তালাকপ্রাপ্ত নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে

জোবায়দা আক্তার চৌধুরী | মঙ্গলবার , ২৭ জুলাই, ২০২১ at ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ

আজকাল বিবাহ বিচ্ছেদ লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে। বর্তমানে ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ৩৯টি তালাক হয়। এ পরিসংখ্যান শুধু ঢাকার। তাহলে সারাদেশের হাল অবস্থা একবার চিন্তা করুন, কী ভয়াবহ ব্যাপার। এর বহু কারণ থাকতে পারে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা বোধ, ইগো সমস্যা, অত্যাচার, রুচিবোধ। বর্তমানে মাদকাসক্ত ও পরকীয়া বিবাহ বিচ্ছেদের বড় একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যে কারণেই বিচ্ছেদ হোক না কেন দেখা যায় তার কারণ না খুঁজেই এই অপবাদের বোঝা মেয়েদের মাথার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। দুই পক্ষেরই অপবাদের আঙুল তাক করা থাকে মেয়েটির দিকে। আবার শুধু যে ছেলে পক্ষের দোষ থাকে তা কিন্তু নয়। এক্ষেত্রে দোষ যার বা যাদেরই থাকুক না কেন আমরা কিন্তু মেয়েটিকেই অপবাদের কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে থাকি। সেই তালাকপ্রাপ্ত মেয়েটির আত্মীয়স্বজন কলিগ পাড়া-প্রতিবেশী সবাই একটা কথাই বলবে, নিশ্চই মেয়েটির কোনও দোষ আছে। এত সুন্দর পরিবার, কী সুন্দর ছেলে তাহলে ছাড়াছাড়ি হলো কেন?
অথচ সংসার ভাঙার আগে একজন অত্যাচারিত নারী যখন দ্বারে দ্বারে বিচার চেয়ে বেড়ায় তখন সবাই মুখ ঘুরিয়ে নেয় চুপ করে থাকে। আবার সেই মেয়েটি যখন স্বামীর অত্যাচারের কথা শ্বশুর শাশুড়ি ননদ-দেবর কে বিচার দেন, উত্তরে আসে তোমার সাথে এমন করে কেন? তোমার গায়ে হাত তুলে কেন? নিশ্চই কোনও কারণ আছে। আসলে এই ধরনের পরিবার কখনোই ছেলের বৌ বলেন আর ভাইয়ের বৌ বলেন, তাদের আপন করে নিতে পারে না। এভাবেই তিলে তিলে শেষ হতে থাকে একটি মেয়ের জীবন।
আমরা কিন্তু একবারের জন্যও ভাবিনা মেয়েটি কতটা বাধ্য হলে সংসার ভাঙার মতো এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে আবার ছেলেটাই বাধ্য করে ডিভোর্সের জন্য। অবশ্য এর ব্যতিক্রম ঘটনাও ঘটে। সে প্রসঙ্গে আজ নাইবা বললাম। সংসার ভাঙার পর মেয়েটির পরিচয় আমরা এভাবে দেই “ডিভোর্সি মেয়ে”। আর ছেলেটার ক্ষেত্রে কী বলি? অমুক ছেলেটা খুব ভালো। আগের বৌয়ের সাথে বনিবনা হয় নাই বলে ডিভোর্স হয়ে গেছে। ছেলের পরকীয়ার জন্য সংসার ভাঙলে তখন শুনবেন মেয়েটি স্বামীকে ধরে রাখতে পারেনি কেন? ছেলেটার সাথে মানিয়ে চলতে পারেনি ইত্যাদি ইত্যাদি। যেন সব চেষ্টাই মেয়েদের করতে হবে। ছেলেদের কোনও দায়-দায়িত্ব নেই। ছেলেটি যদি মাদকাসক্ত হয় তাহলে শুনবেন, মেয়েটির উচিত ছিল তাকে সেবাশুশ্রূষা করে সুস্থ জীবন ফিরিয়ে তার সাথে সংসার করা। তারমানে একজন মাদকাসক্ত স্বামীর সাথে ঘর করতে হলে আপনাকে আয়া, নার্স, ডাক্তার, দারোয়ান সবই হতে হবে। এরপর কিছু অসুস্থ মানুষ আছে এই সমাজে তারা কিছু পাক আর না পাক, চোখে কিছু না দেখেও বলে দিতে পারবে মেয়েটির চরিত্র খারাপ। তিল কে তাল বানিয়ে মেয়েটির চরিত্র নিয়ে উঠে পরে লাগবে।অশিক্ষিতদের কথা বাদই দিলাম অনেক শিক্ষিত মানুষও এই অসুস্থ মন মানসিকতা থেকে বের হতে পারেন নি। অথচ ছেলেটার হাজারটা দোষ থাকলেও বলবে ওতো ছেলেমানুষ। ছেলেদের এরকম একটু আধটু দোষ থেকেই থাকে। ছেলেটা যদি গভীর রাতে বাড়ি ফেরে সেই দোষারোপও কিন্তু মেয়েটির ঘাড়ের উপর বর্তায়। মেয়েটির চালচলন ভালো নেই, স্বামীর প্রতি নজর নেই তাই ছেলেটা বাইরে ঘুরে ফিরে সময় কাটিয়ে আসে। নাহলে কীসের টানে ঘরে ফিরবে? এই হলো আমাদের সমাজে একজন নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। তাহলে একজন তালাকপ্রাপ্ত নারীর প্রতি আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হয় একবার ভাবুন। আমরা কি জানি এই সমাজে কত অসহায় নারী হাজারো শারীরিক, মানসিক অত্যাচার মুখ বুজে সব সহ্য করে সংসার করছে শুধু পরিবারের মানসম্মানের কথা চিন্তা করে, সমাজের কথা চিন্তা করে।
আবার কিছু বোকা মেয়ে আছে সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এটা কোনও প্রতিকারের পথ হতে পারে না। আমি সেইসব নারীর উদ্দেশ্যে বলতে চাই কাউকে অবলা ভাবার সুযোগ দিবে না। কিছু করে দেখিয়ে দাও এই ভঙ্গুর সমাজকে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করো। নাহলে এই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কখনোই পাল্টাবে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবলতে না পারার কষ্ট
পরবর্তী নিবন্ধটেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অগ্রাধিকার জরুরি