দরদীর কবর

সাদিয়া সুলতানা | শুক্রবার , ১৮ নভেম্বর, ২০২২ at ৪:৫৬ পূর্বাহ্ণ

কবরটা চোখের সামনে ভেসে উঠে আবার পলকে নাই হয়ে যায়; যেন উড়ন্ত গালিচায় করে মুহূর্তেই আসমানের শেষ স্তরে চলে যায়, আবার একই গতিতে পূর্বস্থানে ফিরে আসে। কবরের এমন আসা-যাওয়া দেখে দরদীর ভয় করে, ভীষণ ভয় করে।
এখানে ঢোকার পর অদ্ভুতভাবে বৃষ্টির শব্দ বন্ধ হয়ে গেছে। আসমানে গড়াগড়ি খাওয়া মেঘ কোথায় পৌঁছেছে কে জানে। নাকি পুরু অন্ধকার ভেদ করে মেঘ-বৃষ্টির রূপালি তরল ওকে আর্দ্র করতে পারছে না? এখানে যখন ঢুকেছিল দরদী তখন তো বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টিভেজা শাড়িটা খুলে ফেলে কেউ একজন ওর শরীরে প্রবেশ করেছিল। এদের জন্য শরীরে প্রবেশের পথ এক নাকি একাধিক, নিজের শরীর নিজে স্পর্শ করতে পারে না বলে বুঝতেও পারে না দরদী।
আলোহীন ঘরের অভ্যন্তরে দিন এলে নিজেকে নির্মম এক দুর্দশার ভেতরে আবিষ্কার করে দরদী। এই মুহূর্তে ‘নির্মম’ শব্দটাকে যতোটা নিঙড়ানো হলে এর অর্থের প্রকটতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ঠিক ততোটা নির্মমতা ঘিরে আছে ওকে। দরদী ওপরের মাড়ি দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে ধরে, তারপর ঘোলা দৃষ্টিতে দেখে নির্মমতার ব্যঞ্জনা।
ওর চারদিকে মানুষের সারি সাজানো। বিভিন্ন ভঙ্গিতে শুয়ে বসে আছে তারা। বস্ত্রহীন, বস্ত্র পরিহিতা মানুষগুলোর শারীরিক অবয়ব জানান দিচ্ছে তারা নারী। যেখানে কেউ শুয়ে কিংবা বসে নেই, মেঝের সেইসব শূন্য অংশে কিছু না কিছু আছে। পচা গলা মাংসের টুকরা, চাকা চাকা রক্তের ছোপছাপ, চামড়ার শুকিয়ে যাওয়া বিচ্ছিন্ন অংশ, থকথকে বমি, শরীরের গন্ধযুক্ত তরল বর্জ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মানুষের খুলি বিচ্ছিন্ন চুলের গোছাও আছে। আর দরদীর মতো কোনো মানুষ যখন তার হাতের অদূরে নিজের বিচ্ছিন্ন চুলের জটা আবিষ্কার করে ঠিক তখন যেন দুর্দশা শব্দটিও প্রবলভাবে অর্থবোধক হয়ে ওঠে।
দরদী টের পায় মাথা ভার হয়ে আছে। শূন্যতা কিংবা চিন্তার ভার নেই এখন। ব্যথার ভার। দরদী বাম হাত টেনে ওর নিম্নাঙ্গে রাখে। এখানে বোধ নেই কোনো, শরীর বিচ্ছিন্ন আবুকে কোথায় রেখেছে ওরা? কোথায় খুঁজবে? কী দিয়ে খুঁজবে? সাড়হীন শরীরের একমাত্র সচল অঙ্গ এই হাতটাই বুঝতে বুঝতে অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। মেঝেতে হাত রেখে আবুকে খোঁজে দরদী। নেই, কোথাও নেই। হাত ছাড়া হয়ে গেছে আবু, কোল ছাড়া হয়ে গেছে।
মাটির শয্যায় ক্রমশ দরদীর শরীর মিশে যায়। নিজেকে এক খণ্ড মাংসপিণ্ড ছাড়া কিছুই মনে হয় না। মুখ ছুঁয়ে গ্রীবায় হাত রাখে দরদী, ঠিক কোথায় ব্যথা করছে বুঝতে পারছে না। ক্রমে ওর হাত বুকে নেমে আসে। ডান স্তনবৃন্তটা খুঁজে পায় না দরদী, তার বদলে রক্তের নরম দলা লাগে হাতে। আঙুলের স্পর্শ পেয়ে বৃন্তহীন স্তনের মুখ খুলে যায়, ফকফকা সাদা দুধের বদলে টকটকা লাল তরল ঝরে।
ব্যথার অনুভূতি ফিরে আসায় দরদীর মনে পড়ে যায় ও কোথায় এসেছে, কবে এসেছে। এভাবেই শুয়ে থাকবে নাকি উঠবে? উঠবে কী করে? দু’হাতের কনুই ভর দিয়ে মাথা জাগাবে? না কোমর তুলবে আগে? এত ভেবেও কিছুই করে না দরদী। চোখ মেলে সামনে তাকায়। এমন চিৎ হয়ে থাকা দেহের ওপরে কেবল আকাশের মতো ছাদটাই লটকে থাকে। রক্তভেজা চোখ বলে কিনা কে জানে ছাদটাকে লাল কমলার মিশেলে অদ্ভুতুড়ে চেহারার মনে হয়। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না দরদী। চোখের পাতা বন্ধ করে শুনতে পায় শিয়ালেরা ডাকছে। আসন্ন অন্ধকারকে স্বাগত জানাতে ক্রমেই ওদের ডাক জোরালো হতে থাকে।
অন্ধকার পেয়ে গায়ের ওপর পোকারা এমনভাবে ঘুরে বেড়ায় যে ক্ষণিকের জন্য ভ্রম জাগে-ও কবরে শুয়ে আছে। কবর ওর পিছু ছাড়েনি। উড়তে উড়তে মিলিটারি ক্যাম্পের নিশ্ছিদ্র গহ্বরেও ঢুকে পড়েছে।
পাকিস্তানি মিলিটারি দেখার সাধ ছিল দরদীর। শুনেছিল, উঁচা, লম্বা মানুষগুলোর গায়ের রঙ ধবধবা ফর্সা। কিন্তু অন্ধকারে ওদের শরীরের জোর বোঝা গেলেও গায়ের রঙ বোঝা যায়নি। পাকিস্তানি সৈন্য হায়দার, শমসের বাঙালি রাজাকার মইন, কাদের-কারও সঙ্গে কারও কোনো পার্থক্যই নেই।
আচমকা দরদীর মুখের ভেতরে দুর্গন্ধযুক্ত কিছু একটা ঢুকে যায়। জিনিসটা কী বুঝে উঠতে না উঠতেই আঁঠালো তরলে ওর মুখ ভরে ওঠে। ঘাড়ের কাছে কেউ একজন বিকট শব্দে হাসে, কথা বলে। ভিনদেশী ভাষার ধারালো শব্দগুলো দরদীর কানের পর্দা ছিদ্র করে দেয়, ‘বেসুয়া বাঙালি আওরত!’
আবার উঠতে চেষ্ট করে দরদী। তলপেটে বিদঘুটে এক যন্ত্রণা ঘাই মারে। দরদী কোঁকায়, কাঁদে। ওর মনে হয়, নিম্নাঙ্গ পচে গেছে। শরীর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে হাত-পা। মাথাটাই শুধু দেহের সঙ্গে আটকে আছে কোনোরকম তাই ব্যথার অনুভূতিটা আছে এখনো। কী করবে ও এখন? গলা ছেড়ে ডাকবে? ‘বাঁচাও…বাঁচাও!’
শরীর নিঙড়ানো যন্ত্রণা এবার কণ্ঠনালীতে পৌঁছায়। আকুল হয়ে কাঁদতেও পারে না দরদী। টের পায় ঘরে পুনরায় ঢুকেছে কেউ। দরদীকে টেনে-হিঁচড়ে টান টান করে সে ওর ব্যথার ভেতরে ঢুকে যায়। মানুষ কিংবা অন্য কোনো প্রাণীটা ওর শরীর ছেড়ে বেরিয়ে গেলে দরদী টের পায় ব্যথার বোধ লুপ্ত হচ্ছে ক্রমশ। ঘুম নামছে চোখে। দুটো পেটফোলা ডাঁই এসে চোখের পাতার ভার পরখ করছে। কালো ভারি পাপড়ি আলতো করে কেঁপে উঠতেই একটা ডাঁই প্রতিশোধপরায়ন হয়ে ওঠে।
ঘুম পুরোপুরি আসেনি, যায়নিও। ডাঁইয়ের বিষে দরদী কাঁপে পুনর্বার। নিজের হাতদুটো খোঁজে। হাত দুটো কোথায় মনে পড়তেই হাতের আঙুল জড়িয়ে থাকা মাংসের দলাটার কথা মনে পড়ে।
আবার আসে কেউ…আবার…
অন্ধকার আগলে বসে থাকে একদল শেয়াল। নিয়মিত বিরতিতে জানান দেয়, কাল রাত নেমেছে। দরদী শ্বাস নিতে চায়। পারে না। হাওয়ার বদলে নাকের ছিদ্রপথ দিয়ে হুড়মুড়িয়ে পানির স্রোত ঢুকে যায়। এ পানি নাকি রক্ত-বুঝে উঠতে চায় দরদী। ঠোঁট-নাকের সন্ধিপথ স্পর্শ করবে ভেবে চোখ মেলে দুহাত খোঁজে। আচমকা অন্ধকার অতিক্রম করে এক রাশ আলো হামলে পড়ে। হাতের বদলে এবার নিজের অর্ধচন্দ্রাকার উলঙ্গ শরীর খুঁজে পায় দরদী। ঠিক তখনই কবরটাকে নিজের দেহ বরাবর ভাসতে দেখে দরদী। উড়ুক্কু কবরটাকে নাগালের মধ্যে দেখেও এখন আর ওর ভয় করে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফের হুঁশিয়ারি দিয়ে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল উত্তর কোরিয়া
পরবর্তী নিবন্ধঅনিদ্রার অনত কারুকাজঅ