জিয়াউর রহমান এদেশের একজন প্রথম সারির মুক্তিযোদ্ধা হয়েও ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সাল থেকে ৩০ মে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তাঁর পাঁচ বছর ছয় মাস তেইশ দিনের অবৈধ শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে অক্ষম্য বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পর ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান নিজের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। বিএনপিতে দেশের বাম ঘরানার ও দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকদেরকে কেনাবেচার মাধ্যমে দলে ভিড়ানোর দায়িত্বটি অর্পণ করা হয়েছিল রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে, প্রধানত সশস্ত্রবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই–কে। লাইসেন্স, পারমিট, ব্যাংকঋণ, প্লট, ইত্যাদি নানা রকমের সুযোগ–সুবিধা দিয়ে এই এসাইনমেন্টটি সম্পন্ন করেছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, প্রয়োজনে ব্ল্যাকমেইলের আশ্রয়ও নিত তারা। ক্যান্টনমেন্টে বসে রাজনৈতিক দল বানানোর এই খেলা শুরুর আগে ১৯৭৭ সালে জিয়া দেশের রাষ্ট্রপতির আসনটিও জবরদখল করেছিলেন।
বিএনপি প্রতিষ্ঠার পাঁচ মাস আঠার দিনের মধ্যেই ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজনও সম্পন্ন করেন তিনি। ঐ ব্যাপক ‘ইলেকশান ইঞ্জিনিয়ারিং–অনুসৃত’ নির্বাচনে ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে বিএনপি ২০৭টি দখল করেছিল। (পরবর্তীতে উপনির্বাচনের মাধ্যমে আরো দুটো আসন বিএনপি’র দখলে যাওয়ায় ঐ সংসদে বিএনপি’র আসনসংখ্যা ২০৯–এ উন্নীত হয়)। প্রতিষ্ঠার কয়েকমাসের মধ্যে এত বেশি আসনে একটি রাজনৈতিক দল সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী হওয়ার নজির বিশ্বে একটিও নেই। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিএনপি থেকে যে ২০৭ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তার মধ্যে মুসলিম লীগ থেকে বিএনপি’তে যোগদানকারী নেতা ছিলেন ৬৩ জন (৩০.৪৩ শতাংশ), ভাসানী ন্যাপ থেকে বিএনপি’তে যোগদানকারী ছিলেন ৩৫ জন (১৬.৯ শতাংশ), ইউপিপি ও অন্যান্য বামপন্থি ছিলেন ১৩ জন (৬.২৮ শতাংশ), ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ (যেটা জামায়াতে ইসলামীর তদানীন্তন নাম) থেকে ছিলেন ৭ জন, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার ছিলেন ১৭ জন এবং অবসরপ্রাপ্ত সিভিল আমলা ছিলেন ২৩ জন। ঐ নির্বাচনে স্বাধীনতা–বিরোধী মুসলিম লীগ থেকে বিএনপিতে যোগদানকারীরা যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন সেটাই ছিল স্বাভাবিক, কারণ বিএনপি যে পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাইনবোর্ড পাল্টানো বাংলাদেশী সংস্করণ সেটা মোটেও গোপন ব্যাপার ছিল না। বিএনপি প্রতিষ্ঠার প্রথম দুই দশকে বিএনপি’র ডানপন্থী নেতাদের মধ্যে এই সাবেক মুসলিম লীগাররাই প্রভাবশালী ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও জিয়ার পাকিস্তানী সত্তার ভুরি ভুরি প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর শাসনামলের সকল কর্মকান্ডে। নিচে উল্লিখিত জিয়ার পাকিস্তানী সত্তার অকাট্য প্রমাণগুলো দেখুন:
১) জিয়া বাংলাদেশে স্বাধীনতা–বিরোধী ও পাকিস্তানের দালাল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামের মত দলগুলোকে ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দলবিধি আদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করে গেছেন। (নেজামে ইসলাম বর্তমানে ইসলামী ঐক্যজোটের অন্তর্ভুক্ত দল হিসেবে পরিচয় গোপন করে চলেছে।)
২) ১৯৭৮ সালে মাকে দেখতে আসার নাম করে জিয়ার অনুমতি নিয়ে গোলাম আজম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে চলে এসেছিল। জিয়ার জীবদ্দশায় গোলাম আজম প্রায় তিন বছর পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থানের পরও জিয়া এ–ব্যাপারে কোন আইনগত ব্যবস্থা নেননি।
