জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি আমাদের জাতীয়তাবাদী ও স্বাধিকার আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ উত্তাল সময়কার এক প্রামাণ্য দলিল বললে ভুল হবে না। সময়োচিত চলচ্চিত্রটি জাতির ওপর প্রবল প্রভাব ফেলতে পেরেছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনে অপ্রতিরোধ্য প্রভাব ফেলেছিল সেটা অস্বীকার করা যাবে না। চলচ্চিত্রটি ওই সময়ে যথার্থই সাহসিকতা সঙ্গে নির্মাণ করেছিলেন জহির রায়হান। যার জন্য সেন্সার ছাড়পত্র পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। মনে পড়ে, জহির রায়হান ঘোষণা দিয়েছিলেন ছাড়পত্র না পেলে ছবিটি ছবিঘরের পরিবর্তে দেশজুড়ে প্রদর্শন করবেন। তাঁর ওই ঘোষণা এবং সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে প্রতিবাদের মুখে বাধ্য হয়ে ছবিটির ছাড়পত্র দিতে বাধ্য হয় সেন্সার বোর্ড কর্তৃপক্ষ।
সেই সময়কার আন্দোলন সংগ্রামের প্রামাণ্য দৃশ্যাবলী ছবিতে নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছিল। ছবিতে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় ছিল ‘চাবির গোছা’, যা ক্ষমতার প্রতীক হিসেবেই গণ্য করা যায়। চাবির গোছা হস্তান্তর ক্ষমতার হস্তান্তরের প্রতীকী রূপ। চাবির গোছার হাত-বদল ক্ষমতারই হাত-বদল। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে। সামষ্টিক মানুষের কাছে যে ক্ষমতা পৌঁছুতে পারবে না, সেটা কি জহির রায়হান আগাম আঁচ করতে পেরেছিলেন! একজন ঔদ্ধত্য ও পিতৃতান্ত্রিকতার প্রতীক নারীর স্বেচ্ছাচারী কর্তৃত্বে পরিবারের প্রতিটি সদস্য তঠস্থ। কিন্তু তার একক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে কেউ মুখে টুঁ শব্দটি করতে সাহস পায় না। হঠাৎ পরিবারে তার ভাইয়ের বউয়ের আগমন ঘটে। তার আগমনে পরিবারটিতে বদলের হাওয়া লাগে। নানা ঘটনাক্রমে পরিণতি দাঁড়ায় চাবির গোছার হস্তান্তর। ভাইয়ের বউটি আপাত নিরীহ কিন্তু চাবির গোছা হাতে পেয়ে খুশিতে দিশেহারা হয়ে পড়ে। এমন কি নিজ বোনের সাথে সন্তান বিনিময়ে রুদ্রমূর্তি ধারণ করতে বিলম্ব করে না। চাবির গোছা পক্ষান্তরে কর্তৃত্বের ‘ক্ষমতা’, সেটি পেয়ে নিরীহ মানুষটির মধ্যেও পিতৃতান্ত্রিকতার নানান উপাদান ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি দেশ-জাতিকে একটি পরিবারের ভেতর দিয়ে প্রতীকী হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন জহির রায়হান। আমরা পাকিস্তানি সামরিক, বেসামরিক আমলাতন্ত্রের অধীনে গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রেই অধিকার বঞ্চিত ছিলাম। জহির রায়হান পুরো বিষয়গুলো যেমন প্রামাণ্য চিত্রকল্পে তুলে এনেছেন, তেমনি রূপক বা প্রতীকী হিসেবে চলচ্চিত্রে তুলে ধরেছেন নানা দৃশ্যাবলী।
ভাষা আন্দোলনের শহীদ দিবসের বাস্তব ফুটেজ ধারণ করে চলচ্চিত্রে সংযুক্ত করেছেন। মিছিল, সমাবেশ, পুলিশের গুলিবর্ষণ হতে স্বাধিকার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরে ওই সময়কার ঘটনাগুলোকে প্রামাণ্য প্রমাণ হিসেবে জাতির কাছে তুলে ধরেছেন। যেটি ওই সময়ে অন্যকোন চলচ্চিত্রে দেখা যায় নি। জহির রায়হান রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন, ছিলেন সাহসীও বটে। আমাদের মুক্তি সংগ্রামে অবিচ্ছেদ্য ছিলেন বলেই সাংস্কৃতিকভাবে অসামান্য দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
প্রতি ২১ ফেব্রুয়ারিতে আমরা কাকভোরে প্রভাতফেরিতে খালি পায়ে হাতে ফুল বুকে কালো ব্যাজ পরে আজিমপুর কবরস্থানে যেতাম এবং সেখান থেকে শহীদ মিনারে। তখন শহীদ মিনারে কিংবা শহীদদের কবরস্থানে আগে বা পরে যাবার ক্ষেত্রে কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না। আমাদের নিকটবর্তী কবরস্থানে শহীদদের কবরে ফুল দিয়ে হাতে থাকা অবশিষ্ট ফুল নিয়ে যেতাম শহীদ মিনারে। কোনরূপ ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি ছিল না। সবাই অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ভাবে প্রভাতফেরিতে অংশ নিতো। শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবহারের প্রয়োজন পড়তো না। তখন মানুষের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধীনতার সুগভীর চেতনা ও অঙ্গীকার ছিল ক্রিয়াশীল। শহীদ মিনারে শহীদ বরকতের মা আসতেন, তাঁকে দিয়েই ফিতা কেটে শহীদ দিবসের কর্মসূচির সূচনা হতো। শহীদ মিনারের সামনের সড়কের পরিসর ছিল ছোট। উল্টোদিকে ছিল পেট্রোল পাম্প। রাস্তাটিও পলাশীর এসএম হলের সামনের রাস্তার সমান মাপের ছিল না। অগণিত মানুষের পদচারণায় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার উদ্ভব কখনো ঘটেনি। দেখা যেতো না কোনপ্রকার অপ্রীতিকর ঘটনাও। শোক দিবসে নীরব শোকাবহ থাকতো দিনব্যাপী আশপাশ।
