তাঁরা আমাদের আলোর দিশারী

আরিফ রায়হান | বুধবার , ৯ ডিসেম্বর, ২০২০ at ১০:৩৬ পূর্বাহ্ণ

‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে
কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে।
কত বিপ্লবি বন্ধুর রক্তে রাঙা, বন্দীশালার ওই শিকল ভাঙা
তাঁরা কি ফিরিবে আজ সুপ্রভাতে
যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে’।
আমাদের জাতীয় ইতিহাসে মহান মুক্তিযুদ্ধ এক বীরত্বপূর্ণ ঘটনা। প্রাণের স্বাধীনতা অর্জন করতে গিয়ে বহু প্রাণ দিতে হয়েছে। বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অনেক বেদনাবিধুর দিনের মধ্যে ১৪ ডিসেম্বর চরম দুঃসহ স্মৃতিঘেরা একটি দিন। ১৯৭১ সালের ষোল ডিসেম্বর বাঙালি জাতি যখন পাক সেনাদের শক্তি নিঃশ্বেষ করে স্বাধীনতা লাভের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায় ঠিক তখন পাক শাসক গোষ্ঠী পরাজয় নিশ্চিত জেনে পিছু হটতে থাকে। তখন তারা বাঙালি জাতিকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, চিকিৎসার দিক থেকে মেধাশূন্য করে দেয়ার ফন্দি আটে। সেই চক্রান্তের ফল হিসেবে বিজয়ের দুইদিন আগে চৌদ্দ ডিসেম্বর স্বাধীনতা বিরোধী এ দেশীয় রাজাকার আলবদর, আল শামস বাহিনীর সহযোগিতায় নির্মমভাবে হত্যা করে এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের। এই নীল নকশা অনুযায়ী তারা একে একে হত্যা করে প্রগতিশীল ও মুক্তচিন্তার মানুষখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, নাট্যকার, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে। তাঁদের অনেককেই ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ঘাতকরা। তাঁদের লাশ পাওয়া যায় রায়ের বাজার বধ্যভূমিসহ বিভিন্ন এলাকার বধ্যভূমিতে। এছাড়া অনেকের লাশেরও সন্ধান পায়নি তাঁদের স্বজনরা। এই পরিকল্পিত গণহত্যাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত।
১৯৭২ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে শহীদ হয়েছিলেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২জন আইনজীবী এবং শিল্পী, সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী ১৬ জন। এছাড়া অসংখ্য অগণিত বুদ্ধিজীবী ঘাতকদের হাতে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ এন এম মুনীর চৌধুরী, ড. জিসি দেব, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, আবদুল মুকতাদির, এস এম রাশীদুল হাসান, ড. এন এম ফয়জুল মাহী, ফজলুর রহমান খান, এ এন এম মুনীরুজ্জামান, ড. সিরাজুল হক খান, ড. শাহাদাত আলী, ড. এম এ খায়ের, এ আর খান খাদিম, মো. সাদেক, শরাফত আলী, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মীর আবদুল কাইয়ুম, হবিবর রহমান, সুখরঞ্জন সমাদ্দার, ড. আবুল কালাম আজাদ। সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, খোন্দকার আবু তালেব, নিজামুদ্দীন আহমদ, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, শেখ আবদুল মান্নান (লাডু), সৈয়দ নজমুল হক, এম আখতার, আবুল বাসার, চিশতী হেলালুর রহমান, শিবসদন চক্রবর্তী, সেলিনা পারভীন। এছাড়া শিল্পী আলতাফ মাহমুদ, সাহিত্যিক পূর্ণেন্দু দস্তিদার, মেহেরুন্নেসা, দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা প্রমুখ। বছর ঘুরে আবারও আমাদের সামনে আসছে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। এবার বৈশ্বিক মহামারি করোনার মধ্যেও দিনটিতে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে জাতি স্মরণ করবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।
ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস, গৌরবের মাস। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অগণিত প্রাণের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এই স্বাধীনতা যুদ্ধের পেছনে রয়েছে অনেক সংগ্রাম, বহু ত্যাগ ও দীর্ঘ অপেক্ষা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের মহান বিজয়। ১৬ ডিসেম্বর আমরা উদযাপন করি বিজয় দিবস। দিনটি আমাদের গৌরব ও অহঙ্কারের একটি দিন। ১৯৭৩ সালে ১৪ ডিসেম্বর ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ এবং ১৬ ডিসেম্বর ‘বিজয় দিবস’ বলে ঘোষিত হয় এবং দিন দুটি সেভাবেই উদ্‌যাপিত হয়ে আসছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শুধু বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করাই যথেষ্ট নয়, উন্নত জাতি গঠনে তাদের আদর্শ ও চিন্তা চেতনা আমাদের ধারণ করা দরকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভুলবো না কেউ
পরবর্তী নিবন্ধফিরিঙ্গী বাজার ওয়ার্ডে মসজিদ উন্নয়ন কাজে অনুদান