‘আমরা চাই বিশ্ব সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বাংলা সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশ’ এই শ্লোগানে উদ্ভুদ্ধ হয়ে এগিয়ে চলেছে ত্রিতরঙ্গের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। ত্রিতরঙ্গ বিশ্বাস করে দেশপ্রেম শুধু কথায়, কবিতায়, নাটকে বা গানে নয়; কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। তাই ত্রিতরঙ্গের সদস্যদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সেবামূলক কাজেও অংশ নিতে হয়।
১৯৮৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি কবি শাওন পান্থ প্রতিষ্ঠা করেন ত্রিতরঙ্গ। বর্তমানে তিনি মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সূচনায় ত্রিতরঙ্গ বলতে শাওন পান্থ, বোরহান উদ্দিন ও মাদার লিজা এই তিনটি মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠতো। দেশের প্রথিতযশা কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সংগঠক ও সমাজসেবীরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত থেকে সংগঠনকে গতিশীল রেখেছেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আজিজুর রহমান আজিজ সংগঠনের উপদেষ্টা এবং কবি লিয়াকত হোসেন বড়ভূঁইয়া সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। কবি জামাল হোসেন, শাহীন আক্তার, কবি কমরে আলম, মানবতাকর্মী আমিনা রহমান, অধ্যাপিকা ফাতেমা জেবুন্নেসা, শিল্পী সুবর্ণা রহমান, শহিদুল ইসলাম বিপ্লবের মতো নিবেদিত প্রাণ সংস্কৃতি কর্মীরা প্রাণবন্ত রেখেছেন ত্রিতরঙ্গের আঙিনা।
কবি শাওন পান্থ বলেন, ত্রিতরঙ্গের প্রধান লক্ষ্য তিনটি: ভিক্ষাবৃত্তি দূর, নিরক্ষরতা অপসারণ এবং সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক বিকাশ। শিক্ষা বিস্তারে গণশিক্ষা কেন্দ্র, পথশিশু স্কুল, ত্রিতরঙ্গ শিশু নিকেতন, অনন্ত মোহনা, সৃষ্টি ধারা এবং ত্রিতরঙ্গ শিশুমেলা স্কুলের মাধ্যমে সংগঠনটি সৃষ্টি লগ্ন থেকে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে কাজ করছে। অসহায় ও বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন, বিভিন্ন উৎসবে তাদের জন্য খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়। করোনা মহামারীতে ত্রিতরঙ্গ নিম্নবিত্ত মানুষের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণের পাশাপাশি অসচ্ছ্বল সংস্কৃতি কর্মীদের গোপন টোকেনের মাধ্যমে খাদ্যসামগ্রী এবং নগদ অর্থ প্রদান করেছে। করোনাকালে সংগঠনের মৃত সদস্যদের পরিবারের পাশেও দাঁড়িয়েছে ত্রিতরঙ্গ। দেশের বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ত্রিতরঙ্গের শাখা রয়েছে।
১৯৯৬ সালে সংগঠনের যুগপূর্তি উপলক্ষে কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান, কবি শামসুর রাহমান, শিল্পী আব্দুল লতিফ, নাট্যকার মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী (রনবী) ও সমাজসেবী জোবায়দা হান্নানকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। একই মঞ্চে ১৫০ জন কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সমাজসেবী ও সংগঠককে সম্মাননা প্রদান করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এখন পর্যন্ত তিন শতাধিক গুণীজনকে সংবর্ধনা এবং সম্মাননা প্রদান করেছে ত্রিতরঙ্গ।
ত্রিতরঙ্গ তিন যুগ ধরে সেবা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে মুখর রেখেছে। লোক উৎসব, বাউল উৎসব, নাট্যোৎসব, আবৃত্তি উৎসব, হাসন উৎসব, লালন উৎসব আয়োজনের পাশাপাশি রমেশ শীল, বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম, শচীন দেববর্মণসহ বিভিন্ন গুণী মানুষের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। ‘ত্রিতরঙ্গ স্বাধীনতা মঞ্চ’ ত্রিতরঙ্গের একটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে গণজাগরণ মঞ্চে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ত্রিতরঙ্গ। এ ছাড়া বর্ষবরণ, ঋতুভিত্তিক উৎসব, বিভিন্ন জাতীয় দিবস, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী ও প্রয়াণ দিবস, বিশিষ্ট কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের নিয়ে নিয়মিত অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে এই গংগঠন। প্রতিভা বিকাশের লক্ষ্যে সংগঠনের শিল্পী ও স্থানীয় শিল্পী সাহিত্যিকদের নিয়ে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান। ত্রিতরঙ্গের জনপ্রিয় একটি অনুষ্ঠান শ্রুতি কাব্য নৃত্য নাট্য জসীমউদ্দীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’।
ত্রিতরঙ্গ নাট্যদল মঞ্চায়িত নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা, ক্ষতবিক্ষত, ইদানিং শুভ বিবাহ, প্রেম প্রেম, এই রোদ এই বৃষ্টি, স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, বর্ণচোরা, এখন দুঃসময়, তৃতীয় পুরুষ, বটতলা যুদ্ধ, প্রজন্মের স্বাধীনতা, হিজলতলী, হইতে সাবধান, কেনারাম বেচারাম, বিবি পাঠশালা, কবিকাহিনী, সোনার হরিণ, বৈকুন্ঠের খাতা, পাগলি ইসাবেলা ও কাক এবং কৃষ্ণবিবর। বর্ণচোরা নাটকটি বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রে প্রথম মঞ্চনাটক হিসেবে পরিবেশিত হয়েছে। বাংলাদেশ বেতারেও ত্রিতরঙ্গের ১১টি নাটক প্রচারিত হয়েছে।
ত্রিতরঙ্গ নিয়মিতভাবে মুখপত্র ‘তরঙ্গ’, সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা ‘অর্ণব’, কবিতাপত্র ‘সায়ক’ প্রকাশ করে থাকে। ছায়াবৃক্ষ হয়ে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে সতেজ রাখতে চায় ত্রিতরঙ্গ; চায় বিশ্ব সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বাংলা সংস্কৃতির গৌরবময় পূর্ণ বিকাশ।











