তুষারধসের মুখোমুখি

বাবর আলী | সোমবার , ২২ আগস্ট, ২০২২ at ৮:৪৬ পূর্বাহ্ণ

পর্ব-৪

পরের সকালটাও আগের দুটো দিনের পুনরাবৃত্তি। ঘুম থেকে উঠেই বুঝে ফেলা আজও উপরের ক্যাম্পে যাওয়া হচ্ছে না। বিরামহীন তুষারপাত চলছে তো চলছেই। ক্ষণে ক্ষণে মনে হচ্ছে, আমরা সবাই মাঝসমুদ্রে অচল হওয়া জাহাজের যাত্রী। সামনে এগোনোর উপায় নেই, ফেরার পথও বন্ধ। আগের দুই দিনে তাঁবুর উপর জমা হওয়া তুষার ভেতর থেকে বজ্রমুষ্টি দিয়ে পরিষ্কার করতে হচ্ছিল ঘন্টাখানেক পর পর। আজ থেকে সেটা আধা ঘন্টা পর পর করতে হচ্ছে। দুপুর নাগাদ তাঁবুর বারান্দার মতো অংশে যেখানটায় ব্যাকপ্যাক ছিল, সেটার পোল ভেঙে গেল তুষারের ভার সইতে না পারায়। ব্যাকপ্যাকগুলোকে আরেক দফা সরিয়ে রাখতে হলো। বিকেল নাগাদ উনো খেলাতে নিরাসক্ত ভাব চলে এলো সবার মাঝে। নানান গল্পগুজব শেষমেশ গিয়ে ঠেকল আদি ও অকৃত্রিম নারী সংক্রান্ত আলোচনায়! এ বিষয়ে অন্যদের চেয়ে যোজন-যোজন এগিয়ে রয়েছে জিতু আর আইয়ুব। হরমোনের তাড়না এই দুজনের খুব বেশি কিনা! তানভীর ভাই জিতুকে চেনা এক নারীর নাম স্মরণ করিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল সেটাই জিতুর প্রথম প্রেম কি না। জিতু খানিকটা কূটনীতির ধার ঘেঁষে জোরালো গলায় উত্তর দিল, ‘আমার প্রথম প্রেম কি না বলা মুশকিল। তবে ওর জীবনে যা কিছু প্রথম, সব আমার সাথে!’ আইয়ুবকে মোট কতখানা প্রেম করেছে সেটা জিজ্ঞেস করতেই দুই হাতের সবকয়টা আঙুলের কড় একবার করে গুনতে দেখে জিতু পাশ থেকে ফোঁড়ন কাটল, ‘ওইভাবে গুনে তুই পোষাতে পারবি না। এর চেয়ে বরং নিজের শরীরের সবকয়টা লোম গুনে সঠিক সংখ্যাটা বল।‘ এই দুই ব্যাটার প্রেমের দুর্ভোগ সেই কৈশোর থেকেই সঙ্গী। প্রেম ওদেরকে তাড়া করে। দলের সবচেয়ে বয়োজ্যোষ্ঠ সদস্য মনির ভাইকে এবার পাকড়াও করা হলো এই বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা বলতে। উনি খানিকটা কেশে বললেন, ‘বুড়ো দাদুকে কাশির কথা স্মরণ করিয়ে দিও না তোমরা!’ তানভীর ভাই পাশ থেকে গলা খাঁকারি দিয়ে মনির ভাইকে খোঁচা দিয়ে বলল, ‘তাজা মাছের ভিড়ে বুইড়ার শুঁটকির গল্প শুনে কাজ নেই!’ এইসব আলোচনায় আমি নীরব থাকি। এতসব ভোগীদের ভিড়ে আমি একমাত্র যোগী! কিন্তু অন্ধ হলে তো আর প্রলয় বন্ধ থাকে না। জিতু আর আইয়ুবকে কেন্দ্র করে প্রেমের তাণ্ডবলীলার কাহিনি চলতেই লাগল!
এতসব হইহুল্লোড়ের মাঝে মিনিট পনের-কুড়ি বাদে বজ্রমুষ্টি দিয়ে তাঁবুর উপরের তুষার ঝাড়া চলছিল। মাঝে একবার শাবল দিয়ে তাঁবুর পাশের তুষারও ঝাড়া হলো। সেদিনের রাতটা এলো প্রচন্ড বিভীষিকা নিয়ে। রাত বাড়ার সাথে সাথে বুঝতে পারলাম তুষারপাত আগের চেয়েও তীব্র। শেষ রাতে জিতু ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙাল। জানাল ওর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। দেখলাম আধ্মরা মাছের মতো খাবি খাচ্ছে ও। আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম। ব্যাকপ্যাক হাতড়ে সবেধন নীলমণির মতো সালবিউটামল, মন্টিলুকাস্ট জাতীয় ওষুধ খুঁজতে লাগলাম। তাঁবুর বাইরের দিকে চোখ যেতেই শিউরে উঠার পালা। তাঁবুর অর্ধেকটা ডুবে যেতে বসেছে তুষারে। জিতুর শ্বাসকষ্টের কারণ এই অর্ধেক ডুবে যাওয়া তাঁবু। তাড়াতাড়ি উঠে তাঁবুর দরজা খুলে দিতে যেতেইও বাধা পড়ল। বাইরের দিকের দরজাও তুষারের