৩) জিয়াউর রহমান কয়েক শত মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছিলেন তাঁর শাসনামলে ১৮–২১ টি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের অভিযোগে। তাঁদের সকলকেই প্রাণ দিতে হয়েছিল কোর্ট মার্শালের নামে বসানো ‘ক্যাঙ্গারু কোর্টের’ বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়ে। আর, সেজন্যেই তাঁকে ১৯৮১ সালে প্রাণও দিতে হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের প্রতিশোধের শিকার হয়ে।
৪) জিয়া সকল কুখ্যাত স্বাধীনতা–বিরোধী ঘাতক–দালালকে বিএনপিতে যোগদান করার সুযোগ দিয়েছিলেন। কুখ্যাত পাকিস্তানী দালাল শাহ আজিজুর রহমানকে জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন, মির্জা গোলাম হাফিজকে (মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের চাচা) সংসদের স্পিকার বানিয়েছিলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্যে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হয়ে জেলে মৃত্যুবরণ করা আবদুল আলীমকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন।
৫) জিয়া সকল চিহ্নিত স্বাধীনতা–বিরোধী সরকারী আমলা–কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, প্রকৌশলী, ডাক্তার, পেশাজীবী ও সামরিক কর্মকর্তাকে চাকুরিতে পুনর্বাসিত করেছিলেন। তাদের প্রায় সবাই আজীবন বিএনপি’র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন।
৬) জিয়া সকল প্রচার মাধ্যমে ‘পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর’ পরিবর্তে শুধুই ‘হানাদার বাহিনী’ বলার নির্দেশ জারি করেছিলেন। জিয়া দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা বধ্যভূমি, অগ্নি–সংযোগ, শরণার্থী ক্যাম্প ও গণহত্যার চিত্র মিডিয়ায় প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
৭) পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের ইস্যুকে জিয়া কখনোই কূটনৈতিক নীতিতে অগ্রাধিকার দেননি। বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারীদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য পাকিস্তানের ওপর জিয়া যথাযোগ্য চাপ সৃষ্টি করেননি।
৮) জিয়া দেশের সকল স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এমনকি, সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ এবং কেন্দী্রয় শহীদ মিনারের পুনর্নির্মাণ কাজও জিয়ার আমলে পরিত্যক্ত হয়েছিল।
৯) জিয়া ঘাতক–দালালদের বিচার সংক্রান্ত সকল আইন বাতিল করে দেয়ায় জেলে আটক প্রায় এগার হাজার স্বাধীনতা–বিরোধীকে আর বিচারের সম্মুখীন করা যায়নি।
১০) জিয়া যেহেতু করাচীতে কৈশোর ও তারুণ্য কাটিয়েছিলেন তাই তিনি বাংলা পড়তে এবং বাংলায় কথা বলতে পারলেও বাংলা লিখতে শিখেননি। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা বানানোর সংগ্রামের পথ ধরে ধাপে ধাপে যে বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল ১৯৭৫ সালে সে বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করে ১৯৮১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত শাসন করা সত্ত্বেও জিয়া বাংলা লিখতে শেখার গরজ বোধ করেননি, ইংরেজীতেই নোট লিখতেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশে খোন্দকার মোশতাক ও অভ্যুত্থানকারী ঘাতক সামরিক জান্তা যে পরাজিত পাকিস্তানকে ফিরিয়ে এনেছিল সে পাকিস্তানপন্থি রাজনীতির ধারক–বাহক সমরপ্রভু জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে বিএনপি’র জন্ম দিয়েছিলেন এদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যাতে আর কোনদিন রাজনৈতিকভাবে জনপ্রিয় না হয় সে উদ্দেশ্যেই। তাই, জন্মসূত্রেই বিএনপি এদেশে মুক্তিযুদ্ধ–বিরোধী ভূমিকা পালনকারী ‘পাকিস্তান মুসলিম লীগের’ বাংলাদেশী উত্তরসূরি। এই ভূমিকা তারা কখনোই পরিত্যাগ করবে না। ১৯৮৩ সালে জিয়াউর রহমানের উত্তরসূরি হিসেবে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া (এবং তারেক রহমান) গত ৪০ বছর ধরে জিয়াউর রহমানের ঐ পাকিস্তান–প্রেমী রাজনীতিকে বিএনপি’র মাধ্যমে সযত্নে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন জামায়াতের সাথে পরিপূর্ণ সমঝোতায়। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের গোপন সমঝোতার কারণেই আওয়ামী লীগ অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে গিয়েছিল। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জিতেই বেগম জিয়া বরিশাল শান্তি কমিটির একজন সাবেক চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বিশ্বাসকে প্রথমে সংসদের স্পিকার এবং পরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বানিয়েছিলেন। এর কিছুদিন পর এই বেগম জিয়াই গোলাম আজমের বিরুদ্ধে গঠিত ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির’ গণ–আদালতে বিচারক হওয়ার অপরাধে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম সহ ২৪ জন দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্বকে দেশদ্রোহিতার মামলায় আসামী করেছিলেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ঐ অভিযোগ মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঐ দেশদ্রোহিতার মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। এই বেগম জিয়াই ২০০১–২০০৬ মেয়াদে ক্ষমতাসীন থাকার সময় এদেশকে মৌলবাদী জঙ্গি সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিলেন। জামায়াত–শিবিরের প্রাক্তন ক্যাডার জঙ্গি ‘কিলিং স্কোয়াডের’ সহায়তায় তারেক রহমান ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট নারকীয় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে খুন করতে গিয়ে বেগম আইভী রহমান সহ ২২ জন আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীকে হত্যা এবং প্রায় চার’শ নেতা–কর্মীকে আহত করায় এখন আদালতের রায়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত। আর, বেগম জিয়া ঐ হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেডগুলো শেখ হাসিনা তাঁর ভ্যানিটি ব্যাগে বহন করে নিয়েছিলেন বলে সংসদে বক্তব্য দিয়েছিলেন। মামলার আলামতগুলো ধ্বংস করার জন্য বেগম জিয়াই নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। একইসাথে, ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোতে চীন ও পাকিস্তানের আইএসআইয়ের অস্ত্র–সহায়তায় যে ইনসার্জেন্ট গ্রুপগুলো ভারত সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গৃৃহযুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে ওগুলোকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অভয়ারণ্য সুবিধা প্রদান এবং অস্ত্র চোরাচালানের রুট হিসেবে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের উপকূলকে অপব্যবহারের সুযোগও দিয়েছিল বেগম জিয়ার সরকার। ২০০৪ সালের এপ্রিলে চট্টগ্রামে যে দশ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়েছিল সেগুলো যে তারেক রহমানের নির্দেশে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সক্রিয় মদদে ভারতের আসাম রাজ্যের ইনসার্জেন্ট গ্রুপ উলফার জন্যই আনা হয়েছিল তা এখন আদালতের রায়েই জানা গেছে। এটাও প্রমাণিত যে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বাংলাদেশের সকল জঙ্গি অর্গানাইজেশনগুলোর অস্ত্র–যোগানদার ও সশস্ত্র–প্রশিক্ষণদাতা ছিল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার গ্রেনেডগুলোও এসেছিল পাকিস্তান থেকে।
