তিনটি মুসলিম রাষ্ট্র এবং তার নারীদের পোশাক

শাফিনূর শাফিন | শনিবার , ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:১৯ পূর্বাহ্ণ

মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরাটাকে পশ্চিমা চিন্তকদের অনেকেই দমনের চিহ্ন হিসেবে দেখলেও ইসলামিক ফেমিনিস্টরা হিজাবকে মুসলিম নারীর ‘নিজস্ব পছন্দ’ এবং ‘পরিচয়সত্তা’র চিহ্ন বলে ব্যাখ্যা করে থাকেন।
কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে হিজাব ‘পছন্দ’ হলে কেন কোনো কোনো মুসলিম দেশে মুসলিম নারীরা হিজাব তাদের উপর চাপানো হচ্ছে বলে প্রতিবাদ করে থাকে। তাদের দাবি, হিজাবের নামে মূলত অধিকারের প্রশ্নে (যেমন ঘরের বাইরে শিক্ষা, চাকরি ইত্যাদি) মুসলিম নারীকে বঞ্চিত করার দীর্ঘমেয়াদী চেষ্টার প্রাথমিক ধাপ। তাছাড়াও নারীর প্রতি জারি রাখা বিভিন্ন নিয়মকানুন কিংবা আইন ইসলামের নামে নানা সংস্কৃতিতে হাজার বছর ধরে চলে আসা চরম নারীবিদ্বেষী বা পুরুষতান্ত্রিক ভাবনার সাথে কোরান বা হাদিসের ব্যাখ্যা দিয়ে ইসলাম ধর্মের নাম দিয়ে জারি রাখা হচ্ছে।
এই বিষয়ে পাকিস্তানী স্কলার আসমা বার্লাস ২০০২ সালে প্রকাশিত বইয়ে ‘বিলিভিং উইমেন ইন ইসলাম’ (Believing Women in Islam: Unreading Patriarchal Interpretations of the Qur’an ) ঐতিহাসিক বিভিন্ন উপাত্তসহকারে আসমা দেখান নবীর সময়ে কিংবা তার মৃত্যুর পরেও মুসলিম নারীরা মাথায় কাপড় না দিয়েও হজ্ব করেছেন। সেই সময় মাথায় কাপড় দেয়াটা মুসলিম নারীর জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না। কোরানের একটি আয়াতের, ‘ধর্মের ব্যাপারে যেন কোনো জোর জবরদস্তি না করা হয়’ (কোরান, ২:২৫৬), প্রসঙ্গ টেনে আসমা বলেন অথচ ইসলাম ধর্মের নামে কোরানের আয়াতকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করে মুসলিম নারীকে অবদমনের প্রচেষ্টার শুরু হয়েছে মাথার চুল, মুখ থেকে শুরু করে সমস্ত শরীর ঢাকতে বলে এবং এই ব্যাখ্যাগুলো ইসলাম-পূর্ব আরবের বিভিন্ন উপজাতীয় নিয়মকানুনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে করা হয়েছে এবং তা নবীর মৃত্যুর পরই হয়েছে। যখন অমুসলিম কোন দেশে মুসলিম নারীদের হিজাব পরতে বাধা দেয়া হয় তখন হিজাবকে মুসলিম নারীর পছন্দ এবং সত্তার অধিকার বলা হয়। কিন্তু যখন মুসলিম দেশে মুসলিম নারীরা হিজাব জোর করে চাপানোর বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে তখন মাথায় প্রশ্ন আসে- মুসলিম সমাজের ভেতরেই হিজাব কি আসলে পছন্দ নাকি জোর করে পরানো অবদমনের চিহ্ন। সমপ্রতি পশ্চিম ইরানের সাধারণ জনগণ এবং ইরানি নারীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে মাহসা আমিনীর মৃত্যুতে। ২২ বছরের কুর্দী নারী মাহসা আমিনী তেহরানে পরিবারের সাথে বেড়াতে এসেছিলেন। যথাযথ নিয়মে হিজাব পরিধানসংক্রান্ত এক বিশেষ আইনের আওতায় ইরানের স্পেশাল পুলিশ ইউনিট যারা নৈতিক পুলিশ বলে পরিচিত- তারা তাকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর পুলিশ প্রহরায় মাহসার হার্ট এটাক এবং পরবর্তীতে কোমায় মৃত্যুবরণ করেন। এই মৃত্যুর কারণ হিসেবে হার্ট এটাক নয় বরং পুলিশি নির্যাতন দাবি করে এর বিচার চেয়ে এবং যে বিশেষ আইনের আওতায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তা তুলে নেয়ার দাবি জানাচ্ছেন প্রতিবাদকারীরা। আল জাজিরার একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ইরানের নারীরা এই আইনকে বৈষম্যমূলক এবং জোরপূর্বক হিজাব চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে উল্লেখ করে- এটি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন ২০১৭ সাল থেকে। তাদের এই দাবির পক্ষে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আল খোমেনী এই বিষয়ে কিছুটা নমনীয় হলেও শরিয়া কাউন্সিলের রক্ষণশীল সদস্যরা এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নন, বরং যারা মানবে না বা পরতে চাইবে না হিজাব- ‘মাথার চুল দেখিয়ে তারা নৈতিক অবক্ষয় এবং পরিবারের জন্য অসম্মান’ বয়ে আনবে এই যুক্তি দিয়ে তাদের কঠিন শাস্তি দেয়ার পক্ষপাতী তারা। এমনকি সমপ্রতি দেশটির বিচারবিভাগ জনগণকে কোন নারী হিজাব না পরলে সাথে সাথে পুলিশকে অবহিত করার ব্যাপারে বলেছেন। ইরানি সরকার এই গণবিক্ষোভ সামলাবে নাকি তাদের দাবি মেনে নিয়ে হিজাব সংক্রান্ত আইনে পরিবর্তন আনবে তা সময় বলে দিবে।
