তিন বছরে অর্ধ লক্ষাধিক রেডিওথেরাপি সেবা

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৭:১৯ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ক্যান্সার (রেডিওথেরাপি) ওয়ার্ড গত তিন বছরে (২০১৯-২০২১ সাল পর্যন্ত) অর্ধলাখের বেশি রেডিওথেরাপি সেবা দিয়েছে। ২০১৮ সালের ৬ নভেম্বর থেকে কোবাল্ট-সিক্সটি মডেলের নতুন রেডিওথেরাপি মেশিনে সেবা চালু হয় এ ওয়ার্ডে। এর আগে বেশ কয়েক বছর এ সেবা বন্ধ ছিল বৃহত্তর চট্টগ্রামে একমাত্র রেডিওথেরাপি সেবাদানকারী এ হাসপাতালে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ঢাকার পর গোটা দক্ষিণাঞ্চলে (ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী থেকে টেকনাফ পর্যন্ত) দ্বিতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানে এই রেডিওথেরাপি মেশিন নেই। ফলে সেবাও নেই। যার কারণে রেডিওথেরাপি দিতে রাজধানী ঢাকায় ছুটে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না চট্টগ্রামের ক্যান্সার রোগীদের। তবে নতুন মেশিনে ২০১৮ সালের ৬ নভেম্বর পুনরায় রেডিওথেরাপি সেবা চালু হয় চমেক হাসপাতালে। এরপর থেকে অনেকটা ধারাবাহিকভাবে রেডিওথেরাপি সেবা পাচ্ছে চট্টগ্রামের ক্যান্সার রোগীরা। ক্যান্সার চিকিৎসকরা বলছেন, বিশেষ করে জরায়ু, স্তন, মুখ গহ্বর, গলা-শ্বাসনালী, ফুসফুস, ব্রেইন টিউমার ও মলদ্বারের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি অপরিহার্য। তাছাড়া শরীরের নির্দিষ্ট কয়েকটি অংশে ব্যথা নিরাময়েও রেডিওথেরাপি দেয়া হয়ে থাকে। বলতে গেলে অধিকাংশ ক্যান্সার রোগীকেই একটি সময়ে রেডিওথেরাপি নিতে হয়। যার ফলে ক্যান্সারের চিকিৎসায় এই রেডিওথেরাপি সেবা অপরিহার্য বলছেন চমেক হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ ও সহকারী অধ্যাপক ডা. আলী আসগর চৌধুরী।
হাসপাতালের ক্যান্সার ওয়ার্ড সূত্রে জানা গেছে, নতুন রেডিওথেরাপি মেশিনের সেবা চালুর পর ২০১৮ সালের শেষ দুই মাসে রেডিওথেরাপি সেবা দেয়া হয়েছে ১ হাজার ৭৭০ এক্সপোজার। আর ২০১৯ থেকে ২০২১ সালে (তিন বছরে) রেডিওথেরাপি সেবা দেয়া হয়েছে ৫৫ হাজার ৬২৭ এক্সপোজার। সব মিলিয়ে তিন বছরে ৫৭ হাজার ৩৯৭ এক্সপোজার (অর্ধ লাখের বেশি) রেডিওথেরাপি সেবা দেয়া হয়েছে এই ওয়ার্ডে। সাড়ে তিন হাজার ক্যান্সার রোগীকে এ সেবা দেয়া হয়েছে। চিকিৎসাকালীন সময়ে একজন রোগীকে ক্যান্সার ভেদে ১৫ থেকে ৩৫ বার পর্যন্ত রেডিওথেরাপি নিতে হয়। আর মেশিনে একবার থেরাপি নিলে সেটিকে ওয়ান এঙপোজার হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়ে থাকে। সে হিসেবে তিন বছরে সাড়ে তিন হাজার রোগীকে সব মিলিয়ে অর্ধ লাখের বেশি (এঙপোজার) রেডিওথেরাপি সেবা দেয়া হয়েছে এই ক্যান্সার ওয়ার্ডে।
ওয়ার্ড থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে রেডিওথেরাপি সেবা দেয়া হয়েছে মোট ১৭ হাজার ৬০ এঙপোজার। ১১ শতাধিক রোগীকে এ সেবা দেয়া হয়। ২০২০ সালে রেডিওথেরাপির সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ১৭০ এঙপোজার। ১ হাজার ৫০ জন রোগী এ সেবা পেয়েছেন। সর্বশেষ ২০২১ সালে রেডিওথেরাপি সেবা দেয়া হয়েছে ১৯ হাজার ৩৯৭ এঙপোজার। প্রায় ১২’শ রোগী এ সেবা পায়। আর ২০১৮ সালের শেষ দুই মাসে ২০০ জন রোগীকে রেডিওথেরাপি দেয়া হয় ১ হাজার ৭৭০ এঙপোজার।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেডিওথেরাপি সেবা দেয়া হয়েছে ২০২১ সালে। করোনা পরিস্থিতিতেও সেবা বন্ধ ছিল না জানিয়ে বিভাগীয় প্রধান ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও রেডিওথেরাপিসহ আমাদের সব সেবা চালু ছিল। ঝুঁকি থাকলেও চিকিৎসক-নার্স ও টেকনোলজিস্টরা সেবা প্রদান থেকে পিছ পা হননি। ২০২১ সালে পুরো বছর করোনা পরিস্থিতিতেও রেডিওথেরাপি সেবা গ্রহণকারী রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াটা তারই প্রমাণ। চিকিৎসক-নার্স ও টেকনোলজিস্টসহ সেবার সাথে সম্পৃত্ত ওয়ার্ডের সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদও জানান বিভাগীয় প্রধান ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ।