কারণে খোলা যাচ্ছে না। তাঁবুর চেইন ধারণ করেছে পাথরের ন্যায় কাঠিন্য। এক রাতের মধ্যে এই পরিমাণ তুষারপাতে অবাক হয়ে গেলাম। আর কিছুক্ষণ এভাবে চললে তাঁবুর মধ্যেই কবর হয়ে যাবে আমাদের! তৎক্ষণাৎ জিতুকে ওষুধ খাইয়ে বাকিদের ডেকে তুললাম। সবাই লেগে গেল বজ্রমুষ্টি দিয়ে তাঁবুর বাইরে থেকে তুষার সরাতে। দরজার দিকটাতে আইস এক্স দিয়ে গুঁতিয়ে হাওয়া চলাচলের কিছুটা ব্যবস্থা করতেই জিতু খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে এলো। এর কিছুক্ষণ বাদে আইয়ুব জানাল, ওরও শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে। প্রচন্ড ঠান্ডাও লাগছে ওর। লোকে কী আর সাধে বলে, ‘হিট হার্টস, কোল্ড কিলস।’ ওকেও ওষুধপত্র দিয়ে বেশ কসরত করে দরজার সামনের তুষারের স্তূপটাকে ঠেলে তানভীর ভাই আর আমি স্নো বুট পরে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আইস এক্স আর শাবলটা নিয়ে কাজে নেমে পড়লাম। তাঁবুর উপরের আর পাশের তুষার সরিয়ে একে বাসযোগ্য করে তোলাই আপাত লক্ষ্য।
ততক্ষণে বাইরে আলো ফুটেছে। একটুখানি তাঁবু আর তার চারপাশ পরিষ্কার করতেই আধা ঘন্টার বেশি সময় লেগে গেল। ভেতরে আইয়ুবও ততক্ষণে বেশ ধাতস্থ। নিজেদের তাঁবুর আশপাশ থেকে তুষার সরিয়ে সবে শেরপাদের তাঁবুর দিকে দু’পা এগিয়েছি। উপর থেকে আসা বজ্রগম্ভীর শব্দ শুনে পিলে চমকে গেল। চোখ তুলে তাকিয়ে হাঁ হয়ে গেলাম। দুদ্দাড় শব্দে নেমে আসছে প্রকান্ড এক এভালাঞ্চ (তুষারধস)। যাত্রাপথের সবকিছুকে সমূলে উৎপাটন করার লক্ষ্যে প্রবল আক্রোশে নিচে নামছে তুষারের এই প্রকান্ড গোলা। বিকট দর্শন এমন কিছুর মুখোমুখি সর্বশেষ কবে হয়েছি মনে পড়ে না। পাশে দাঁড়ানো তানভীর ভাইয়ের বিস্ময়সূচক দৃষ্টিও এড়াল না। একবারের জন্য ভাবলাম দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যাই। পর মুহূর্তেই অবশ্য সে-চিন্তা ঝেড়ে ফেললাম। কোথায়-ই বা যাব এখান থেকে? অবশ্য ঘটনার বিহ্বলতায় পা দুটো যেন তুষারে আটকে গেছে। মনে মনে প্রার্থনা করছি আমাদের তাঁবুগুলো যেন এর গতিপথে না পড়ে। সেটা হলে আর রক্ষা নেই। দুই তাঁবুতে থাকা বাকি ছয়জন বেরোবার সুযোগই পাবে না। মুহূর্তেও মধ্যেই আমাদের তাঁবুর ফুট বিশেক দূর দিয়ে বিকট শব্দে নিচের দিকে নেমে গেল এভালাঞ্চটি। অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে ধেয়ে এলো আরো একটি এভালাঞ্চ। প্রথমটি থেকে আরেকটু বামে এর গতিপথ। আমাদের আওয়াজ শুনেই পাশের তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলো করণ। উপরে চোখ যেতেই ওর মুখ থেকে নেপালি প্রার্থনা ছিটকে বেরিয়ে এলো। এই তুষারধসটিও আগেরটির পথ প্রায় অনুসরণ করে আমাদের পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। ভাগ্যক্রমে এবারও বেঁচে গেলাম আমরা। করণের দিকে দৃষ্টি পড়তেই দেখি, ওর চোখে আতঙ্ক। উপরের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে বলল, ‘আভি সামান প্যাক করো। ইহাপর ঔর এক সেকেন্ড ভে নেহি। ঔর ঠেহরেঙ্গে তো সব লোক মর যায়েঙ্গে (এক্ষুণি সব মালপত্র গোছাও। এইখানে আর এক সেকেন্ডও নয়। আর কিছুক্ষণ থাকলে সবাই মারা পড়ব)।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধমেরিন ইঞ্জিনিয়ার
পরবর্তী নিবন্ধগোমদন্ডী পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে স্মরণ সভা