তফাজ্জল হোসেন – প্রথিতযশা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক। বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনে অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে তাঁর অবদান বিশেষভাবে স্মরণ্য।
তফাজ্জল হোসেনের ডাক নাম ছিল মানিক মিয়া। এবং এ নামেই তিনি বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। জন্ম ১৯১১ সালে পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ায়। ১৯৩৫ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে ডিস্টিঙ্কশন সহ বি. এ পাস করেন তিনি। কর্মজীবনের সূচনা পিরোজপুর সিভিল কোর্টে। এখানেই তাঁর সাথে পরিচয় হয় বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী, অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে। সোহরাওয়ার্দীর স্নেহ-সহায়তায় তফাজ্জলের চাকরি হয় বরিশাল জেলা জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে। কিছুকাল পর চাকরি ছেড়ে সরাসরি রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়েন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর ভাবশিষ্য তফাজ্জল হোসেনকে দায়িত্ব দেন কলকাতায় অবস্থিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের দফতর সম্পাদকের। মানিক মিয়ার সাংবাদিক জীবনের সূচনা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আবুল মনসুর আহমদের সম্পাদনায় ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ পত্রিকায়। পাকিস্তান সরকার পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করলে তফাজ্জল হোসেন ঢাকায় চলে আসেন এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের দলীয় মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক’-এ যোগ দেন। পরবর্তীসময়ে তফাজ্জল হোসেন পত্রিকাটির পূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং তাঁরই সম্পাদনায় এটি দৈনিকে রূপান্তরিত হয়। এই পত্রিকাটির মাধ্যমে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে নির্ভিক তফাজ্জল তাঁর শক্তিশালী কলমকে হাতিয়ার হিসেবে তুলে নেন। ‘মুসাফির’ ছদ্মনামে ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ শীর্ষক একটি কলাম লিখতে শুরু করলে ইত্তেফাকের প্রকাশনা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরবর্তীসময়ে সামরিক আইন ভাঙা, ঐতিহাসিক ৬-দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন এবং ইত্তেফাকে তা প্রকাশ করায় একাধিকবার তাঁকে কারাভোগ করতে হয়েছে। কিন্তু তাঁর অবস্থান সবসময়ই ছিল আপোষহীন, দৃঢ়। তিনি ছিলেন প্রগতিশীল ও অসামপ্রদায়িক রাজনীতির অনুুসারী। সামাজিক শোষণ ও নিপীড়ন থেকে গণমানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন আজীবন। এদেশে বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি। শাসক গোষ্ঠীর নানা হয়রানি কিংবা প্রলোভন তাঁকে তাঁর অবস্থান থেকে টলাতে পারে নি। আমৃত্যু যুুক্ত ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের সাথেই। ১৯৬৯ সালের মে মাসে পত্রিকার কাজে গিয়েছিলেন রাওয়ালপিণ্ডি। সেখানে ৩১শে মে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর জীবনাবসান হয়।