বিএনপি’র মূল রাজনৈতিক আদর্শ পাকিস্তান–প্রেম ও আওয়ামী লীগ–বিরোধিতা, জন্ম–সূত্রেই আওয়ামী লীগের ‘নেমেসিস’ বিএনপি। প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও বিএনপি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কীভাবে জনপ্রিয় রয়ে গেল? এর উত্তর হলো, আওয়ামী লীগ বিরোধী, পাকিস্তান–প্রেমী, অন্ধ ভাসানী–ভক্ত ও মুজিব–অপছন্দকারী ্এবং হিন্দু–বিদ্বেষীরাই বিএনপি’র ‘ঘোর সমর্থক’। ক্ষমতায় গেলে যেহেতু দুর্নীতির কারণে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় ধস নামে তাই বিএনপি’র জনপ্রিয়তায় তখন জোয়ার আসে। আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর গোষ্ঠিগুলোই বারবার এই জোয়ার নিয়ে আসছে। তাদের সবাই স্বাধীনতা–বিরোধী না হলেও তারা হিন্দু–বিদ্বেষী ও ভারত–বিদ্বেষী। তারা হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে জানপ্রাণ কবুল করতেও রাজি। সেজন্যই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে অর্থনীতির সব ক্ষেত্রেই ছাড়িয়ে গেলেও বিএনপি–ভক্তদের মন গলছে না। ২০০৯–২৩ পর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ বিএনপি–জামায়াতের ২০০১–৬ মেয়াদের শাসনামলের তুলনায় চমকপ্রদভাবে এগিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বিএনপি’র জনপ্রিয়তায় বড়সড় ধস নামেনি। বর্তমানে পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বিএনপি’র পাকি–প্রেমীদের প্রেমে ভাটা পড়েনি! এদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় অনেকেই রয়েছেন যারা শেখ হাসিনার কাছে কল্কে না পেয়ে বিএনপি’তে ভিড়ে গেছেন। ২০১৮ সালে ডঃ কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি, গণফোরাম, আ,স,ম, আবদুর রবের জেএসডি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং ডাকসুর প্রাক্তন ভিপি সুলতান মনসুরের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন এহেন শেখ হাসিনা–উৎখাত–চক্র গঠনের চূড়ান্ত নজির। পরবর্তীতে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু হাসিনা–উৎখাতে বদ্ধপরিকর নেতাদের ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও ক্রোধ থেকে উৎসারিত মিশন ২০১৮ সালে বাংলাদেশের রাজনীতিকে ১৯৭৫ সালের মত আরেকটি মহাবিপর্যয়ে নিক্ষেপ করতে যাচ্ছিল। ঐ ধরনের মহাবিপদ আগামী নির্বাচনকে ঘিরে আবারো ঘনীভূত হওয়ার আলামত পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগের রাতের ব্যালট জবরদখলের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ঐ মহাবিপদ থেকে বাঁচতে পারলেও আগামী নির্বাচনে একই খেলা তারা খেলতে পারবে মনে হয়না। (তারেক রহমান কয়েকবারই ঘোষণা করেছেন,‘বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী আপন মায়ের পেটের ভাই’। তাই আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলছি বাহ্যিক দূরত্ব–রক্ষার ফন্দি–ফিকির সত্ত্বেও আগামী নির্বাচনে বিএনপি–জামায়াত আসবেই, এবং ঐক্যবদ্ধভাবেই আসবে)!
কিন্তু, এখন থেকে যদি শেখ হাসিনা সত্যিকারভাবে দুর্নীতি, পুঁজি–লুন্ঠন এবং পুঁজিপাচারের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্যভাবে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন তাহলে হয়তো আগামী নয় মাসে আওয়ামী লীগ তাদের হারানো জনপ্রিয়তা অনেকখানি পুনরুদ্ধার করতে পারবে। ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সামরিক বাহিনী–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল তার জন্য এককভাবে দায়ী ছিল ঐ সরকারের সফল দুর্নীতি–দমন অভিযান। মানুষের কাছে দুর্র্নীতি ও পুঁজি–লুন্ঠনের জন্য চিহ্নিত হোমরা–চোমরা রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদেরকে ঐ সময় যেভাবে নাকানি–চুবানি খেতে হয়েছিল সেটা এখনো জনগণ ভুলে যায়নি। ঐ ধরনের অভিযান যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবিলম্বে শুরু করেন তাহলে তাঁর নেতৃত্বে অর্জিত দেশের প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং ২০২২ ও ২০২৩ সালে বাস্তবায়িত মেগা–প্রজেক্টগুলোর সুফল তিনি আগামী নির্বাচনে ঘরে তুলতে পারবেন আশা করি।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।