বৃক্ষ : দূর প্রহরের স্মৃতি ও সত্তার উজ্জ্বল উদ্ধার

প্রদীপ খাস্তগীর | রবিবার , ২০ মার্চ, ২০২২ at ৮:২৭ পূর্বাহ্ণ

বৃক্ষ ছায়াতলে দাঁড়িয়ে দূর-প্রহরের স্মৃতি ও সত্তার উজ্জ্বল উদ্ধার; চমকপ্রদ আলো জ্বলমল উদ্ভাস, বৃক্ষ ও মানুুষের মাঝে মিল ও অমিল দুই-ই আছে; মানুষের প্রাণ আছে, বৃক্ষেরও আছে। বৃক্ষের পত্র পল্লব, ডালপালা, শাখা-প্রশাখা আছে। মানুষের ও শাখা-প্রশাখা আছে- পরিবার, সন্তান-সন্ততি এবং উত্তরাধিকার আছে। অমিল হলো বৃক্ষ মৃত্তিকা- গভীরে শিকড় ছড়ানো আকাশমুখী হয়ে দাঁড়ানো সপ্রাণ বনজ, ফলদ বা ঔষধী উদ্ভিদ আর মানুষ চলমান ও ভ্রাম্যমাণ। মানুষের জীবনটাতে আনন্দ-মধুর ও বেদনা-বিধূর বর্ণিল কোলাজ থাকবেই; যদি তা আমরা খুঁজে পেতে পারি।
যে বৃক্ষটি এখন হাতের কাছে তার ডালপালা ও পত্র-পল্লব নেই, তবে বেশ বড়সড়। এই বৃক্ষ’র পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩১০। প্রকাশক বলাকার জামাল উদ্দিন বইটির রচয়িতা ওসমান গনি মনসুরকে বৃক্ষমানব এবং একই ভাবে পরিযায়ী পাখির অভিধায় অভিষিক্ত করেছেন নানান আবশ্যিক ও সঙ্গত কারণেই।
সৃজনশীল লেখক বা গ্রন্থকার হিসেবে ওসমান গনি মনসুরের খুব একটা পরিচিতি না থাকলেও সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার জগতে অভিজ্ঞতার পরিধি সুদীর্ঘ অর্ধযুগ অতিক্রান্ত এবং দেশে-বিদেশে সফল সাংবাদিক হিসেবে তিনি সমাদৃত। কলেজ জীবনে শখের ক্যামেরায় ছবি তোলাটা ছিল তাঁর এক দূরন্ত নেশা। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে তিনিই প্রথম ও একমাত্র পেশাদার ফটো-রিপোর্টার। এরপর থেকে তাঁর পথচলা শুরু। ধাপে ধাপে অনুসন্ধানী প্রতিবেদকের দায়িত্ব পালন শেষে বর্তমানে তিনি দৈনিক সংবাদপত্র সম্পাদক হয়ে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন। সুতরাং অনুমেয় সংবাদপত্র জগতে তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারটি ঋদ্ধি ও সমৃদ্ধ।
সৃজনশীল লেখালেখির জগতে ওসমান গনি মনসুর ধারাবাহিক না থাকলেও তাঁর জানা-শোনা ও দেখার পরিধির সীমানা অসীম। পেশাগত কারণে ও জ্ঞান আহরণে বা পর্যটক হিসেবে বিশ্বের ৮৭টি দেশের কয়েক শ’ নগর-মহানগর-বন্দর এবং ভূ-স্বর্গে পা রেখেছেন এবং উড়েছেন ও দেখেছেন পরিযায়ী পাখির মতন। তাই বৈশ্বিক বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ভাণ্ডারটি যথেষ্ট ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ। এই ভাণ্ডারে সৃজনশীল লেখালেখির রসদ ও সম্পদ তো থাকবেই, তারপরও তিনি নিভৃতচারী।