কিন্তু পোশাকের পুলিশিং ইরান-আফগানিস্তান-মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও থেমে নেই। বাংলাদেশে এখনো শরিয়া আইন পালন করা না হলেও কিছুদিন আগে নরসিংদীর স্টেশনে একটি মেয়ের পশ্চিমা পোশাক পরাকে কেন্দ্র করে তাকে লাঞ্ছনার মামলার রায়ে উচ্চ আদালত প্রশ্ন তুলেছে, সভ্য দেশে এসব পোশাক পরে রেল স্টেশনে যাওয়া যায় কি? এই ধরনের পোশাক-পুলিশিং মন্তব্যের প্রতিবাদে কিছু তরুণ-তরুণী যখন বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরে রাস্তায় নামলেন, তাদের মধ্যে একজনের ব্লাউজবিহীন শাড়ি পরা ছবি নিয়ে আমাদের সংস্কৃতি এবং ধর্ম উচ্ছন্নে যাচ্ছে দাবি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘এই মেয়েকে কেউ বিয়ে করবে না’ ধরনের ট্রল শুরু হলো। তার প্রতিবাদে আমাদের সংস্কৃতিতে একশ বছর আগেও আমাদের নানী-দাদীদের আমলে ব্লাউজ পরার চলন ছিল না বলছেন অনেকেই। বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল সাফ খেলতে যাওয়ার আগে তাদের শর্ট প্যান্ট পরে মাঠে নামার সমালোচনা করা হয়েছিল। মুসলিম সব দেশই কি এমন?
আমি যে-দেশে আছি, মুসলিমপ্রধান দেশ। আমার সুপারভাইজারের টিএ হিসেবে টিউটোরিয়াল নিতে হয়। সেই ক্লাসে হিজাব পরা মেয়ে যেমন আছে, মিনি স্কার্ট, ক্রপ টপ পরা মেয়েরাও আছে। ছেলেরা অবশ্য শর্টস পরে আসে না কিন্তু মাঝেমধ্যে যেসব রিপড জিন্স পরে আসে ওগুলো কোনও অংশে কম না। ক্লাসের ৯০% মুসলিম ধর্মাবলম্বী।
মাঝেমধ্যে সুইমিংপুলে বা বিচে যাই সাঁতার কাটতে। সেখানে যে যার পছন্দমতো শর্ট লেংথ/ফুল লেংথ সুইমিং কস্টিউম পরে নেমে যায় সাঁতরাতে। কেউ কারো দিকে তাকায় না। না ছেলেরা বদনজর দেয়, না মেয়েরা এসে বলে কিছু। এমন নন-জাজমেন্টাল একটা পরিবেশ এখানে আছে। আমার ব্রুনেইয়ান মুসলিম মেয়েবন্ধুদের দেখি, অনেক রাত পর্যন্ত তারা বাইরে থাকলেও তা নিয়ে পরিবারে কিছু বলে না। নারী এবং পুরুষের কারোই নিরাপত্তার অন্তত অভাব নেই।
ধর্ম পালন তারা যে যার মতো করছে কিন্তু তা নিয়ে হাউকাউ করে অন্যদের দোজখে পাঠিয়ে দিচ্ছে না। এখানে ইসলামিক শিক্ষা দেয়া হয় না এমন না, কিন্তু জোরাজুরি নেই। পোশাকআশাক বা মেলামেশার ক্ষেত্রে তাদের লিবারেল মনোভাব এবং অন্য ধর্ম বা মতাবলম্বীদের প্রতি সহনশীলতা দেখে বোঝা যায় সহনশীলতার শিক্ষা তাদের সিস্টেমের মধ্যেই প্রোথিত। দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা, চাকরি, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা সেবা ইত্যাদি নিশ্চিত করার দিকে সরকারের মনোযোগ বেশি। সাধারণত কোন দেশের জনগণ নিজ দেশের সরকারপ্রধান নিয়ে এতো শ্রদ্ধাশীল হতে দেখা যায় না যা এখানে দেখছি। যে কমফোর্ট জোন এখানে আছে এটা অন্তত অনেক মুসলিম নারীই নিজের দেশে পাবে না। আর আমার দেশে তো স্লিভলেস পরলো কে, গায়ে ওড়না আছে কি নাই তা নিয়ে যেভাবে তাকানো থেকে খোঁচাখুঁচি চলে মনে হয় যেন বাঙালি মুসলিম নারীর শরীরই যেন তার প্রধান শত্রু!
অবশ্য দেশের আর দশটা অসঙ্গতি যখন সাধারণ মানুষ দেখতে চায় না তখন তাদের চোখ অর্জুনের পাখির চোখ ভেদের মতো করে কেবল যেন নারীর পোশাকেই নিবদ্ধ রাখতে পারলেই শান্তি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধলায়নিজম মানবিকতার পতাকা উড্ডীন করে চলেছে
পরবর্তী নিবন্ধমৃত্যুর নিপুণ শিল্প বিকীর্ণ আঁধারে