মৃদু তাপদাহ বয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রামে। বাতাসের গতিবেগ কম থাকায় তীব্র গরমের সাথে বাড়ছে অস্বস্তি। প্রখর রোদ ও গরম দুইয়ের প্রভাবে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে জনজীবন। কষ্ট বাড়ছে দিন মজুরসহ শ্রমজীবীদের। এদিকে গরম বাড়ার সাথে সাথে শিশুদের বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। তাই শিশুর বাড়তি যত্ন নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসে চট্টগ্রামের স্বাভাবিক তাপমাত্রা থাকার কথা ৩১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অথচ গত চার দিন ধরে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড হচ্ছে। একইভাবে চলতি মাসে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থাকার কথা ২৩ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিপরীতে এ মাসের গত ৯ দিনের মধ্যে ৬ দিনই সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি রেকর্ড হয়েছে। এ সময়ে বাতাসের গতিবেগও ছিল কম। ফলে কয়েকদিন ধরে বাড়ছে গরমের তীব্রতা।
আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে গতকাল রোববার তা মৃদু তাপদাহে রূপ নেয়। এ তাপমাত্রা আগামী কয়েকদিন একই বা অপরিবর্তিত থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদগণ। অর্থাৎ গ্রীষ্ম আসার আগ মুহূর্তে চৈত্রের বাকি দিনগুলোতেও গরম থেকে মুক্তি মিলছে না নগরবাসীর। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গতকাল নগরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৩৬ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তাকে মৃদু তাপদাহ বলা হয়। ওই হিসেবে গতকাল চট্টগ্রামে মৃদু তাপদাহ বয়ে গেছে। অবশ্য চলতি মাসে দেশে দুই থেকে তিনটি মৃদু অথবা মাঝারি (৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপদাহ বয়ে যেতে পারে বলে আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাসে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল। জানা গেছে, গতকাল নগরে রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। গতকাল রেকর্ডকৃত সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২৪ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেটাও শূন্য দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এর আগে ৮ এপ্রিল ৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৭ এপ্রিল ৩ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ৬ এপ্রিল শূন্য দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি রেকর্ড হয়।
জানা গেছে, ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে কানাডার ক্যালগভরি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের গবেষকদের সম্পৃক্ততায় পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে চট্টগ্রামে তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে আসে। ভূ–উপগ্রহ থেকে দিনের ও রাতের তাপমাত্রার ধরন বিশ্লেষণ করে পরিচালিত ওই গবেষণায় দেখা যায়, ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী ২০ বছরে চট্টগ্রামের তাপমাত্রা ১ দশমিক ৯২ ডিগ্রি বেড়েছে।
ওই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের রাতের তাপমাত্রা রাতের ঢাকার তাপমাত্রার চেয়েও বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, বঙ্গোপসাগর থেকে রাতের বেলায় যে বায়ু চট্টগ্রাম শহরের উপর দিয়ে বয়ে যায় সেটি ক্রমশ উষ্ণ হচ্ছে। তাছাড়া এখানে দক্ষিণ–পশ্চিম মৌসুমি বায়ু দুর্বল হয়ে যাওয়ায় এবং পাহাড় কাটায় আগের মতো বৃষ্টিপাত না হওয়াকেও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ বলা হয়।
গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন : নগরের একটি সংস্থার উন্নয়ন প্রকল্পের শ্রমিক মিনহাজ। খালের রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ কাজে যুক্ত আছেন। তিনি বলেন, একে তো রোদ, তার ওপর গরম। কাজ করতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কাজ না করলে খাব কি? তাই বাধ্য হয়ে গরম সহ্য করে কাজ করছি।
মিনহাজের মতো নানা পেশার লোকের বক্তব্য ছিল একই। গরমে কাহিল তারা। ছায়া সুশীতল সিআরবি এলাকায় গতকাল দুপরে দেখা গেছে অন্তত ১০ জন রিকশাচালক বিশ্রাম নিচ্ছেন। এদের কেউ কেউ ঘুমাচ্ছিলেন। বশির নামে এক চালক বলেন, গরমে কাহিল হয়ে গেছি। তাই বিশ্রাম নিচ্ছি। মনির নামে এক চালক বলেন, রোদের যা তেজ, আর কুলিয়ে উঠতে পারছি না। বিশ্রাম না নিলে মনে হয় মারাই যাব।
রিকশা চালকের মতো নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ বিশ্রাম নিচ্ছিল সেখানে। রাহাত, তানভীর ও রিফাত নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীও আড্ডা দিচ্ছিলেন। তারা জানান, সাধারণত তারা কাজীর দেউড়ি স্টেডিয়াম এলাকায় বসে আড্ডা দেন। গরমের তীব্রতায় সেখানে বসা যাচ্ছিল না। তাই সিআরবিতে এসেছেন ছায়ার খোঁজে। শুধু সিআরবি নয়, তাপদাহে ক্লান্ত লোকজন অন্য জায়গায়ও ছুটেছেন ছায়ার খোঁজে।
শিশুর সতর্কতা : শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ভাগ্যধন বড়ুয়া আজাদীকে বলেন, গরমের কারণে শিশু ঘেমে যায়। এ ঘাম থেকে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। এক্ষেত্রে গরম ও ঠান্ডা মিশে শিশুর কাশি হতে পারে। তাছাড়া বাইরেও প্রচুর ধুলোবালি রয়েছে। ধুলোবালি থেকেও কাশি হয়ে যেতে পারে। আবার একটু বয়স হওয়া শিশুরা মা–বাবার সঙ্গে ঠান্ডা পানি পান করে ফেলে। এতে তারাও অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। তাই অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে।
তিনি বলেন, শিশুদের নিয়ে মার্কেটে বেশিক্ষণ অবস্থান করাও উচিত হবে না। লোকসমাগম বেশি হয় এমন জায়গায় বেশিক্ষণ থাকলেও শিশুদের সমস্যা হতে পারে।
গরম বেশি অনুভূত হওয়ার কারণ : আবহাওয়াবিদগণ বলছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে নগরে গরম বেশি অনুভূত হচ্ছে। তাছাড়া মেঘমুক্ত আকাশ থাকার ফলে সূর্যের তাপ বেশি অনুভূত হচ্ছে। এমনকি বাতাসের যে গতি থাকা দরকার, তা নেই। তাই গরম বেশি লাগছে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ সুমন সাহা আজাদীকে বলেন, তাপমাত্রা তো বেশি আছে, তার উপর বাতাসের গতি কম। এ কারণে অস্বস্তি লাগছে। আগামী কয়েকদিন আবহাওয়া প্রায় একই থাকবে বলে জানান তিনি।
সীতাকুণ্ড ও সন্দ্বীপেও তাপমাত্রা বেড়েছে : নগরের বইরে উপজেলাগুলোতেও তীব্র তাপদাহে জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নগরের বাইরে সীতাকুণ্ড ও সন্দ্বীপ উপজেলার তাপমাত্রা রেকর্ড করে আবহাওয়া অফিস। এতে দেখা গেছে, ওসব এলাকার তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
রাজধানীর আগারগাঁও আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. হাফিজুর রহমান জানান, গতকাল সন্দ্বীপে সর্বোচ্চ ৩৭ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সীতাকুণ্ডে সর্বোচ্চ ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।
আজকের আবহাওয়া : পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস অনুযায়ী আজ সোমবার আকাশ অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলাসহ আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে। পশ্চিম/উত্তর–পশ্চিম দিক থেকে ঘণ্টায় ১০–২০ কিলোমিটার বেগে বাতাস প্রবাহিত হতে পারে।
রাজধানীর আগারগাঁও আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগসহ রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, মৌলভীবাজার, রাঙামাটি, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, কঙবাজার ও বান্দরবান জেলাসমূহের উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে।