ড. মঈনুল ইসলামের কলাম

| বৃহস্পতিবার , ৩ জুন, ২০২১ at ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ

সংবিধানের ২০(২) ধারা : কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে পারিবেন না
বাংলাদেশের সংবিধানের ২০(২) ধারা বলছে,“রাষ্ট্র এমন অবস্থাসৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না এবং যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিমূলক ও কায়িক্তসকল প্রকার শ্রম সৃষ্টিধর্মী প্রয়াসের ও মানবিক ব্যক্তিত্বের পূর্ণতর অভিব্যক্তিতে পরিণত হইবে।” সংবিধানের ইংরেজী ভাষ্যে অনুপার্জিত আয়কে ‘Unearned Incomes’ অভিহিত করা হয়েছে। এই সাংবিধানিক ধারার উদ্ধৃতি দিতে হলো এজন্যে যে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী মহোদয় ‘যতদিন অপ্রদর্শিত আয় থাকবে ততদিন বাজেটে তা সাদা করার ব্যবস্থা থাকবে’ এই বক্তব্যটি দিয়ে সরাসরি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রত্যেক মন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের সময় দেশের সংবিধানকে সমুন্নত রাখার শপথ নিয়েছেন। অতএব, কোন ব্যক্তি যাতে ‘অনুপার্জিত আয়’ ভোগ করতে না পারে সেটা নিশ্চিত করা তাঁদের অবশ্য-পালনীয় সাংবিধানিক কর্তব্য। সংবিধানে ‘অপ্রদর্শিত আয়’ বা ‘Undisclosed Income’ বলে কোন টার্ম নেই, ওটা ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের টার্ম। ঐ টার্মটি সম্পূর্ণভাবে অসাংবিধানিক, যেটি ব্যবহারের মাধ্যমে তখনকার সরকার ‘অনুপার্জিত আয়ের’ সমস্যাটিকে লঘু বা গৌণ করার ব্যবস্থা করেছে। সংবিধানের বর্ণিত ‘অনুপার্জিত আয়’ মানেই কালো টাকা, যেটাকে শুধু ১০ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করার ব্যবস্থা চালু রেখে সরকারের নীতি-প্রণেতাগণ সংবিধান লঙ্ঘরুতর অপরাধ করে চলেছেন। এটা যে কত বড় অনৈতিক ও অসাংবিধানিক অপরাধ, তা আমাদের সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বকে স্বীকার করানোর জন্যে দেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কি ‘সুয়ো মোটো’ রায় প্রদান করতে পারেন না, কিংবা দেশের প্রথিতযশা আইনজীবীদের কেউ হাইকোর্টে ‘পাবলিক ইন্টারেস্ট মামলা’ দায়ের করতে পারেন না?
সম্প্রতি এই বিষয়ে ইংরেজি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ‘দি ডেইলী স্টারের’ ২৪ মে ২০২১ তারিখের স্টার বিজনেস সেকশানের চতুর্থ পৃষ্ঠায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর অবসরপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন আহমদের একটি মতামত কলামে (‘Should Black Money by Legalised in FY 22?’) বিষয়টি সম্পর্কে কিছু সুনির্দিষ্ট মতামত ব্যক্ত হয়েছে যেগুলোকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের বিবেচনা করা উচিত মনে করি, কারণ ওগুলো একজন সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যানের সুচিন্তিত বক্তব্য। (নাসিরকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ছাত্র হিসাবে পেয়েছি, তাই কলামে তাঁকে নাসির নামেই সম্বোধন করবো)। তিনি হিসাব দিয়েছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে মোট ৩০,৮২৪ কোটি টাকা ‘অপ্রদর্শিত আয়’ কালোটাকা সাদা করার সরকার-প্রদত্ত সুবিধা ব্যবহার করে ‘প্রদর্শিত আয়ে’ পরিণত হয়েছে এবং এ-বাবদ সরকার ৩,৯০০ কোটি টাকা কর-রাজস্ব সংগ্রহ করেছে। কিন্তু, এ-বছর ব্যতিরেকে অন্য কোন বছর খুব বেশি অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শিত হয়নি। বর্তমান অর্থ-বছরে সুনির্দিষ্ট কিছু খাতে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগ করলে আয়ের সূত্র সম্পর্কে কোন সরকারি মহল থেকে কোন প্রশ্ন করা হবে না মর্মে সুবিধা দেওয়াতেই (এবং হয়তো করোনা মহামারির কারণেও) এ-বছর প্রদর্শিত আয়ের এমন স্ফীতি পরিলক্ষিত হয়েছে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলছেন, দেশের সংবিধানে এভাবে অনুপার্জিত আয় প্রদর্শনের কোন সুযোগ রাখা হয়নি। এহেন অনুপার্জিত আয় কর-ফাঁকি, মানি লন্ডারিং এবং ইনফর্মাল ইকনমি (দুর্নীতি) থেকে উদ্ভূদ হয়ে থাকে। ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশে যে আয়কে ‘অপ্রদর্শিত আয়’ অভিহিত করা হয়েছে, দেশের সংবিধান মোতাবেক ঐ আয় বৈধ সূত্র থেকে অর্জিত আয় হতেই হবে। সুতরাং, অবৈধ সূত্র থেকে প্রাপ্ত আয় (অনুপার্জিত আয়) স্বপ্রণোদিতভাবে প্রদর্শিত আয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য নয়। এসব অবৈধ আয় যেহেতু বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ড থেকে উদ্ভূদ তাই কর দিলেই তা বৈধ আয়ে (উপার্জিত আয়) রূপান্তরিত হওয়ার কোন ‘সাংবিধানিক সুযোগ’ নেই। কোন সরকারী কর্তৃপক্ষ প্রদর্শিত আয়ের সূত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারবে না্তএই সরকারি ঘোষণারও কোন সাংবিধানিক বৈধতা নেই, কারণ দেশের সংবিধান বেআইনী আয় বা অনুপার্জিত আয়কে আইনসম্মত আয়ে রূপান্তরিত করার কোন ব্যবস্থা রাখেনি। নাসির তাঁর সারণীতে দেখাচ্ছেন, শুধু ২০২০-২১ অর্থ-বছরের জুলাই-মার্চ পর্বেই ১৪,২০০ কোটি টাকা অবৈধ আয় ১০ শতাংশ কর পরিশোধের মাধ্যমে ‘প্রদর্শিত আয়ে’ পরিণত হয়েছে, যেটা বড় ধরনের একটি উল্লম্ফন। নাসির বলছেন, শুধু ১০ শতাংশ কর দিয়ে অনুপার্জিত আয়কে বৈধ আয়ে রূপান্তরিত করার সুযোগ দেওয়া সৎ করদাতাদের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক বিধায় অনৈতিক এবং অসৎ করদাতাদেরকে বেআইনী সুবিধা দেওয়ার শামিল। তিনি মনে করেন, আসলে এই সুবিধার কারণে অত্যন্ত নিম্ন ‘কর-প্রদান-সদিচ্ছা’ (tax compliance) সৃষ্টি হওয়ায় সরকারেরও খুব বেশি ফায়দা হয় না। বরং, এর ফলে সমাজের প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে ভুল ম্যাসেজ দেওয়া হয় এবং দেশের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের খারাপ ধারণা গেড়ে বসে। নাসির দেখিয়েছেন যে ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের ১৯(ই) সেকশানে স্বপ্রণোদিত হয়ে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ‘প্রযোজ্য করহারে কর পরিশোধের সাথে ১০ শতাংশ জরিমানা প্রদান’ সুবিধার মাধ্যমে। ভারতে ২০১৭ সালের অবৈধ অর্থ ঘোষণা স্কীমে ৪৯.৯০ শতাংশ ‘কর, সারচার্জ এবং জরিমানা’ দিয়ে অবৈধ অর্থ বৈধকরণের ব্যবস্থা রয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশে শুধু ১০ শতাংশ কর পরিশোধ করে অবৈধ আয় বৈধকরণের বর্তমান ব্যবস্থা নৈতিকও নয় আইনসম্মতও নয়, এটা ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের সরাসরি লঙ্ঘন। নাসির ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশটিরও যুগোপযোগী সংস্কারের কয়েকটি সুপারিশ করেছেন, যেগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা আমার কলামে অপ্রয়োজনীয়।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখনো দশ শতাংশেরও নিচে রয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ যথাযথ আয়কর সংগ্রহে সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা। আর, এই ব্যর্থতার প্রধান কারণ দুর্নীতিলব্ধ অবৈধ আয়কে (অনুপার্জিত আয়) করজালের বাইরে রেখে দেওয়ার অভিপ্রায়ে প্রতি বছর কালো টাকা সাদা করার জন্য সরকারের এই অসাংবিধানিক বাজেট-ব্যবস্থা চালু রাখা। দক্ষিণ এশিয়ায় কর-জিডিপি অনুপাত বাংলাদেশেই সর্বনিম্ন। অর্থনীতি ও রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নকে এহেন সরাসরি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান এদেশের সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের দুবৃত্ত-পোষণেরই প্রত্যক্ষ প্রমাণ, দুর্নীতির প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ শুধুই রাজনৈতিক বাত্‌-কা-বাত্‌। বিশ্বের যেসব দেশের সরকার এহেন দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি পরিত্যাগ করে সত্যিকার জনবান্ধব শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সদিচ্ছা নিয়ে দুর্নীতি দমনে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সেসব দেশ ক্রমেই উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় চমৎকার নজির সৃষ্টি করতে সমর্থ হচ্ছে। এ-ব্যাপারে সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে সিঙ্গাপুর, হংকং এবং ইন্দোনেশিয়া। সিঙ্গাপুর এশিয়ার সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ। ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত নরঘাতক সুহার্তোর চরম দুর্নীতিগ্রস্ত একনায়কত্বের অসহায় শিকার ছিল ইন্দোনেশিয়া। সুহার্তোর নিকৃষ্ট অপশাসনকেই বর্ণনা করার জন্য উন্নয়ন-চিন্তায় ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ ধারণাটির প্রবর্তন করা হয়েছিল। কিন্তু, গত ২৩ বছরে ইন্দোনেশিয়া সত্যিকার নির্বাচনী গণতন্ত্রের চর্চার মাধ্যমে দুর্নীতির ঐ অতল সাগর থেকে দেশকে উদ্ধারে সমর্থ হওয়ায় এখন ইন্দোনেশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবল জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই হয়তো জানেন না যে ইন্দোনেশিয়ার বর্তমান নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো একজন সাধারণ দর্জি ছিলেন, কিন্তু তাঁর সততা ও যোগ্যতার বলে প্রথমে রাজধানী জাকার্তার মেয়র নির্বাচিত হয়ে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে সুকার্ণো-কন্যা মেঘবতীর দল থেকে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থিতা অর্জন করেছেন এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে এখন ইন্দোনেশিয়াকে আশিয়ান জোটের একটি অর্থনৈতিক সুপারপাওয়ারে পরিণত করায় নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। ইন্দোনেশিয়ায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে উইদোদো সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন, যে কাজটি মেঘবতী নিজে করতে পারেননি। হংকং বিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকে দুর্নীতির আখড়া বিবেচিত হতো, কিন্তু আশির দশকে তারা সিঙ্গাপুরের সাফল্য অনুকরণের মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলে এক দশকে উন্নয়নের চার এশীয় বাঘের অন্যতমে পরিণত হয়েছিল।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আয়করকে সরকারের কর-রাজস্বের প্রধান সূত্রে পরিণত করতে হলে অপ্রদর্শিত আয় সাদা করার ব্যবস্থার মাধ্যমে কালো টাকাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের বর্তমান নীতি সরকারকে পরিত্যাগ করতেই হবে। কালো টাকার মালিক শুধুমাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে তার অবৈধ আয়কে বৈধ করতে সমর্থ হলে সৎ করদাতা হয়ে ১৫-২০-২৫ শতাংশ আয়কর প্রদান তো আহাম্মকি! কালো টাকার একটি ক্ষুদ্রাংশের জন্য ১০ শতাংশ কর দিয়ে পুরো অবৈধ আয়ের জন্য যদি আইনী বৈধতার সার্টিফিকেট অর্জন করা যায় তাহলে ওসব কাগজপত্র নিজের কাছে রেখে বছরের পর বছর কালো টাকার পাহাড় গড়তে থাকলে সরকার কিভাবে তা ঠেকাবে? বাংলাদেশে যে কয়েক’শ ধনকুবের পয়দা হয়েছে তাদের কতজন এক কোটি টাকার বেশি আয়কর দেন? ‘হাকিম জর্দার’ মালিক বছরের পর বছর এদেশের সর্বোচ্চ আয়কর-প্রদানকারী হচ্ছেন, ওয়েলথ-এক্স এর গবেষণায় যে ২৫৫ জন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর (কমপক্ষে ৩০ মিলিয়ন ডলার বা ২৫৫ কোটি টাকার মালিক) নাম উঠে এসেছে তাদের নাম তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! এই কালো টাকার মালিকরাই দেশ থেকে পুঁজি পাচারের প্রধান হোতা। সরকার যদি মনে করে কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থার কারণেই দেশে বিনিয়োগের জোয়ার সৃষ্টি হচ্ছে তাহলে মারাত্মক ভুল হবে। দুর্নীতিকে লালন করার পরিবর্তে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার মাধ্যমে সরকারি রাজস্বের প্রধান সূত্র হিসাবে আয়করকে প্রতিষ্ঠা করতে পারলে প্রতি বছর যে ক্রমবর্ধমান সরকারি রাজস্ব-ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ ঋণের উপর বিপজ্জনক নির্ভরশীলতার দুষ্টচক্রে সরকারকে আটকে থাকতে হচ্ছে তা থেকে সরকার নিষ্কৃতি পাবে।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল আজকাল
পরবর্তী নিবন্ধনন ক্যাডারে ৭ শতাধিক নিয়োগে পিএসসির বিজ্ঞপ্তি