তুষারধসের মুখোমুখি

বাবর আলী | সোমবার , ৪ জুলাই, ২০২২ at ৯:১২ পূর্বাহ্ণ

পর্ব- ২
নেমে আসা গ্লেসিয়ারটার ডান দিকে পৌঁছে খানিকটা বাঁক নিতে হলো এবারে। এক দিকে খাড়া বরফের দেয়াল, অন্য দিকে খাড়া খাদ। জায়গায় জায়গায় আইস প্যাচ মিলছে প্রচুর। খানিক এগিয়েই গ্লেসিয়ার। পাহাড়ের চড়াই বাড়ল, চলার গতি হলো আরেকটু মন্থর। পাথরের বদলে এবার অতিক্রম করতে হবে স্নো আর আইস। পেছনে ফিরে দেখলাম আমাদের শেরপা বন্ধুরাও রওনা দিয়ে উঠে আসছে অনেকটা। তবে ওরা এগোচ্ছে খানিকটা বাম দিক ঘেঁষে। ওদিকের পথের দুর্গমতা কম হলেও দূরত্বটা বেশি। পিঠে ভারী বোঝা নিয়ে কম চড়াইয়ের রাস্তাটাই ওরা পছন্দ করেছে। সদ্য পড়া তুষারের মাঝখান থেকে মাঝেমাঝেই যেন চোখ মেলে তাকাচ্ছে নানান সাইজের বোল্ডার। দূর থেকে দেখলে মনে হয় শ্বেত সমুদ্রে অসংখ্য কুমিরের চোখ ভাসছে। বেস ক্যাম্পে বসে এতদিন দেখতাম এই সময়ে সূর্যের মৃদু হলদে আলোয় চারপাশ উদ্ভাসিত হয়ে যেত। আজ বিষণ্ন আকাশে সবকিছুই যেন আলো-আঁধারিময়। তুষারে স্নো বুটের হালকা মচমচ শব্দ আর নিজেদের তপ্ত নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই চরাচরে। নিজেদের গতিতেই ধীরে ধীরে সম্মুখ পানে চলছি।
সামনেই অনামী পর্বতটার পাথুরে দেয়াল দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। এর উপরে উঠতে পারলেই মিলবে চূড়ার উপরে উঠার রাস্তা। যদিও আমরা আজ ক্যাম্প করব পাথুরে দেয়ালটার নিচে। এই খাড়া দেয়াল বেয়ে পরদিন ক্যাম্প দুইয়ে যাবার পরিকল্পনা। প্রতি পদক্ষেপের সাথে সাথে অনামী চূড়াটার সাথে আমাদের দূরত্ব কমে আসছে- নিজেদেরকে এই মোহনীয় শিখরটার আরেকটু কাছাকাছি আবিষ্কার করছি। এগারোটা নাগাদ ছোট্ট একটা গ্লেসিয়াল লেক পেলাম। লেকের উপরের অংশে তখনো হালকা জমাট বাঁধা বরফ। পানির বোতল থেকে কয়েক চুমুক পানি খেয়ে ওখানেই খানিক বিশ্রাম। বাকিরা কিছুটা পিছিয়ে। তার উপরে সামনেই ছোট্ট একটা ক্রেভাস (তুষারের ফাটল) দেখা যাচ্ছে। সবাই একসাথে এলে তবেই ওটা পার হব। মিনিট পনেরোর মধ্যে সবাই সমবেত হতেই আবার চলা শুরু। প্রস্থে ক্রেভাসটা ছোট হওয়ায় তেমন কোন অসুবিধা ছাড়াই পার হলাম। পর্বতে যে দুটো জিনিসকে সবসময় সমীহ করতে হয় তার মধ্যে এভালাঞ্চ (তুষারধস) ও ক্রেভাস (তুষারের ফাটল) অন্যতম। পরের আধ ঘন্টায় আরো একটা ক্রেভাস পড়ল পথে। ওটার আকার-আয়তন প্রথমটার চেয়ে বড়। পাশ ঘেঁষে জমাট বরফের অংশ থাকায় ওদিকটাতেই পার হলাম।
বেলা একটা নাগাদ সাদা তুষারের মাঝে মাথা বের করে রাখা একটা লাল পতাকা দেখে বুঝে নিলাম পৌঁছে গেছি আজকের গন্তব্য এক নম্বর ক্যাম্পে। খানিকটা দূরে থাকা করণও ইশারা করে ওখানেই থামতে বলে দিল। বাকিরা এবার একে একে আসতে শুরু করল। শেরপারা আসার আগেই দলের সবাইকে আইস এক্স দিয়ে হালকা তুষারের আবরণটা সরিয়ে শক্ত বরফ বের করতে বললাম- শেরপা বন্ধুরা এলেই যাতে সাথে সাথে তাঁবুটা পিচ করে ফেলা যায়। লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে সবাই কিছুটা হলেও ক্লান্ত। মানবদেহকে কাবু করে ফেলতে পারে যে তিনটা জিনিস, সেই ক্ষুধা, পিপাসা ও ক্লান্তিতে সবাই কিছুটা হলেও বেকায়দায়। তাও হাত