‘১৯৭১ সালে তোমাদের দেশে যে ভয়ংকর গণহত্যা, ধর্ষণ, ধ্বংসযজ্ঞ, দেশত্যাগ, গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে সেটা এত অবিশ্বাস্য যে আজ থেকে দশ বিশ বৎসর পর পৃথিবীর কেউ এটি বিশ্বাস করবে না।’ জনৈক মার্কিন গবেষকের উক্তি। মুক্তিযুদ্ধের চার যুগ পার হওয়ার আগেই আমি হঠাৎ করে আবিষ্কার করেছি, ওই ভদ্রলোকের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যি প্রমাণিত হয়েছে । তাই এখনো তিন লাখ তা ত্রিশ লাখ নিয়ে এখানকার বুদ্ধিজীবীরা তর্কে লিপ্ত । এই ব্যাপারে আমাদের সুশীল সমাজের সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখার কথা। কিন্তু আমাদের খুবই দুর্ভাগ্য এই দেশের সকল বুদ্ধিজীবীরা সেই দায়িত্ব পালন করতে রাজি নন। ‘নিরপেক্ষতা’, ‘বাকস্বাধীনতা’ এ রকম বড় বড় শব্দ ব্যবহার করে তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠিত সত্যগুলোর মূল ধরে টানাটানি শুরু করেছেন। আপনারা কি জানেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলি বধ্যভূমির কেবল একটা গর্ত থেকে ১ হাজার ১০০ টা মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছিলো ? সেই বধ্যভূমিতে এরকম প্রায় একশটি গর্ত ছিলো । আর ডঈঋঈ-র হিসাব অনুসারে সারাদেশে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে ৯৪২টি। যে বুদ্ধিজীবীরা এই দেশের তরুণ প্রজন্মকে দিকনির্দেশনা দেবেন তারাই যদি উল্টো তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে শুরু করেন তাহলে আমার হতাশা অনুভব করা উচিত ছিল । কিন্তু আমি বিন্দুমাত্র হতাশ নই ।
যাই হোক মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বেশ কিছুদিন আগে, আমার শ্রদ্ধেয় স্যার কিংশুক দাশ চৌধুরীর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক এর ওয়ালে দুজন অপরিচিত মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের ব্যাপারে একটা লেখা চোখে পরে। আমি উৎসাহিত হয়ে, সেই শহীদের এক জনের সমাধি পরিদর্শনে যাই এবং আরো তথ্য সংগ্রহের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির অশোক সাহা মামা এবং কমরেড শাহ আলম মামার সাথে যোগাযোগ করি। পরে ঘাঁটাঘাঁটি করে যা জানলাম, সে ঘটনা রীতিমত অবিশ্বাস্য। মুক্তিযুদ্ধের এই রকম নাম না জানা শহীদদের মতো উনারাও হয়তো একদিন হারিয়ে যাবেন। সেই শহীদ দুজন সম্পর্কে হন পিতা পুত্র – পি সি বর্মন এবং তাঁর সন্তান রতন বর্মন ।
শ্রী প্রবোধ চন্দ্র বর্মন : যিনি শহরে পি সি বর্মন নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রাম ইউনিয়ন ব্যাংকের ডাইরেক্টর যেটা এখন জনতা ব্যাংক। পাকিস্তানীরা এই ব্যাংক হস্তগত করতে কৌশলে উনাকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে জেলে পুড়ে দিয়েছিল । সময়টা ১৯৬৮। জেলে থাকা অবস্থায় উনার সাথে একই সাথে ছিলেন চট্টগ্রামের ওই সময়কার তুখোড় নেতারা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম কমরেড পূর্ণেন্দু দস্তিদার, কমরেড শাহ আলম, এস এম ইউসুফ প্রমুখ। কমরেড শাহ আলমের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, পি সি বর্মন দেখতে শুনতে সুপুরুষ ছিলেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এর মতো উনার দাঁড়ি ছিল। তিনি নির্বিরোধ, মার্জিত এবং সংস্কৃত মনা মানুষ ছিলেন। জেলে বসে কমিউনিস্ট পার্টির লোকজনের সান্যিধ্যে আসার কারনে, তিনি ধীরে ধীরে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনে জড়িয়ে পরেন। জেলে বসে তিনি নিজে কবিতা লিখতেন এবং রাজবন্দীদের কবিতা পড়ে শোনাতেন। ১৯৭১ সালের ৭ই এপ্রিল, তাঁর কর্মস্থল ইউনিয়ন ব্যাংক কার্যালয় থেকে পাকিস্তান আর্মি উনাকে তুলে নিয়ে যায়, কিন্তু তাঁর অতি মার্জিত ও ভদ্র ব্যবহারের কারণে উনাকে আবার ছেড়ে দেয়। ৮ই এপ্রিল, ১৯৭১ সালের সন্ধ্যার দিকে পাকিস্তান আর্মি, রাজাকারদের সহায়তায়, নন্দন কানন ১ নং গলির বাসা ঘেরাও করে এবং এলোপাতারি গুলি ছুঁড়তে থাকে, যে গুলির দাগ এখনো উনার বাসভবনে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। উনাকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে এসে নন্দন কানন পুকুর পাড়ে গুলি করা হয় এবং মৃতদেহ ওখানেই পুঁতে ফেলা হয়। উনার সমাধি এখনো অযত্নে , অবহেলায় আমাদের চট্টগ্রাম শহরে নন্দন কানন ১নং গলিতে পরে আছে। এটা শুধু সমাধি নয় – এগুলো একটি জাতির ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা সংরক্ষণ এখন অতিব জরুরি ।
রতন কুমার বর্মন : শ্রী প্রবোধ চন্দ্র বর্মন এর পুত্র সন্তান রতন কুমার বর্মন চট্টগ্রামে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি একজন সংগঠক হিসেবে শহর ত্যাগ করেন। তিনি তাঁর বাবা, শ্রী প্রবোধ চন্দ্র বর্মন কে বার বার শহর ত্যাগের জন্য অনুরধ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর বাবা চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে কোথাও যান নি। গোপন সুত্রে খবর পেয়েছিলেন যে তাঁর বাবার জীবন বিপন্ন। তাই বাবাকে শহর থেকে নিয়ে যেতে, তিনি কর্ণফুলীর ওপাড় থেকে এসেছিলেন। কিন্তু চাক্তাই ঘাটে তিনি রাজাকারদের হাতে ধরা পরেন। সময়টা ছিল সন্ধ্যা। পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাঁকে গুলি করে মারা হয় এবং লাশ ছুঁড়ে ফেলা হয় কর্ণফুলীতে। ভরা পূর্ণিমায় রক্তস্নাত হল প্রবল প্রমত্তা কর্ণফুলী।
আমাদের মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন। মুক্তিযুদ্ধের গল্প, প্রসব যন্ত্রণায় কাতর মায়ের এক একটা আর্তনাদ।
অনেক অজানা শহীদদের মতো এই দুই শহীদের কথা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের তথ্য ও দলিল এ উল্লেখ নেই। পি সি বর্মন এর সমাধিটা নন্দন কানন ১ নং গলিতে অযত্নে আর অবহেলায় পরে আছে। আমাদের বীর চট্টলার এই দুই শহীদের জন্য কি আমাদের কিছুই করার নেই?
লেখক : প্রকৌশলী, জার্মান ইন্সটিটিউট অব অলটারনেটিভ এনার্জির বাংলাদেশ প্রতিনিধি