ড. লোকানন্দ সি ভিক্ষু স্মরণে

ঝর্না বড়ুয়া | সোমবার , ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৮:১১ পূর্বাহ্ণ

লুসাই পাহাড় থেকে নেমে আসা কর্ণফুলী নদী ও তার শাখা হাদলা নদীর নৈসর্গিক নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে ভরপুর রাউজান উপজেলার বধিষ্ণু বৌদ্ধ গ্রাম পূর্ব আধার মানিক ঐতিহ্যবাহী চৌধুরী পরিবারে ১৯৫১ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি মাসে ধার্মিক পিতা প্রফুল্ল রঞ্জন বড়ুয়া ও পুন্যশীলা মাতা ধীরাবালা বড়ুয়া কোল আলোকিত করে এক পবিত্র শিশু জন্মগ্রহণ করেন। পুত্র শিশু লাভে মাতাপিতা আনন্দে আত্মহারা। শিশুকাল থেকে পরিমিত জীবনবোধ, মিতভাষী, বন্ধুবৎসল ও বিদ্যাশিক্ষার প্রতি বিশেষ ঝোঁক পরিলক্ষিত হতো। বাড়ির পাশে প্রাইমারি স্কুলে প্রথম শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি হলেও বেশি দূর পাড়ি দেওয়া সম্ভব হয়নি। হঠাৎ সহজসরল শৈশবে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। পিতা প্রফুল্ল রঞ্জন বড়ুয়ার প্রয়াণে পুরো পরিবারে দেখা দেয় অশনিসংকেত। মা শতকষ্টের মধ্যে কোনভাবে সংসারের দায়িত্ব প্রতিপালন করছেন।

ষাটের দশকে বিশ্ববরেণ্য মানবতাবাদী বৌদ্ধভিক্ষু শ্রীসদ্ধর্মভানক একুশে পদক প্রাপ্ত মহাসংঘনায়ক শ্রীমৎ বিশুদ্ধানন্দ মহাথের মহোদয়ের স্নেহধন্য ও আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে তাঁরই প্রাণপ্রিয় শিষ্য ধর্মাধিরাজ, অনাথপিতা ভদন্ত সুগতানন্দ মহাথের মহোদয়ের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে মাত্র নয় বছর বয়সে প্রব্রজ্যা (সন্ন্যাসী) ধর্ম গ্রহণ করলেন আর তাঁর প্রব্রজিত নাম হলো লোকানন্দ সি শ্রামণ। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়ে ধর্মীয় বিনয় শিক্ষার প্রতি গভীর মনোযোগী হয়ে পাকিস্তান পালি ও সংস্কৃত বোর্ডের অধীনে কৃতিত্বের সাথে সুত্র পিটক ও বিনয় পিটক বিশারদ উপাধি লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে জীবনের আরেক মাহেন্দ্রক্ষণ সংঘনায়ক শ্রীমৎ শুদ্ধানন্দ মহাথের মহোদয়ের উপাধ্যায়ত্বে এবং শ্রদ্ধেয় গুরুদেব ধর্মাধিপতি ভদন্ত সুগতানন্দ মহাথের মহোদয়ের আচারিয়ত্বে পবিত্র ভিক্ষু উপসম্পদা(সন্ন্যাসী উচ্চ পদ তথা শিক্ষক পদে বরিত হন) লাভ করেন। পবিত্র ভিক্ষুর নামকরণ করা হয় লোকানন্দ সি ভিক্ষু।

তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থী ভদন্ত লোকানন্দ সি ভিক্ষু শিক্ষার প্রতি অত্যন্ত মনোযোগী আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিভিন্ন দেশে শিক্ষা বৃত্তির অনুসন্ধানে করতে লাগলেন। সততা, একাগ্রতা ও শ্রম দিয়ে আত্মপ্রচেষ্টায় সাধনা করে ১৯৭৩ সালে ভদন্ত লোকানন্দ সি ভিক্ষু বিশ্ব বৌদ্ধ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক বৃত্তি ‘শ্রীলংকা জাতিকা সর্বোদায়া শ্রমদানা সঙ্গমায়া’ অধীনে ‘ক্যালোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে ‘ডিপ্লোমা বুড্ডিষ্ট ষ্টাডিজ’ ও ‘ইন্ডোলজি’ বিষয়ের উপর স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। শ্রীলংকায় বুদ্ধবিদ্যা পালি, সংস্কৃত ও ধ্যান বিষয়ক গভীর জ্ঞান অর্জন শেষে সুদীর্ঘ নয় বছর অবস্থান শেষে ১৯৮২ সালের ১৬ই এপ্রিল উচ্চতর শিক্ষা লাভে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগমন করেন। ওরিয়েন্টাল বুড্ডিষ্ট স্টাডিজের সম্মানিত অধ্যাপক ড. লিউ এম প্রুডেন মহোদয়ের আন্তরিক সহযোগিতায় ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়াতে ‘হিস্ট্রি অফ রিলিজিয়ন’ বিষয়ে সফলতা অর্জন করে জ্ঞান অন্বেষণ আরো মনোযোগী হলেন। এরপর ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ‘এশিয়ান স্টাডিজ’ বিষয়ে অধ্যয়ন শেষে লং বীচ পাবলিক লাইব্রেরিতে ‘লাইব্রেরিয়ান’ পদে কাজ করতে শুরু করেন। আবার সান জোস ইউনিভার্সিটিতে ‘মাস্টার্স অফ লাইব্রেরী এন্ড ইনফরমেশন সায়েন্স’ থেকে সম্মানের সাথে মাস্টার্স ডিগ্রী কৃতিত্বের সাথে সমাপ্ত করেন। পরিশেষে ২০০৮ সালে ইউনিভার্সিটি অফ দ্যা ওয়েস্ট থেকে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। চারটি বিশ্বমানের বিদ্যাপীঠ থেকে সর্বোচ্চ এমএ, এমএলআইএস, পিএইচডি লাভ করে ত্রিশ বছর দক্ষতার সাথে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি ও পাবলিক লাইব্রেরীতে কাজ শেষে বর্তমান অবসর জীবনে বাংলাভাষার চর্চা চলমান রেখেছেন। তিনি জীবনের শুরু থেকে সময়ের যথার্থ ব্যবহার করেছেন। জ্ঞান অর্জনের অংশ হিসাবে আজীবন বই পড়ার অভ্যাস যেমন আছে তেমনি নতুন নতুন ভাষাকে আয়ত্ত করেছেন। তিনি একজন বহু ভাষাবিদ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার মধ্যে পালি, সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজী, সিংহলিজ, হিন্দী, ফ্রান্স, জার্মান, স্পেনীশ, কোরিয়ান ও ভিয়েতনামিজ ভাষার পাণ্ডিত্য রয়েছে। দেশেবিদেশে সম্মেলন, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে অংশ গ্রহণ করে মূল্যবান গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ নিবন্ধ উপস্থাপন করে স্বদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। তাঁহার প্রকাশিত বাংলা বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : . ছড়া কবিতার ছড়াছড়ি– (২০২১), বর্ণ প্রকাশ লিমিটেড, ঢাকা। ২. ছড়ার ঝিলিমিলি (২০২১), বর্ণ প্রকাশ লিমিটেড, ঢাকা। ৩. বৌদ্ধিক ও অন্যান্য কবিতা– (২০২১), বর্ণ প্রকাশ লিমিটেড। ৪. স্বদেশের মুখ– (২০২২), অগ্রদূত এন্ড কোম্পানি, ঢাকা। ৫. কবিতার প্রথম খসড়া ও তারপর (২০২৩), সৌগত প্রকাশন, ঢাকা। এছাড়া বেশ কয়েকটি ইংরেজি বই প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রবল ইচ্ছাশক্তিতে নয় বছরের পিতৃহারা অবুঝ শিশু থেকে তিনি হয়ে ওঠেছেন একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক, সাহিত্যপ্রেমী, সৃষ্টিশীল আধুনিক কবি, লেখক, প্রবন্ধকার, সুগবেষক, অনুবাদক ও মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব। লেখক: প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধযৌতুককে না বলতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধরমজানের প্রস্তুতি