গ্যাস অনুসন্ধানে অক্ষম্য ব্যর্থতার দায় কার?
সাম্প্রতিক বাংলাদেশে জ্বালানি সাশ্রয়ের উদ্দেশ্যে বিদ্যুতের লোডশেডিং এর ব্যাপক বিস্তার ঘটাতে হয়েছে। প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে ফেলতে হচ্ছে। ডিজেল-চালিত বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো বন্ধ রাখা হচ্ছে। প্রায় পঁচিশ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্যাপাসিটি অর্জন সত্ত্বেও দৈনিক উৎপাদনকে দশ/এগার হাজার মেগাওয়াটে সীমিত রাখতে হওয়ায় একদিকে লোডশেডিং যেমনি বেড়েছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অব্যবহৃত বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোকে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ হিসেবে প্রদত্ত হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ। (লোডশেডিং এর কারণে শিল্প-কারখানাগুলোর ‘ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট’ এবং জেনারেটর চালাতে হলে ডিজেল ব্যবহার বেড়ে যায়, শহরাঞ্চলের বাড়ীঘরে ব্যবহৃত জেনারেটরেও ডিজেল ব্যবহার বাড়ে। সুতরাং, আসলে যোগ-বিয়োগ করে ডিজেল-ব্যবহার কতখানি কমছে তা বলা কঠিন। লোডশেডিং যে জনদুর্ভোগ ঘটাচ্ছে এবং জনজীবনকে ব্যয়বহুল করছে তার কথা না হয় বাদই দিলাম)! একইসাথে, দেশের গ্যাস-ঘাটতিও ক্রমেই অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় গ্যাস-রেশনিং বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজি’র দাম গত দু’বছরে প্রায় দশগুণ বেড়ে যাওয়াতে দেশের এলএনজি আমদানি ব্যয় অসহনীয় পর্যায়ে উন্নীত হওয়ায় বাংলাদেশে আমদানীকৃত এলএনজি-নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতি, শিল্পনীতি এবং গৃহস্থালী জ্বালানি নীতি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে উপরে উল্লিখিত বিপর্যয়ে ঠেলে দিয়েছে বলা চলে। সেজন্যই প্রশ্ন উঠবে, বর্তমান এই বিপর্যয়কর গ্যাস-সংকটের জন্য দায়ী কে?
বিশ্বের সবচেয়ে বড় বদ্বীপ বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এরকম বদ্বীপ অঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন সাগর-উপসাগরের তলদেশগুলোই সাধারণতঃ সবচেয়ে বেশি হাইড্রোকার্বণ (তেল ও গ্যাস) খনির ভান্ডার হওয়াই স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্রের গাল্ফ ডেল্টা, ইন্দোনেশিয়ার মহাকাম ডেল্টা এবং আফ্রিকার নাইজার ডেল্টা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বঙ্গোপসাগরের ভারত উপকূলের অদূরে গোদাবরী বেসিন এবং মিয়ানমারের রাখাইন উপকূলের অদূরে বাংলাদেশের সীমানার কাছাকাছি অঞ্চলের অগভীর সাগরতলে প্রাপ্ত বিপুল গ্যাস-ভান্ডার এই তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণ করে চলেছে। অথচ, বাংলাদেশ গত কুড়ি বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে কম অনুসন্ধানকৃত বা স্বল্প-পরীক্ষিত (least explored) অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দেশের খ্যাতিমান ভূতত্ত্ববিদ ডঃ বদরুল ইমাম জানাচ্ছেন, বাংলাদেশের সম্ভাব্য গ্যাসক্ষেত্র সম্পর্কে জরিপ চালানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দৃঢ় অভিমত হলো এদেশের স্থলভাগ এবং সাগরতলে এখনো ৩২ টিসিএফ থেকে ৪২ টিসিএফ গ্যাসের ভান্ডার বিদ্যমান রয়েছে। ইউনাইটেড স্টেটস জিউলজিক্যাল সার্ভে এবং পেট্রোবাংলার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত দু’বছরের একটি মূল্যায়ন প্রকল্পের অভিমত হলো, এদেশের অনাবিষ্কৃত গ্যাস-সম্পদের পরিমাণ কমবেশি ৩২ টিসিএফ হতে পারে। নরওয়ে সরকারের অধীনস্ত নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডাইরক্টেরেট বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হাইড্রোকার্বণ ইউনিটের সাথে যৌথ জরিপ চালিয়ে মত দিয়েছে, সম্ভাব্য অনাবিষ্কৃত গ্যাস-সম্পদ ৩৮-৪২ টিসিএফ হতে পারে। এরপর র্যাম্বল নামের একটি ইউরোপীয়ান তেল ও গ্যাস কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠান জরিপ চালিয়ে মত দিয়েছে, সম্ভাব্য গ্যাসের পরিমাণ ৩৪ টিসিএফ। ডঃ বদরুল ইমাম আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছেনঃ ভারতের ক্ষুদ্র ত্রিপুরা রাজ্যে যেখানে ইতোমধ্যে ১৫০টি গ্যাসকুপ খনন করে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে সেখানে ত্রিপুরার পনেরো গুণ বড় আয়তনের বাংলাদেশের স্থলভাগে গত ৫১ বছরে অনুসন্ধান কুপ খনন করা হয়েছে একশ’র কম। অথচ, এত কম অনুসন্ধান কুপ খনন করেও বাংলাদেশে ত্রিপুরার চাইতে অনেক বেশি গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কৃত হয়েছে। বাংলাদেশের সীমানার এক-তৃতীয়াংশেরও কম এলাকায় গ্যাস-অনুন্ধান চালানো হয়েছে, অথচ বিশ্বের গড়ের চাইতে বাংলাদেশের প্রাপ্ত গ্যাসক্ষেত্রের সংখ্যা অনেক বেশি।
তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠবে, গ্যাস পাওয়ার সাফল্য সত্ত্বেও বাংলাদেশে এত কম গ্যাস-অনুসন্ধান চালানোর কারণ কী? বিশেষজ্ঞদের দৃঢ় অভিমত হলো, কয়েকজন প্রভাবশালী এলএনজি আমদানিকারকের কায়েমী স্বার্থ রক্ষার জন্যই বাংলাদেশ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা গ্যাস-অনুসন্ধানকে ‘কোল্ড-স্টোরেজে’ পাঠিয়ে দিয়ে এলএনজি আমদানিকে দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ডঃ বদরুল ইমাম জানাচ্ছেন, ২০১৫ সালে পেট্রোবাংলা বাংলাদেশের সমুদ্র-অঞ্চলের ২৬টি অনুসন্ধান ব্লকে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সার্ভিস কোম্পানির মাধ্যমে সিসমিক সার্ভে (মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে) পরিচালনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল, যাতে এই জরিপের মাধ্যমে একটি ডাটাবেজ তৈরি করে তেল কোম্পানিগুলোর সাথে অনুসন্ধানের দর-কষাকষি চালানো যায়। সবচেয়ে উপযুক্ত সার্ভিস কোম্পানি বাছাইয়ের জন্য একটি ‘জাতীয় বিশেষজ্ঞ কমিটি’ও গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু, কোন অজ্ঞাত কারণে কমিটির বাছাইকৃত যুক্তরাষ্ট্র-নরওয়েজিয়ান জয়েন্ট ভেঞ্চার সার্ভিস কোম্পানিকে সরকার বাতিল করে দিয়েছিল। ঐ কোম্পানিটি যখন বাছাইয়ের দ্বিতীয় রাউন্ডের যোগ্যতার পরীক্ষায় আবার উত্তীর্ণ হয়েছিল তখন কোন কারণ-দর্শানো ব্যতিরেকেই পুনরায় পুরো প্রক্রিয়াটি রহস্যজনকভাবে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে, পরবর্তী সাত বছরেও বাংলাদেশের সাগরতলের গ্যাস-অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটি আর এগোতে পারেনি। এই সাত বছরে আর একবারও সাগরের ২৬টি ব্লকে ‘সিসমিক সার্ভে’ চালানো হয়নি, কোন গ্যাস-অনুসন্ধানও শুরু করা যায়নি। সাম্প্রতিককালে ভারতের ‘অয়েল এন্ড ন্যাচারাল গ্যাস কর্পোরেশন’কে একটি ব্লকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব প্রদান করা হলেও তারা সাত বছরে মাত্র একটি কুপ খনন করেছে। আর কোন আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিকে এখনো বাংলাদেশের অনুসন্ধান ব্লকগুলো ইজারা দেওয়ার কাজটি সম্পন্ন করা যায়নি। উপরে উল্লিখিত অক্ষম্য ব্যর্থতার দায় কার? বাংলাদেশ সরকারের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তো খোদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে, মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন ডঃ তওফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। প্রতিমন্ত্রী জনাব নসরুল হামিদের হাতে তো মন্ত্রণালয়ের এতবড় গুরুদায়িত্ব থাকার কথা নয়!
