টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অগ্রাধিকার জরুরি

ড. মনজুর-উল-আমিন চৌধুরী | মঙ্গলবার , ২৭ জুলাই, ২০২১ at ১০:৪৬ পূর্বাহ্ণ

২০২১ সাল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছর। পঞ্চাশ বছর একটি জাতির জন্য খুব বেশি সময় না হলেও একেবারে কমও না। একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামের জাতি রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। সে সময় অনেক বিদেশি বিশ্লেষক বাংলাদেশের স্বাচ্ছন্দে টিকে থাকা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছিলেন আর হেনরী কিসিঞ্জার তো “Bottomless basket বা তলাবিহীন ঝুড়িচ বলেই উপহাস করেছিলেন। তখন বাংলাদেশের লোক সংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি আর পঞ্চাশ বছর পর স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশের লোক সংখ্যা ১৬.১৭ কোটি (বি.বি.এস.), পুরুষ ৮.১০ কোটি, নারী ৮.০৭ কোটি। লক্ষ্যণীয় যে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ মানুষের বয়স ১৫ থেকে ৫৯ এর মধ্যে। জনমিতির পরিভাষায় এটাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বা জনসংখ্যার বোনাসকাল, সুফল বলা হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশে এখন নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর চেয়ে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বেশি। সাক্ষরতার হার ৭৪.৭শতাংশ, গড় আয়ু ৭২বছর ৩মাস এর মধ্যে পুরুষের আয়ু ৭০.৮ বছর আর নারীর আয়ু ৭৩.৮ বছর। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৩ শতাংশ, মৃত্যু হার প্রতি হাজারে ৫.১জন। মাথাপিছু আয় ২২২৭ মার্কিন ডলার। জনসংখ্যায় বিশ্বে অষ্টম বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশ, যদিও আয়তনে বিশ্বে ৯২তম। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির সাময়িক হিসাব ৫.২ শতাংশ, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ৬.২ শতাংশ। আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৫.১শতাংশ হবে বলে প্রাক্কলন করেছে বিশ্ব ব্যাংক। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বাজেট লক্ষ্য ঠিক করেছেন ৭.২ শতাংশ।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলাপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপে জানা যায়, কোভিডের আঘাতের দেশে নতুন করে গরিব হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ, যা জনসংখ্যার ১৪.৭৫ শতাংশ। ২০২০ সালের জুনে দারিদ্র্যের হার ছিল ২১.২৪ শতাংশ। অপর বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেট ওয়ার্কিং অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক প্রতিবেদনে বলা হয় করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২শতাংশ। অর্থমন্ত্রী এসব জরিপের তথ্য উপাত্ত আমলে নিচ্ছেন না। বরং তিনি প্রশ্ন তোলেন, যাদের কাছে তালিকা আছে ২ কোটি, ১কোটি বা ১০জনের। আগে জানা দরকার এই তথ্য তাঁরা কোথায় পেলেন? অর্থমন্ত্রী বলেন, গবেষণা করার জন্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে যতদিন তথ্য পাওয়া না যাবে, ততদিন অন্য প্রতিষ্ঠানের তথ্য গ্রহণ করার সুযোগ নেই (প্রথম আলো, ১০জুন ২০২১)।
অমিত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। ভূ-রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ সেটা ভারত, চীন , জাপান, রাশিয়া,আমেরিকা সবারই কাছে। কথা আছে, ‘Connectivity is productivity – এ নীতিতেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে এইচএসবিসি ভবিষ্যতবাণী করেছিল ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। বৃটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা Center for Economic and Business Research এর world Economic league Table 2021 অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন যে ধরনের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি। ২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। বাংলাদেশের এ অর্জনের নায়ক হচ্ছে এদেশের জনগণ – একা সরকার নয়। এখানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছিল, সুশাসনের ঘাটতি বরাবরই ছিল, ক্রোণী ক্যাপিটাল – স্বজনতোষী বা চেলাচামুন্ডাদের অর্থনীতি এবং দুর্নীতি জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে। কিন্তু তারপরও দেশ এগিয়ে গেছে, এগিয়ে নিয়েছে জনগণ। এক্ষেত্রে ফরেন রেমিট্যান্স, কৃষি, রপ্তানি আয়, সেবাখাত, শিল্পায়ন, বিদেশি ঋণ-সাহায্য এবং ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের অবদান উল্লেখ্যযোগ্য। ২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় আছে শেখ হাসিনার নেতৃতা্বধীন সরকার। উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকারের রয়েছে রূপকল্প ২০৪১ এবং তা বাস্তবায়নে রয়েছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, ১০০ বছরের ডেল্টা প্ল্যান বা বদ্বীপ পরিকল্পনা, ব্যাপক শিল্পায়ন, কৃষি সহায়তা, সামাজিক সুরক্ষা ইত্যকার নানা কার্যক্রম। মানুষের জীবনমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকার, দেশীয় উন্নয়ন সহযোগী ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সমূহেরও কার্যকর ভূমিকা রয়েছে।
উন্নয়ন – গ্রোথ বা প্রবৃদ্ধির মূলে রয়েছে সরকারের মেগা প্রকল্পসমূহ: পদ্মাসেতু, রূপপুর তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা বন্দর, মেট্রোরেল,ঢাকা-চট্টগ্রাম চারলেন প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, মহেশখালী-মাতারবাড়ি ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভভুক্ত গভীর সমুদ্র বন্দর, বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ বেজা’র উদ্যোগে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়া ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়াও অবকাঠামোগত উন্নয়নেরও বিরাট অবদান রয়েছে। লক্ষ্যণীয় এ উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের সাথে দুর্নীতি, আত্মসাৎ ও অপচয় সহগামী হয়েছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঈর্ষণীয় সাফল্য সরকারের। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে বর্তমানে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ নেটওয়ার্কের আওতায়। তবে বিদ্যুৎ খাত নিয়ে ১৮মার্চ ২০২১ সিপিডি আয়োজিত সেমিনারের অভিমত আমলযোগ্য: “সেমিনারে, ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনা : বিশ্লেষণাত্মক কাঠামো, পদ্ধতি ও প্রভাবিত করার নিয়ামক প্রেক্ষিত’ শীর্ষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম উপস্থাপিত নিবন্ধে বলা হয়, জিডিপিতে বছরে বিদ্যুৎ খাতের অবদান বেড়েছে ১৬.৩ শতাংশ। অন্য যে কোন খাতের চেয়ে এটি বেশি। রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় করে দেশের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানানোর ফলে, বর্তমানে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৪১% বসে আছে। সিপিডি মনে করে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর ভর করে অতিরিক্ত চাহিদার প্রাক্কলনের কারণে, এটাই বিদ্যুৎখাতে নেওয়া মহাপরিকল্পনার বড় দুর্বলতা। নগরায়ন, শিল্পখাতের বিকাশ মূল্যায়ন করে বিদ্যুতের চাহিদা নির্ধারণ করতে হবে। বাপেক্সের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়ানোরও তাগিদ দেন তারা।
সিপিডি জানায়, বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান মহাপরিকল্পনা করা হয়, ২০১৬ সালে, এটি করে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। ২০১৮ সালে এটি এক দফা সংশোধন করা হয়। নতুন করে মহাপরিকল্পনার খসড়া তৈরি করতে ইতোমধ্যে জাইকার সঙ্গে চুক্তি করেছে সরকার। অনুষ্ঠানে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নতুন মহাপরিকল্পনায় বিদেশিদের সহায়তা নেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ ও সামাজিক বিজ্ঞানীদের যুক্ত করা জরুরি। বাণিজ্যিক স্বার্থ নয়, জাতীয় ও ভোক্তা স্বার্থ গুরুত্ব দিতে হবে। জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, ২০৪১ সালের রূপকল্প অনুসারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং সবার জন্য জ্বালানি নিশ্চিত করার বিষয় বিবেচনায় নিয়েই মহাপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। ২০১০ সালে করা মহাপরিকল্পনার ৬০ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে উল্লেখ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, দীর্ঘ মেয়াদে নেওয়া পরিকল্পনায় ভুল মূল্যায়নের কারণে চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হয়েছে। শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধি নিয়ে পূর্বাভাস মেলেনি। তাই স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। অর্থনীতিবিদ আনু মুহম্মদ জোর দেন নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারের উপর। তিনি বলেন, সারা দুনিয়া পারমাণবিক ও কয়লা বিদ্যুৎ থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছে। আর বাংলাদেশ সেই বিদ্যুতের দিকে ঝুঁকছে। সরকার জাতীয় স্বার্থ দেখে না। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বহুজাতিক কোম্পানি এবং রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের লবিষ্টরা প্রভাব বিস্তার করেন। তবে বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন উল্লেখ করেন সরকার শূন্য কার্বন নিঃসরণে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়েই এগোচ্ছে” (প্রথম আলো, ১৯ মার্চ ২০২১)। উল্লেখ্য অলস পড়ে থাকা কুইক রেন্টাল প্রজেক্টের জন্য গচ্ছা দিতে হচ্ছে বিশাল অংকের টাকা। এ প্রকৃতির গ্রোথ বা উন্নয়নকে ‘Sprawl Development, development without governance and transparency’ বলে আখ্যায়িত করেন অর্থনীতিবিদ-সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে কেউ কেউ। অনেকেই এটাকে কর্মসংস্থান বিহীন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটা পর্যায় বলে মনে করেন।
