নগরের ডিসি হিলের সামনের সড়কে যাত্রীর আসনে বসে ঘুমাচ্ছেন এক রিকশাচালক। এ সময় দুই নারী যাত্রী এসে তাকে ওয়াসা মোড়ে যাবেন কিনা জিজ্ঞেস করে। উত্তরে তিনি না বলে দেন। এ দৃশ্য গতকাল বিকেল ৪টার। দুই যাত্রী চলে যাওয়ার পর কথা হয় রিকশাচালকের সঙ্গে। নিজের পরিচয় দেন নূর হোসেন বলে। আজাদীকে তিনি বলেন, যা গরম পড়ছে, কাহিল অবস্থা। ঘামাতে ঘামাতে শরীর একদম দুর্বল হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম না করলে মনে হয় মারাই যাব।
নূর হোসেনের বক্তব্য থেকে আন্দাজ করা যায় গরমের ভয়াবহতা। সাথে এ গরমের কারণে শ্রমজীবী মানুষের কষ্টটাও স্পষ্ট হয়। তবে কেবল শ্রমজীবী মানুষই যে গত কয়েকদিন ধরে তীব্র গরমে অস্বস্তিতে আছেন তা না, গরমে হাঁসফাঁস করছেন কম–বেশি সবাই। নগরবাসী বলছেন, তীব্র গরমে কাহিল তারা। ভোরে সূর্য ওঠার পর থেকে সময় যতই যায় রোদের তেজ এবং গরম দুটোই যেন পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। গতকাল নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জীবিকা ও অন্যান্য প্রয়োজনে রাস্তায় বের হওয়ায় লোকজন গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। বৈশাখের তীব্র রোদ থেকে বাঁচতে ছায়ার খুঁজে ছুটছেন তারা। এমনই একজন মোজাম্মেল। গতকাল সকাল ১১টার দিকে তার সঙ্গে কথা হয় বহদ্দারহাট মোড়ে। তিনি জানান, তার বাসা মোহাম্মদপুর। বহদ্দারহাট এসেছেন ওষুধ কিনতে। গরমের কারণে বাসা থেকে বের হতে ইচ্ছে করেনি। কিন্তু ছোট ভাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনতে বাধ্য হয়েছেন বের হতে। তিনি বলেন, আমি ওমানে থাকি। মরুর দেশে গরমের যে তীব্রতা তার চেয়ে বেশি মনে হচ্ছে বাংলাদেশের গরম। এদিকে তীব্র গরমের প্রভাবে জ্বর ও ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ডায়রিয়া আক্রান্তদের মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি। এছাড়া নিউমোনিয়ায়ও আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন কয়েকজন হিট স্ট্রোকের রোগীও।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ভাগ্যধন বড়ুয়া আজাদীকে বলেন, গরমের কারণে শিশু ঘেমে যায়। এ ঘাম থেকে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। এক্ষেত্রে গরম ও ঠান্ডা মিশে শিশুর কাশি হতে পারে। তাছাড়া বাইরে প্রচুর ধুলোবালি রয়েছে। ধুলোবালি থেকেও কাশি হয়ে যেতে পারে। আবার একটু বয়স হওয়া শিশুরা মা–বাবার সঙ্গে ঠান্ডা পানি পান করে ফেলে। এতে তারাও অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। তাই অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, গতকালসহ টানা চারদিন ধরে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবেই মূলত বাড়ছে গরমের তীব্রতা। এছাড়া বাতাসের গতিবেগ কম থাকায় গরমের সঙ্গে বাড়ছে অস্বস্তি। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুয়ায়ী, আজ বুধবারও তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। তাই গরমের তীব্রতা থেকে মুক্তি মিলবে না আজও।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মে মাসে নগরের সর্বোচ্চ স্বাভাবিক তাপমাত্রা থাকার কথা ৩২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অথচ গতকাল রেকর্ড করা হয়েছে ৩৫ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। এছাড়া গতকাল সন্দ্বীপ উপজেলায় সর্বোচ্চ ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও সীতাকুণ্ড উপজেলায় ৩৬ দশমিক ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড হয়েছে। এই দুই উপজেলার মধ্যে সন্দ্বীপে স্বাভাবিকের চেয়ে ৬ দশমিক ৫ এবং সীতাকুণ্ডে ৪ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেশি রেকর্ড করা হয়।
জানা গেছে, ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে কানাডার ক্যালগভরি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের গবেষকদের সম্পৃক্ততায় পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে চট্টগ্রামে তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে আসে। ভূ–উপগ্রহ থেকে দিনের ও রাতের তাপমাত্রার ধরন বিশ্লেষণ করে পরিচালিত ওই গবেষণায় দেখা যায়, ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী ২০ বছরে চট্টগ্রামের তাপমাত্রা ১ দশমিক ৯২ ডিগ্রি বেড়েছে।
ওই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের রাতের তাপমাত্রা রাতের ঢাকার তাপমাত্রার চেয়ে বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, বঙ্গোপসাগর থেকে রাতের বেলায় যে বায়ু চট্টগ্রাম শহরের উপর দিয়ে বয়ে যায় সেটি ক্রমশ উষ্ণ হচ্ছে। তাছাড়া এখানে দক্ষিণ–পশ্চিম মৌসুমি বায়ু দুর্বল হয়ে যাওয়ায় এবং পাহাড় কাটায় আগের মতো বৃষ্টিপাত না হওয়াকেও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ বলা হয়।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বর্তমানে আবহাওয়ার যে উত্তাপ তা বৃষ্টি হলে কমে যেত। কিন্তু চট্টগ্রামসহ সারা দেশে বেশ কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে না। এ কারণে হিট ওয়েভ পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। দেশজুড়ে বৃষ্টি হলে তাপমাত্রা ও গরমের অনুভূতি কমে যেত।
আজকের আবহাওয়া : আজকের আবহাওয়া পরিস্থিতি সম্পর্কে পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস কর্মকর্তা বিশ্বজিত চৌধুরী আজাদীকে জানান, চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। আকাশ আংশিক মেঘলাসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। রাত ও দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
আগারগাঁও আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ বলেন, রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া ও পটুয়াখালী জেলার উপর তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তা অব্যাহত থাকতে পারে। সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকতে পারে। এছাড়া ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের দুয়েক জায়গা বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।
এদিকে গতকাল দেশের সর্বোচ্চ ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। গতকাল রাজধানী ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।