ করে তখন থানাকে খবর দিতে। তার এ মিনতি সবাই আহ্লাদ বলে নাকচ করে দিল। তার কোনো কথাই আর শোনা হলোনা।
মুসলিম হাই স্কুলের সীমানা সংলগ্ন চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানা। খবর পেয়ে থানার বড় দারোগা দুজন কনস্টেবলসহ চোর নিয়ে যাওয়ার জন্য এলেন। পরে পিয়নদের মুখে যা শুনেছি তা নিম্নরূপ-
হেডস্যারকে সালাম দিয়ে রুমে ঢুকে মেঝেতে উপবিষ্ট চোরকে দেখে দারোগা সাহেবের চক্ষু চড়কগাছ। তিনি হন্তদন্ত হয়ে চোরকে পুলিশি স্যালুট দিয়ে চোরকে আমতা আমতা করে বললেন, “এটা কি করে হলো স্যার?” সঙ্গী কনস্টেবল দু’জন দারোগা সাহেবের আদেশ মত চোরের বাঁধন খুলে দিয়ে তাকে প্রকৃতস্থ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দারোগা হেডস্যারকে বললেন, “ইনি তো আমাদের চট্টগ্রাম জেলের হেডজেলার সাহেব। তার কেন এ অবস্থা, কোথাও একটা বিরাট ভুল হয়ে গেছে।” সব তত্ত্বতালাশ নিয়ে তারা একমত হলেন, যা ঘটেছে তা নিম্নরূপ-
স্কুলের পক্ষে যারা চোর ধরার জন্য ঝোপে অবস্থান নিয়েছিল তারা একসময় দেখতে পায় যে পুকুরের কাছাকাছি ঝোপের মধ্যে একটি বিরাট মাথা একবার একটু উঁচু হয়ে আবার তার মধ্যে ডুবে যায়। এরকম দু-তিনবার একই দৃশ্য দেখে তারা স্থির নিশ্চিত হয় যে এটি জানে আলম চোরা ছাড়া আর কেউ হতে পাড়ে না! তারা চারদিক ঘিরে ঝোপ থেকে তাকে বন্দী করে ফেলে। ব্যাপার কি হচ্ছে বুঝে উঠার সুযোগ না দিয়ে তাকে পিটাতে পিটাতে স্কুলে নিয়ে আসে।
তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম জেলার হেডজেলার। জেল রোডের অপর পাড়ে জেলখানা। সেখানে তার বাসস্থানও। সেদিন গোসল করার জন্য তিনি পুকুরে এসেছিলেন। সাবান, গামছা, গেঞ্জি খুলে রেখে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য পাশের ঝোপের মধ্যে বসেছিলেন। এরমধ্যে আমাদের স্কুল থেকে চোরকে তাড়া করে আমরা অনেকজন ছেলে ঝোপের চারদিক ঘিরে ফেলি। পরে কয়েকজনকে পাহারায় রেখে অপেক্ষাকৃত ছোটছেলেরা ক্লাশে চলে যাই। এই লোক লজ্জায় বাথরুম সেরে সবাই চলে গেলে তখন বের হবেন আশা করে বসেছিলেন। চারদিকে চুপচাপ হয়ে গেলে তিনি বের হবার জন্য বাইরের উপস্থিতি বোঝার চেষ্টায় মাথা বের করে এদিক ওদিক কয়েকবার উঁকি-ঝুঁকি দিয়েছেন। আর যায় কোথায়? আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা স্থির নিশ্চিত হয়ে তাঁকে ধরে ফেলে। চট্টগ্রাম জেলখানার হেডজেলার দশচক্রে হয়ে যান আলকরণ এর জানে আলম চোরা! যারা তাকে পাকড়াও করেছে তারা হেডজেলারকে চেনে না, জানে আলম চোরাকেও কোনদিন চোখে দেখেনি, শুধু বাঁশি শুনেছে।
লেখক : উপাচার্য, ইস্টডেল্টা ইউনিভার্সিটি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধশুভ দৃষ্টিতে