নানা সীমাবদ্ধতা, ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও স্বল্পোন্নত দেশ থেকে পূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন অবশ্যই গৌরবের এবং উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বড় মাইলফলক। বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানের তুলনায় ৪৫শতাংশ বেশি ধনী, অথচ ১৯৭১সালে পাকিস্তান ছিল বাংলাদেশের তুলনায় ৭০শতাংশ বেশি ধনী। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২২২৭ মার্কিন ডলার আর পাকিস্তানের মাথা পিছু আয় ১৫৪৩ মার্কিন ডলার। এটাতে আত্মতুষ্টিতে না ভোগে মূল লক্ষ্য ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হলে আশু করণীয় :
১) এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী রপ্তানী বাণিজ্য ও অন্যান্য সংকট মোকাবেলায় যথা করণীয় স্থির করে চটজলদি সক্ষমতা অর্জনের পথচলা শুরু করা : গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে পূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম সুপারিশ করেছে। সব কিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হয়ে যাবে বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার পর আরো ১২ বছর বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব ডব্লিউটিওর জেনারেল কাউন্সিলে (সাধারণ পরিষদে) উত্থাপন করেছে ডিসেম্বর ২০২০ এলডিসির চেয়ার হিসেবে আফ্রিকার দেশ চাদ। ডব্লিউটিতে এ প্রস্তাব পাশ হলে বাংলাদেশসহ ১২টি দেশ ২০৩৮ সাল পর্যন্ত এলডিসি হিসেবে প্রাপ্ত বাণিজ্য সুবিধা ভোগ করবে। তাদের প্রস্তাবটি বাংলাদেশের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ কারণ ডব্লিউটিওর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে বাণিজ্য সুবিধা হারালে এলডিসি উত্তরণের পথে থাকা ১২টি দেশের যে পরিমাণ ক্ষতি হবে এর ৯০ শতাংশই হবে বাংলাদেশের। রপ্তানী খাতেই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। সহজ শর্তের ঋণ বা বৈদেশিক সাহায্য পাওয়াও কঠিন হবে। নতুন শিল্পকে প্রণোদনা দেওয়ার শর্ত ও কঠিন হবে। ডব্লিউটিওর হিসাব অনুযায়ী এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বছরে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি ৫৩৭ কোটি ডলার বা ৪৫ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা কমতে পারে। অন্যমতে বছরে প্রায় ২৫০ কোটি ডলার বা ২১ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ রপ্তানি আয় কমবে। এ ধকল সামলানোর জন্য নিজস্ব সক্ষমতা বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। আশু করণীয় হতে পারে বিনিয়োগের সহজ পরিবেশ সৃষ্টি, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অন্তর্ভুক্তিমূলক মানব সম্পদ উন্নয়ন, কর্মসংস্থানমুখী শিল্পায়ন, কৃষি, সর্বোপরি দুর্নীতি মুক্ত ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। বৈষম্য, অসমতা হ্রাস এবং বিরাজিত বাণিজ্য সুবিধাগুলো ধরে রাখার জন্য অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে।
২) অতিমারী কোভিড -১৯ অভিঘাত সামাল দেয়া: ২০১৯ এর ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকেই করোনা ভাইরাস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে ৮মার্চ ২০২০ প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়লে ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ বন্ধ, ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে ২০২০ পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয় এবং ৩১ মে ২০২০ থেকে সীমিত আকারে কার্যক্রম শুরু করা হয় – জীবন এবং জীবিকা দু’টোই রক্ষার তাগিদে। ব্যবসা, শিল্প, বাণিজ্য, ক্ষুদ্রশিল্প, ক্ষুদ্রঋণ ইত্যকার ভুক্তভোগী ও ক্ষতির শিকার হওয়া অংশীজনদের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য তথা করোনার প্রভাব থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ১লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এতে রপ্তানীমুখী গার্মেন্টস খাতসহ, ব্যবসা, শিল্প বাণিজ্য প্রায় সব ক্ষেত্রেই ‘New Normal নতুন স্বাভাবিকতায়’ প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে এসেছে এবং অগ্রগতিও আশাব্যঞ্জক। করোনাকালে সরকারি উদ্যোগে নিম্নবিত্ত ও হতদরিদ্র মানুষের মাঝে ত্রাণ ও নগদ টাকা সহায়তা প্রদান করা হয়। পাশাপশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও ব্যক্তি উদ্যোগেও মানবতার সেবায় এগিয়ে আসার দৃষ্টান্ত অনুকরণীয়। সংখ্যার বিতর্কে না গিয়েও এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে করোনার কারণে দারিদ্রের হার বেড়েছে।
লক্ষণীয় যে, ২০২১সালের মার্চ মাসের ৩য় সপ্তাহ থেকে দেশে আবারো করোনা ভাইরাসে নতুন শনাক্ত রোগী, শনাক্তের হার এবং মৃত্যু বাড়ছে। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, করোনার তৃতীয় ঢেউ’র আশংকা ও রয়েছে। তারপরও প্রবৃদ্ধি এবং রেমিটেন্স প্রবাহেও কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। মে ২০২১ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৪.৯৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
কিন্তু সন্দেহ সংশয় হচ্ছে অবস্থাটা শেষ পর্যন্ত তৈলাক্ত বাঁশের চূড়ায় উঠার মতো হবেনা তো?
৩) টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ অর্জনের জন্য কার্যকর উদ্যোগ জরুরি : Millennium Development Goals (MDG) সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সাফল্যের পর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে (২৫-২৭ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০১৫-২০৩০ মেয়াদে ১৭টি লক্ষ্য ও ১৬৯টি টার্গেট অর্জনের উদ্দেশ্য নিয়ে Sustainable Development Goals –SDG টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা গৃহীত হয়। মানব জাতির কল্যাণে রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক অঙ্গীকারকৃত লক্ষ্যসমূহ : (১) দারিদ্র নির্মূল (২) ক্ষুধা মুক্তি (৩) সুস্বাস্থ্য (৪) মান সম্পন্ন শিক্ষা (৫) লিঙ্গ সমতা (৬) বিশুদ্ধ পানি ও পয়োঃ নিষ্কাশন (৭) সাশ্রয়ী ও নবায়ন যোগ্য জ্বালানি (৮) উপযুক্ত কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (৯) শিল্প, উদ্ভাবন ও অবকাঠামো (১০) বৈষম্য হ্রাস (১১) টেকসই শহর ও জনগণ (১২) পরিমিতি ভোগ (১৩) জলবায়ু বিষয়ক পদক্ষেপ (১৪) পানির নিচে প্রাণ (১৫) স্থলভাগের জীবন (১৬) শান্তি ও ন্যায় বিচার (১৭) লক্ষ্য অর্জনে অংশীদারিত্ব।
এ লক্ষ্য সমূহ অর্জনে সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কার্যক্রম তত্ত্বাবধান, দেখভাল ও সমন্বয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দায়িত্বে ন্যস্ত রয়েছেন একজন সচিব। সরকারি উদ্যোগের পাশাপশি রয়েছে দু’টি নাগরিক উদ্যোগ। পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ’র নেতৃত্বে পিকেএসএফ’র পার্টনার ২০০টি এনজিও’র সহযোগে একটি গ্রুপ এবং অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে দেশী এবং আন্তর্জাতিক এনজিও এবং দাতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সিটিজেন প্ল্যাটফরম সক্রিয় রয়েছে এসডিজি কার্যক্রম বাস্তবায়নে। তাছাড়াও রয়েছে নানা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত উদ্যোগ। এসডিজি’র সাফল্য সদস্য রাষ্ট্র সমূহের কার্যকরী ভূমিকার উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। বাংলাদেশ এমডিজি’র লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়েছে। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসডিজি সম্মেলন ২০১৫ এ তাঁর বক্তৃতায় এসডিজি’র লক্ষ্যসমূহ অর্জনে বাংলাদেশের দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা ব্যক্ত করে বলেন, “As we surprised the world with our MDG achievements. We are committed to lead by example again in case of SDG. In our journey, no one will be left behind as we aspire to build a just progressive, peaceful and prosperous Bangladesh. Let us commit our will and wealth for our present and future. ”আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় অঙ্গীকারে আস্থাশীল ও আশাবাদী। জয়তু বাংলাদেশ।
লেখক : সমাজবিজ্ঞানী ও সিনেট সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, ঘাসফুল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতালাকপ্রাপ্ত নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধ‘বুক চিন চিন’ এরপর আবারও ট্রেন্ডিংয়ে পাবেল