লাগাল। শেরপারা যে মাত্র তাঁবুগুলো খুলতে শুরু করেছে, হঠাৎ করেই শুরু হয়ে গেল তুষারপাত। হালকা পেঁজা তুলার মতো পড়তে থাকা তুষার খানিকক্ষণের মধ্যেই রূপ নিল ভারী তুষারপাতে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বোঁচকাসমেত তাঁবুতে জাঁকিয়ে বসলাম। তাঁবু পাতা হয়েছে দুটো। চারজনের তাঁবু এগুলো। ‘যদিও হও দুর্জন, এক তাঁবুতে চারজন’ তত্ত্ব মেনে জিতু, তানভীর ভাই, আইয়ুব আর আমি এক তাঁবুতে। অন্য তাঁবুতে দুই শেরপা আর কুকের সাথে আমাদের দলের সবচেয়ে বয়োজ্যোষ্ঠ সদস্য মনির ভাই। সব নাক ডাকার ওস্তাদেরা এক তাঁবুর নিচে। তবে উনো খেলার লোভে ব্যাকপ্যাকটা ওই তাঁবুতে রেখেই আমাদের তাঁবুতে হানা দিলেন মনির ভাই। প্রথম দান খেলার ফাঁকেই চন্দ্রার হাতের চা চলে এলো। চায়ের চুমুকের রেশ কাটতে না কাটতেই লাঞ্চ হিসেবে এলো ম্যাগি। খেলা মুলতবি রেখে সেটাই সাঁটানো হলো। পাঁচ হাজার মিটারের অধিক উচ্চতায়ও খাবারের ব্যাপারে সবাই বেশ দারুণ অবস্থায় আছে। বমি ভাব কিংবা ক্ষুধামন্দা জাতীয় কিছুই নেই। খাওয়ার পর শ্রান্তিতে সবাই গা এলিয়ে দিতে চাইলেও বিশাল সব ব্যাকপ্যাকের জন্য সেটা হবার জো নেই। ভারী তুষারপাতের কারণে হুড়োহুড়ি করায় তাঁবুর বারান্দা টাইপ অংশটুকু ফিক্স করা হয়নি তখন। আমরা দুজন বাইরে বেরিয়ে ওটা খাড়া করে ভেতর থেকে ব্যাকপ্যাকগুলো ওখানে চালান করে দিতেই ভেতরের জায়গাটা বেশ ফাঁকা হয়ে গেল। মোবাইলে আমাদের নিয়মিত বিনোদন ‘সানডে সাসপেন্স’ শুনতে শুনতেই মনির ভাইয়ের মৃদু নাক ডাকার শব্দ ভেসে এলো।
সন্ধ্যা নাগাদ পাশের তাঁবু থেকে দুই শেরপা এলো পরদিনের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলতে। দুপুর থেকে একটানা তুষারপাত হয়েই যাচ্ছে। সিদ্ধান্ত হলো, রাতের মধ্যে আবহাওয়া ভালো হলে তবেই কাল দুই নম্বর ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে বেরোব। অন্যথায় এখানেই থাকব আরেকদিন। বার দুয়েক প্রকৃতির ছোট ডাকে সাড়া দিতে বাইরে বেরিয়ে আবহাওয়া পরিষ্কার হওয়ার বিন্দুমাত্র রেশ দেখতে পাইনি। সাদা তুষারের চাদরে মোড়ানো চারপাশ। দৃষ্টিসীমাও গেছে কমে। রাত আটটা নাগাদ ওয়াকিটকি চালু করে বেস ক্যাম্পে থাকা বন্ধুর সাথে কথা বলে নিলাম। ওর কাছ থেকে জানলাম, নিচের বেস ক্যাম্পেও অনবরত তুষারপাত হচ্ছে।
রাত আরেকটু গড়াতেই তুষারপাতের মাত্রা বাড়ল। তাঁবুর আউটারে চোখ রাখলেই থোক থোক জমা তুষারের দেখা পাচ্ছিলাম। পালা করে তাঁবুর ভেতরের অংশ থেকে বজ্রমুষ্টি দিয়ে তুষার পরিষ্কার চলছিল। পরদিন ভোরে তাঁবুর বাইরে এসে আবিষ্কার করলাম আজকেও বেরোনোর কোনো সম্ভাবনা নেই। একটানা তুষারপাত হয়েই যাচ্ছে। এর কোন বিরাম নেই যেন। সামনের রক ওয়ালটার কালচে পাথুরে গা দেখা যাচ্ছে আবছা মতো। কালচে শরীরে সাদা সাদা তুষারের ছোপ। প্রকৃতিতে সাদার বাইরে এই একটা রং চোখে পড়ছে এই মুহূর্তে। রক ওয়ালটা প্রায় খাড়া হওয়ায় খুব অল্প তুষারই আটকায় এতে। সূর্যের দেখা আগের দিন থেকেই নেই। কালচে মেঘের সাথে পেরে উঠছে না বলেই তার উপস্থিতি জানান দেওয়াটা এই মুহূর্তে সম্ভবপর হচ্ছে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধজল থেকে তেল