একজন বয়স্ক রোগীকে নিয়ে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে হাজির হলেন তাঁর সহধর্মিণী। রোগীর অবস্থা তেমন ভালো নয়।
হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে কর্মরত সংশ্লিষ্ট ডাক্তার এবং কর্মীরা তক্ষুণি রোগীকে বিছানায় শুইয়ে রোগীর নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
রোগীর দেহপিঞ্জরে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনি বিকল ইত্যাকার নানা রোগের সমাহার।
ঠিক এই মুহূর্তে সত্তরোর্ধ্ব বয়সী রোগীটি অর্ধচেতন।
সময় নষ্ট না করে রোগীর বয়স্কা স্ত্রী নিকট দু–এক আত্মীয়ের সহযোগিতায় তাঁর স্বামীকে নিয়ে হাজির হয়েছেন হাসপাতালের করিডোরে। এরপরেই জরুরি চিকিৎসা শুরু হলো।
কর্তব্যরত ডাক্তারের নির্দেশে রোগীকে ভর্তি করা হলো হাসপাতালের চারতলায় তিন নম্বর কেবিনে।
একজন তরুণ বয়সী ওয়ার্ডবয় রোগীকে খুব যত্নের সাথে হুইলচেয়ারে নিয়ে চার তলার তিন নম্বর কেবিনে পৌঁছে দিল। আসার পথে বৃদ্ধরোগী উৎসুক হয়ে তরুণটির নাম জানলো, ওর নাম আশিক।
আশিক নামের তরুণটি আজ চার বছর এই হাসপাতালে কাজ করছে। উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর পরিবারের নানা টানাপোড়েনে গ্রামে তার আর পাঠ শেষ হয়নি। কিন্তু ওর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের অদম্য ইচ্ছা লক্ষ্য করেন স্ত্রী সুরভী এবং ওনার স্বামী।
আশিক তার গ্রামের বাড়ি ছেড়ে ভাগ্য গড়ার জন্য শহরে ঠাঁই নেয়। নাইট শিফটের একটি কলেজে অনার্স ডিগ্রি লেভেলে ভর্তি হয়ে বিদ্যার্জনের স্বপ্নে বিভোর সে।
এতেই এই বৃদ্ধ–বৃদ্ধার অন্তর ভরে যায়। তাঁদের মনে হয় এতেই পরম সুখ। ওঁরা এই মুহূর্তে ঠিক করেন এবার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আশিকের লেখাপড়ার সব ব্যয়ভার তাঁরাই নেবেন।
সেদিন বৃদ্ধর আর কোনো কথা হয় না তাঁর রোগ যন্ত্রণার ধকলে। ওয়ার্ডবয় আশিককে বেশ বিনয়ী মনে হলো স্ত্রী সুরভীর। আশিক তাঁকে আলতো ধরে হাসপাতালের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রোগীর স্ত্রীকে আস্বস্ত করে বললো, কিছু প্রয়োজন হলে কেবিনের ফোনে কল দিয়েন আন্টি।
আশিক বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে কেবিনে এলেন স্টেথেস্কোপ হাতে ডিউটি ডাক্তার। মহিলা ডাক্তার রোগীর জটিলতা সম্পর্কে খোঁজ নেন। রোগী তন্দ্রাচ্ছন্ন।
ডিউটি ডাক্তার রোগীর প্রেসার আর পাল্স রিপোর্ট নোট করলেন। কিছু পরেই কনসালটেন্ট আর নার্স, সিস্টার সহ বেশ ক’জন এলেন।
রোগীর তন্দ্রালু ভাবটা কেটে গেছে। কনসাল্টেন্ট তাঁর পাশে থাকা ডিউটি ডাক্তারকে অনেক ক’টা টেস্ট করার নির্দেশ দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
রোগীর স্ত্রী–র কপালে ভাঁজ দেখে বোঝা গেল তিনি বেশ চিন্তিত তাঁর স্বামীর জটিলতা নিয়ে।
বৃদ্ধর কর্মজীবন বেশ বৈচিত্র্যময়। তিনি উচ্চশিক্ষা শেষে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন উচ্চপদে কর্মকর্তা হিসেবে। অবসরপ্রাপ্তির পরে তিনি কর্পোরেট কোম্পানির বড়কর্তা হিসেবেও কর্মব্যস্ত ছিলেন। তাঁর স্ত্রী প্রায় চৌত্রিশ বছর একটি মিশন স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করে এখন অবসরপ্রাপ্ত।
জনজীবনে প্রত্যেক মানুষের কিছু না কিছু অভাব থাকে। স্রষ্টা সবাইকে পরিপূর্ণ করে কিছু দেবেন এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।
এই বৃদ্ধ–বৃদ্ধার বিত্তের বিশেষ কোনো অভাব নেই।
কিন্তু তাঁরাও আজ কঠিন পরীক্ষার প্রহর পার করছেন। তাঁদের একমাত্র সন্তান আজ কাছে নেই। একটি মাত্র সন্তান প্রবাসে থিতু হয়েছে, এই অভাবটাই এই মুহূর্তে বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে ওঁদের কাছে। সুরভী তাঁর বৃদ্ধ অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে কতটুকু অসহায়তার মাঝে কাটাচ্ছেন তা যাঁদের সমস্যা তাঁরাই কেবল বুঝবেন। এমনই একটি ধারণা সুরভীর !