বৃক্ষ’র রচয়িতা ওসমান গনি মনসুরের জীবন তরী তটিনীর নানান ঘাটে ভিড়েছে। তিনি তরী থেকে তটিনীর দু’তীরের মানুষ ও প্রকৃতির রূপ-রস-সুষমা পান করে সিক্ত হয়েছেন। এরই অল্প-বিস্তর চাষাবাদে জন্ম বা সৃজিত বৃক্ষ’র পুষ্প সূচিয়েত পাঁচটি অধ্যায়ে মোট ৫৮টি ছোট-বড় বৃক্ষরাজি রয়েছে। এগুলো হলো-
কেচ্ছা-কাহন, গল্প অল্প, জীবন কথা, চেনা-অচেনা ভুবন। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত লেখক ওসমান গনি মনসুর প্রণীত বৃক্ষ গ্রন্থটিকে সাহিত্য-সৃজনের কোন সুনিদ্দিষ্ট ধারায় ফেলা ফুরফুরে, স্বাদ ও সরসম্পূর্ণ ও গতিশীল। সর্বোপরি সাহিত্যমানে সমুজ্জল। স্থান-কাল-পাত্র-চরিত্র চিত্রণের বর্ণনা মেদবর্জিত তবে স্বচ্ছ সলিলের ঝর্ণাধারার মত ছন্দময় ও সুখপাঠ্য। গ্রন্থরচয়িতা ওসমান গনি মনসুর বনেদী ও অভিজাত পরিবারের সন্তান হলেও চলা-ফেরায় ও যাপিত জীবনে অতিসাধারণ।
শৈশব থেকে বেড়ে ওঠার সময়ে মেলা-মেশার জগতে বহুজনের সাথে হৃদ্যতা ও সখ্যতা মেধা-মননে পুষ্টির যোগান দিয়েছে। এই পুষ্টিদাতারা গুণীজন হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা অনেকেই নেই বা কেউ কেউ নিস্প্রদীপ হয়ে নীরবে-নিভৃতবাসী হয়েছেন। গ্রন্থে তাদের নিয়ে লেখা বা স্মৃতিচারণে নস্টানজিয়ান বোদ-জ্যোৎস্নার ঝিলিকের আখ্যানগুলো আনন্দমধুর ও বেদনা-বিধূর সুরতরঙ্গ তোলে। গ্রন্থের জীবন কথা অধ্যায়ে ‘সাইফুদ্দিন এবং তার দু’আনার মিরাকল তরবারী’, ‘নিভৃতে পরাভবে শিল্পী এনায়েত’, ‘হাসান শাহরিয়ার : এক অর্চিস্মান সংবাদযোদ্ধা’ লেখার তিন চরিত্রই ওসমান গনি মনসুরের পরমাত্মীয় ও প্রয়াত। এই তিনটি লেখায় যেনবা বর্ণমালাহীন ভায়োলিনের সুর সাধন করেছেন, অল্প-বিস্তর খমকও বাঁজিয়েছেন লেখক। এই গ্রন্থের অমূল্য রতন একালের ঋষিজ শিল্পী ধ্রুব এষ এর প্রচ্ছদকর্ম।
আগেই বলা হয়েছে ‘বৃক্ষ’ আত্মজৈবনিক, স্মৃতিচারণ, ভ্রমণ, পাঁচালী, আখ্যান বা শুধুমাত্র গল্প বলা নয়; অভিজ্ঞতালব্ধ স্বাদ, দর্শন ও অর্জনের বিচিত্র উপলব্ধি-অনুভূতির পাঁচ মিশেলি একটি সাহিত্যমান সমৃদ্ধ সাবলীল গদ্যভাষ্য। বৃক্ষ গদ্যভাষ্যের নির্মাণ শৈলীর কারিগর ওসমান গনি মনসুর যেতে পারেন বহুদূর। বহুদূর পাড়ি দেয়ার মত মাল-মসল্লা ও রসদ-পত্র তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে সঞ্চিত আছে প্রচুর। তা সিঞ্চনে পেতে পারি অমূল রতন।
বৃক্ষ’র ভূমিকা লিখেছেন ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর এস সিকান্দার খান। তিনি গ্রন্থরচয়িতা ওসমান গনি মনসুরের অগ্রজ প্রতিম। তিনি লিখেছেন, বৃক্ষ জুড়ে একজন সচেতন লেখকের নিজের দেশ পরিপার্শ্ব এবং বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নানা শিরোনামে বিধৃত। লেখাগুলো কানানুক্রমিক নয়, বরং বিষয় বৈচিত্র্যের ভিত্তিতে বিন্যস্ত।
প্রফেসর এম. সিকান্দর খান যথার্থ লিখেছেন যে, বইটি পাঁচটি পরিচ্ছেদে (লেখকের ভাষায় অধ্যায়); পূর্বাপর সম্পর্ক নয়। হ্যাঁ, লেখাগুলোতে একাধিক সভ্যতার পরিচিতি ও পরিপার্শ্বিক বর্ণনায় পাঠকুল সম্মোহিত হবেন এবং পরিবেশ ও পরিস্থিতির সমন্বয় সাধনে প্রত্যয়ী হবেন- এখানেই লেখকের সার্থকতা নিহিত।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের হাত ধরেই নবনাট্যধারার সূচনা হয়। ঢাকার সাথে সাথে চট্টগ্রামেও নব নাট্যধারার ঢেউ লাগে। প্রতিষ্ঠিত ‘থিয়েটার’ ৭৩, অরিন্দম, তির্যক, গণায়নসহ বেশ কটি গ্রুপ থিয়েটার। অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা নাট্যজন সদরুল পাশার অনুরোধে ওসমান গনি মনসুর দলটির সাংগঠনিক গুরুদায়িত্ব পালন করেন। টানা ৪ বছর দায়িত্ব পালনের পর তাঁকে দল থেকে সরে যেতে হয় বা নিজ থেকে সরে যান। এতে তাঁর কোন ক্ষোভ বা আক্ষেপ নেই। অন্যরা দলকে এগিয়ে নিয়েছেন এবং এতেই তাঁর তৃপ্তি ও প্রাপ্তি। এ নিয়ে গ্রন্থভুক্ত একটি হৃদয়-ছোঁয়া লেখায় চট্টগ্রামের থিয়েটার চর্চার সূচনা পর্বের দালিলিক তথ্য-উপাত্ত জানা যায়। এটাও পাঠকের বড় প্রাপ্তি।
চট্টগ্রামের স্বাধীনতা পরবর্তী ও ৭৫ পূর্ববর্তী প্রথম প্রজন্মের সাংবাদিকদের মধ্যে অদ্যাবধি তিনজনের বেশি বেঁচে নেই। এঁদের মধ্যে একমাত্র ওসমান গনি মনসুর সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্র জগতের বাসিন্দা হয়েই আছেন। অন্যরা পেশা বদল করেছেন। সৃজনশীল লেখালেখিতে তাঁর আবির্ভাব ও আত্মপ্রকাশ সেকাল-একালতো বটেই ত্রিকালের জন্যই শুভ ও শুদ্ধতম বার্তা। ওসমান গনি মনসুর ‘বৃক্ষ কথায়’ যথার্থই লিখেছেন, ‘বই আপনাকে অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সকল কালে নিয়ে যেতে পারে। মানুষ মাত্রই তিন কালে বিচরণ চায়। বৃক্ষ আমারও তেমন লোভাতুর প্রচেষ্টা।’
[বৃক্ষ, ওসমান গনি মনসুর, প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ, প্রকাশক : বলাকা প্রকাশন-চট্টগ্রাম, মূল্য : ৩৫০ টাকা]
লেখক : সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধতবু আশাবাদী হতে চাই