এ-পর্যায়ে উল্লেখ্য, প্রতিবেশী মিয়ানমার এবং ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নিয়ে কয়েক দশকের বিরোধ অত্যন্ত সফলভাবে মোকাবেলা করে ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল অন ল’স অব দি সি’স (ইটলস) এবং দি হ্যাগের আন্তর্জাতিক আদালত থেকে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে বাংলাদেশ, যার পুরো কৃতিত্ব শেখ হাসিনার সরকারের। আমরা অনেকেই জানি না যে এই বিরোধে বাংলাদেশকে আইনী লড়াইয়ে হারানোর জন্যে ভারত মিয়ানমারের সাথে প্রত্যক্ষ যোগসাজশে লিপ্ত হয়েছিল। ইটলসে মিয়ানমারের পক্ষে আইনী লড়াই চালানোর দায়িত্ব নিয়েছিল ভারত, বাঘা বাঘা সব ভারতীয় আইনবিদ মিয়ানমারের পুরো মামলা পরিচালনা করেছে। এতদ্সত্ত্বেও মিয়ানমার ইটলসের ঐতিহাসিক রায় তাদের পক্ষে নিতে পারেনি। এই পরাজয়ের পর ভারত চাণক্য-চাল চেলেছিল বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার মাধ্যমে সমুদ্রসীমার ভাগ-বাঁটোয়ারা নির্ধারণ করার প্রস্তাব দিয়ে। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশের এতদ্সংক্রান্ত নীতি-নির্ধারকরা ভারতের এই কূটচালের ফাঁদে ধরা না দিয়ে (ভারতের বিরাগভাজন হয়েও) বিষয়টার সমাধানের দায়িত্ব আন্তর্জাতিক আদালতে রেখে দিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যেখানে ভারতের বাঘা বাঘা আইনবিদদের যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে আদালত বাংলাদেশকে কোনঠাসা করার ভারতীয় অপপ্রয়াসকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। (ভারতীয় যুক্তি মানলে বাংলাদেশ ‘সি-লকড্’ হয়ে যেতো, যার মানে কন্টিনেন্টাল শেলফ অতিক্রম করে ভারত মহাসাগরের সীমানায় প্রবেশের জন্যে বাংলাদেশকে ভারত ও মিয়ানমারের করুণার ওপর নির্ভরশীল হতে হতো)। আল্লাহর অশেষ রহমতে বাংলাদেশ এই মহাবিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই সমুদ্র বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রায় এক লাখ আঠার হাজার আটশ তের বর্গ-কিলোমিটার সমুদ্রসীমার ওপর নিরংকুশ অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ (বীপষঁংরাব বপড়হড়সরপ ুড়হব) প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছে। দুঃখজনক হলো, এই বিজয় অর্জনের আট বছর অতিক্রান্ত হলেও খোদ শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এই মহাসুযোগের সত্যিকার তাৎপর্য উপলব্ধি করে অগ্রাধিকার দিয়ে অবিলম্বে এই বিশাল সমুদ্রসীমা থেকে সম্পদ আহরণ জোরদার করাকে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছেন কিনা তা নিয়েই আমি সন্দিগ্ধ।
আট বছর সময় অতিক্রান্ত হলেও আমাদের প্রস্তুতি এখনো শেষ হলো না কেন সেটা বোধগম্য নয়। ওয়াকিবহাল মহলের মতে ‘ব্লু ইকনমি’ পরিচালনা ও নীতি-নির্ধারণের দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের টানাপড়েন ও রশি টানাটানি এই বিলম্বের প্রধান কারণ। সমুদ্র ব্লকগুলোতে তেল-গ্যাস আহরণের জন্যে বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানীকে ‘প্রোডাকশান শেয়ারিং কনট্রাক্ট’ এর ভিত্তিতে ব্লকের ইজারা প্রদানের ব্যাপারে জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াও নাকি থমকে আছে বিভিন্ন শক্তিধর দেশের লবিয়িং থেকে উদ্ভূত টানাপড়েনের কারণে। কিন্তু, এহেন বিলম্ব যে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি ঘটিয়ে চলেছে তার দায় কে নেবে? নিচের বিষয়গুলো একটু গভীরভাবে বিবেচনা করা যাক্:
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমার অদূরে মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রে বেশ কয়েক বছর পূর্বে প্রায় চার ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে। ঐ গ্যাস এখন পুরোটাই চীনে রফতানি করছে মিয়ানমার। ভারত এই গ্যাসের একটা অংশ পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখন্ডের ওপর দিয়ে নিজেদের দেশে আমদানি করার জন্যে প্রকল্প প্রণয়ন করে বাংলাদেশকে রাজি করানোর জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল ২০০১-২০০৬ মেয়াদের বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময়। প্রস্তাবিত ঐ চুক্তিতে এমন শর্তও রাখা হয়েছিল যে বাংলাদেশের ভূখন্ডের ওপর দিয়ে যাওয়া পাইপলাইনের হুইলিং চার্জ তো বাংলাদেশ পাবেই, তদোপরি বাংলাদেশের প্রয়োজন হলে ঐ গ্যাসের একটা অংশ বাংলাদেশ কিনে নিতে পারবে। জোট সরকারের অন্ধ ভারত-বিরোধিতার কারণে বাংলাদেশ ঐরকম একটা লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল, যেটাকে অক্ষম্য দেশদ্রোহিতা আখ্যা দেওয়াই সমীচীন। গত এক দশক ধরে বাংলাদেশ যে ক্রমবর্ধমান গ্যাস সংকটে জর্জরিত হচ্ছে সেটা একেবারেই হতো না ঐ প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হলে! কিন্তু, বিএনপি-জামায়াতের অন্ধ ভারতবিদ্বেষ বাংলাদেশের জনগণকে কিভাবে এই প্রয়োজনীয় গ্যাস পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে তার একটা জ্বলজ্বলে নজির হয়েই থাকল ব্যাপারটা। এখন দশ গুণ দাম দিয়ে এলএনজি আমদানি করে আমরা ঐ ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছি! এরপর, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ঐ অঞ্চলের নিকটবর্তী বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় একটি ব্লক দক্ষিন কোরিয়ার দাইউ কোম্পানিকে তেল-গ্যাস আহরণের জন্যে ইজারা দিয়েছিল। দাইউ যথাযথ প্রস্তুতি এবং সরঞ্জাম নিয়ে ঐ অঞ্চলে তেল-গ্যাস এক্সপ্লোরেশন চালাবার জন্যে কয়েকটি জাহাজ নিয়ে উপস্থিত হলে সেখানে মিয়ানমারের নৌবাহিনী তাদেরকে বাধা দেয় এবং ফিরে আসতে বাধ্য করে। মিয়ানমারের যুক্তি ছিল যে ঐ অঞ্চলের সমুদ্রসীমার মালিক মিয়ানমার, বাংলাদেশের কোন অধিকার নেই ওখানে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের। ২০১২ সালের ইটলসের রায়ে ঐ বিরোধপূর্ণ অঞ্চলের মালিকানা এখন পেয়ে গেছে বাংলাদেশ, কিন্তু গত দশ বছরেও ওখানে এখনো কোন নূতন এক্সপ্লোরেশন শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোন ইজারাদার কোম্পানি। এই অক্ষম্য বিলম্বের কারণে মিয়ানমার যে এই সমুদ্রাঞ্চলের ভূগর্ভস্থ গ্যাস তুলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে সে গ্যাস তো বাংলাদেশও পেতে পারত। কারণ, সন্নিহিত অঞ্চলগুলোর ভূগর্ভে গ্যাসের মজুদ তো শুধু মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রসীমায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ওখানে গ্যাস পাওয়া যাবেই, এটা প্রায় নিশ্চিত মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। (২০১৯ সালে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত সাউথ-ইস্ট এশিয়া পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন সোসাইটির বার্ষিক কনফারেন্সে একটি আন্তর্জাতিক অনুসন্ধান কোম্পানি বাংলাদেশের এসএস-১১ ব্লক সম্পর্কে এ অভিমত তুলে ধরেছে)। হয়তো এহেন বিলম্বের কারণে কয়েক টিসিএফ গ্যাস থেকে বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ!
বাংলাদেশের এক লাখ আঠার হাজার বর্গ-কিলোমিটার অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমায় ২৬টি ব্লক ইজারা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে তেল-গ্যাস সহ অন্যান্য খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের জন্যে, কিন্তু গত সাত বছরে এ-ব্যাপারে কোন অগ্রগতিই পরিলক্ষিত হয়নি। সাত বছরেও সরকারের নীতি-নির্ধারকরা কোন সিদ্ধান্তে আসতে না পারাটা বড়ই রহস্যজনক বই কী! নাকি, বিশেষজ্ঞদের অভিযোগে উল্লিখিত এলএনজি আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর কায়েমী স্বার্থ সব আয়োজন ভন্ডুল করে দিচ্ছে তাদের মুনাফা দীর্ঘদিন চালিয়ে নেয়ার স্বার্থে? নৌবাহিনী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং অন্য কোন মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতার রশি টানাটানি সমস্যা নিরসনের জন্যে সরকারের একটি স্বতন্ত্র ‘সমুদ্র-সম্পদ মন্ত্রণালয়’ প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়