এঁরা দুজন বৃদ্ধ–বৃদ্ধাও সচ্ছল কর্মব্যস্ত দিন যাপন করেছেন তাঁদের মধ্য বয়স অব্দি। এইতো সেদিন ওঁরা নিজেদের ফেলে আসা দিনের স্মৃতি হাতড়ে সুখ–দুঃখের হিসেব কষছিলেন। কত ভালো ছিল অতীত সময়টা। কিন্তু আজ এ–মুহূর্তে ওরা দুটি কেমন আলাদা জগতের বাসিন্দা হলেন।
এসব সাত–পাঁচ ভাবতে ভাবতেই রোগীর স্ত্রী সুরভী কেমন আনমনা হলো!
এরই মাঝে সিস্টার একটা ফাইল নিয়ে কেবিনে ঢুকলো। বহু ওষুধের ফিরিস্তির প্রেসক্রিপশন ফাইলটা টেবিলের ওপর রেখে ওষুধগুলো একে একে মেলাতে শুরু করলে সুরভী ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো। তাঁর মনের মাঝে যেন প্রচণ্ড ঝড় বইতে শুরু করেছে।
সিস্টারের নামের ব্যাজে দেখতে পেলো ওনার নাম–আয়েশা।
সিস্টার আয়েশা এক দঙ্গল ওষুধ থেকে সকাল–দুপুর–বিকেল আর রাতের ওষুধের তালিকা করে সুরভীকে বুঝিয়ে দিলে তিনি তা চোখ বুলিয়ে দেখলেন। এর মাঝে কোনো ওষুধ খালি পেটে আবার কিছু ভরপেটে।
এভাবে প্রথম দিন পেরিয়ে দ্বিতীয় রাতে রোগীর অবস্থা বুঝে রোগীর শিরায় স্যালাইন পুশ করা হলো পরপর দু’দিন ধরে।
রোগের উপশম বোঝার জন্য দু’জন বিশেষায়িত ডাক্তার পরামর্শ করে ঠিক করলেন রোগীর জটিলতার অবসান হলেই রোগী সাড়া দেবেন।
সুরভী অসুস্থ স্বামীর পাশেই বসে কিংবা দাঁড়িয়ে লক্ষ্য রাখছেন তাঁর স্বামীর শারীরিক উন্নতি কতটুকু হতে চলেছে।
এরই মাঝে কত টেস্ট আর কত ইনভেস্টিগেশন তারও কোনো সীমা খুঁজে পায় না সুরভী।
দিন শেষে রাত আর রাত্রির পর দিনের আলো ফোটে। এভাবেই সাতটি ভোরে সাতটি দিনের শুরু।
ডাক্তার সময় হলে রোগীর স্ত্রী সুরভীকে জানিয়ে দেন, রোগী এ–কদিনে অনেকটা ইমপ্রুভ করেছেন, আগামী কালই বাড়িতে ফিরতে পারেন।
তিন নম্বর কেবিনের বিছানায় শুয়ে রোগী যেন কিছু স্বস্তি পায় এবারের মতো তিনি হয়তো বেঁচে গেছেন।
হাসপাতাল হতে ডিসচার্জ হবার দিন ঠিকই ওয়ার্ডবয় আশিক হুইলচেয়ার নিয়ে হাজির।
রোগী ভাবলেন তিনি হেঁটেই হাসপাতালের সীমানা পেরুবেন। কিন্তু ডাক্তার ও নার্স কেউ রোগীর এই আব্দার মেনে নিতে পারলেন না।
হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স আর অন্যান্য কর্মকর্তা–
কর্মচারীরা আশিকের ব্যাপারে এই বৃদ্ধ–বৃদ্ধার মনের আকুতি সম্পর্কে কেউ কিছু আগে থেকে জানতেন না!
আর আশিক… সে–তো এই মুরুব্বীদের উদারতার বিষয় তার চিন্তার গন্ডির মাঝেই ছিল না !
বৃদ্ধ রোগী আর ওঁর স্ত্রী সুরভীর কাছে হাসপাতালের তিন নম্বর কেবিনের স্মৃতিটুকু তরতাজা সবুজ সজীব হয়ে রইলো এবারের মতো।