গোটা দক্ষিণাঞ্চলে (নোয়াখালী থেকে টেকনাফ পর্যন্ত) প্রায় ৪ কোটি মানুষের জন্য দ্বিতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানে রেডিওথেরাপি সেবা নেই জানিয়ে ক্যান্সার ওয়ার্ডের সহকারী অধ্যাপক ডা. আলী আসগর চৌধুরী বলছেন, যার ফলে এই রেডিওথেরাপি সেবা পেতে আমাদের ওয়ার্ডে রোগীদের প্রচণ্ড চাপ রয়েছে। অতিরিক্ত চাপের কারণে রোগীদের রেডিওথেরাপি সিরিয়াল দিতে হচ্ছে ২০-২৫ দিন পর। তবে দেরিতে হলেও রোগীরা এ সেবা পাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, গলায় বা মুখ গহ্বরে ক্যান্সারের একজন রোগীকে প্রায় ৩৫ দিন রেডিওথেরাপি নিতে হয়। ফুসফুস ক্যান্সারের রোগীকে ২০-৩০ দিন। আর স্তন ক্যান্সারের রোগীদের ১৫-৩০ দিন করে এ রেডিওথেরাপি দিতে হয়। বলা যায়, ক্যান্সার ভেদে একজন রোগীকে ন্যূনতম ১৫ দিন থেকে ৩৫ দিন পর্যন্ত রেডিওথেরাপি দিতে হয়। এজন্য ক্যান্সার রোগীদের জন্য এই রেডিওথেরাপি সেবা খুবই জরুরি ও অপরিহার্য।
ক্যান্সার ওয়ার্ড সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে (২০২১ সালে) শুধু আউটডোরেই প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার (১৭ হাজার ৪৭৬ জন) রোগী চিকিৎসা সেবা নিয়েছে ক্যান্সার ওয়ার্ডে। সেবা গ্রহণ করা এসব রোগীর মধ্যে নতুন রোগীর সংখ্যা ৬ হাজারের বেশি (৬ হাজার ২৯৩)। বাকি ১১ হাজার ১৮৩ জন নিয়মিত রোগী। যারা আগে থেকেই আউটডোরের (বহিঃ বিভাগের) সেবা গ্রহণ করে আসছিলেন। নতুন শনাক্ত ৬ হাজার ২৯৩ জনের মাঝে পুরুষ রোগীর সংখ্যা ৪ হাজার ৬০ জন। আর নারী রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ২৩৩ জন। হিসেবে নারী রোগীর তুলনায় ক্যান্সার বিভাগে সেবা গ্রহণ করা পুরুষ রোগীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুন।
ওয়ার্ডের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১ সালে আউটডোরে চিকিৎসা নেয়া ৪ হাজার ৬০ জন পুরুষ রোগীর মধ্যে মুখ গহ্বর ও গলার ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা ৭৭১ জন। যা মোট পুরুষ রোগীর ১৯ শতাংশ। পুরুষদের ক্যান্সারের মধ্যে এর পরের অবস্থানে রয়েছে ফুসফুস ক্যান্সার। ১৭ শতাংশ পুরুষ রোগী এ ক্যান্সারে আক্রান্ত। আক্রান্তের সংখ্যা ৬৯০ জন। এছাড়া পুরুষদের ১১ শতাংশ (৪৪৬ জন) খাদ্যনালী ক্যান্সারে, ৫ শতাংশ (২০৩ জন) মলদ্বার ক্যান্সারে এবং ৪ শতাংশ (১৬২ জন) পাকস্থলি ক্যান্সারে আক্রান্ত। বাকি রোগীরা অন্যান্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।
অন্যদিকে, একই সময়ে চিকিৎসা নেয়া নারী রোগীদের মাঝে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত স্তন ক্যান্সারে। এই সংখ্যা ৫৩৫ জন। যা মোট নারী রোগীর ২৪ শতাংশ। এরপর জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বেশি সেবা নিয়েছেন নারীরা। আউটডোরে ৩৫৭ জন জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন গত বছর, যা মোট নারী রোগীর ১৮ শতাংশ। এরপর মুখ গহ্বর ও গলা (হেড অ্যান্ড নেক), খাদ্যনালী, ফুসফুস ও অন্যান্য ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি নারী রোগীদের মাঝে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলা ভাষার বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র রুখে দেয় জনগণ
পরবর্তী নিবন্ধআমের বনে মুকুলের ঘ্রাণে…