মনে পড়ে, একুশের প্রভাতফেরিতে আজিমপুর কবরস্থানে ঢুকেই দেখতে পাই নায়ক রাজ্জাককে প্রচুর মানুষ পেছন থেকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। রাজ্জাকের পরনে হালকা হলুদ পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা ও খালি পা। অতি উৎসাহীদের চাপে তার ত্রাহি অবস্থা। তাদের সম্মিলিত চাপে রাজ্জাক বিপদাপন্ন। ছোট খাটো গঠনের জহির রায়হান গলায় আলো মাপার যন্ত্র ঝুলিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ছটফট করছেন। কতিপয় ব্যক্তি চলচ্চিত্রের ইউনিটের লোকদের উদ্দেশ্য করে বলে, ‘শোক দিবসে তারা এসেছেন সিনেমার সুটিং করতে, ফালতু যত্তোসব’। তারা কি জানতো এই সিনেমাই আমাদের স্বাধীনতার অভিমুখের অভিযাত্রায় পুরো জাতিকে শাণিত করবে। উৎসুক কৌতূহলী মানুষের জটলায় ছবির সুটিং ব্যাহত হয়। কিন্তু উদ্যোমী জহির রায়হান দমে যাবার পাত্র নন। কিছু শুভার্থী ও ছাত্র নেতৃবৃন্দের সহায়তায় বহু কষ্টে সুটিং সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন সেদিন।
জীবন থেকে নেয়া ছবিটি দর্শকপ্রিয়তা যেমন পেয়েছিল, তেমনি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাংস্কৃতিকভাবে অসামান্য অবদানও রেখেছিল। আমাদের জাতীয়তাবাদী, স্বাধিকার আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের কেন্দ্রে নিশ্চয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতার খণ্ড খণ্ড মিছিল। মিছিলে গুলিবর্ষণের ঘটনা এবং কতিপয় ছাত্র-জনতার আত্মদানের পরই সারা দেশ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ফলশ্রুতিতে একুশের হাত ধরেই আমাদের জাতীয়তাবাদী চূড়ান্ত উন্মেষ এবং শেষ পরিণতিতে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদ্বয়।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের মাতৃভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, রাষ্ট্রভাষা রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে বিরাজমান নয়। বিশেষ করে উচ্চ আদালতে তো বাংলা ভাষা ব্রাত্য। ওখানে বিচারকার্য, রায় সমস্তই ঔপনিবেশিক ভাষা একক কর্তৃত্ব করে আসছে। এছাড়া আমাদের ত্রিমুখী শিক্ষাক্রমে কেবল মাধ্যমিক স্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন রয়েছে। ইংরেজি ও মাদ্রাসা শিক্ষাক্রমে বাংলা ভাষার চল নেই- বলা চলে। দেশে ব্যাঙের ছাতার ন্যায় গজিয়ে ওঠা শিক্ষা-বাণিজ্য তথাকথিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। অথচ সর্বস্তরে বাংলা ভাষার দাবি নিয়েই ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতার সূতিকাগার। অথচ মাতৃভাষা বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেলেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার অবাধ প্রচলন ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে পড়ছে। আশাহত ও স্বপ্নভঙ্গের দোলাচলের আবর্তে আমরা ঘুরপাক করছি। আশাবাদী হবার লক্ষণ কিন্তু দেখছি না।
অথচ বহু ত্যাগ-আত্মত্যাগের স্বাধীনতা প্রকৃতই ক্ষমতার হাত-বদল ঘটেছে। জনগণের ক্ষমতায়ন ঘটেনি। যার পূর্বাভাস জীবন থেকে নেয়া ছবিতে চাবির গোছার হাত বদলের ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন জহির রায়হান। বাস্তবেও ঘটেছে ক্ষমতার কেবলই হাত বদল। অধিক ত্যাগ-আত্মত্যাগের আমাদের স্বাধীনতা প্রকৃতই সমষ্টিগত মানুষকে ক্ষমতার অংশীদার করতে পারেনি, প্রকৃত অর্থে করেনি স্বাধীনও, দেয়নি মুক্তিও।
নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত