বাংলাদেশের উন্নয়নে ‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি মডেল’ অনুসরণে বাধা কোথায়?
৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে উৎখাতকারী ছাত্র–ছাত্রীরা নিজেদেরকে ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে অভিহিত করে। সব ধরনের বৈষম্যের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আয়বৈষম্য। অতএব, তারা ‘আয়বৈষম্য–নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি মডেল’ বাস্তবায়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে—সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। বাংলাদেশের চারটি রাষ্ট্রীয় নীতির মধ্যে সমাজতন্ত্র ফেরত এসেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ২০১০ সালের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে। ২০১১ সালে দেশের সংসদে পাশ হওয়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে সেটাকে সংবিধানে আবার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু, গত ১৩ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে ২০২২ সালের খানা আয়–ব্যয় জরিপের যে প্রাথমিক ফলাফল পত্র–পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাতে বাংলাদেশের জনগণের আয়বৈষম্য পরিমাপক জিনি সহগের মান নির্ধারিত হয়েছে ০.৪৯৯। অতএব, ২০২৪ সালে এখন নির্দ্বিধায় বলা যায় যে বাংলাদেশ একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে এসে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণকারী একটি দেশ উচ্চ–আয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হওয়ার মানে হলো দেশটি হাইজ্যাক হয়ে শ্রমজীবী জনগণের মালিকানার দেশ থেকে সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের করায়ত্ত ‘শোষকের দেশে’ পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ‘মুক্তির সংগ্রামের’ মাধ্যমে জন্ম নেয়া বাংলাদেশে মুখ থুবড়ে পড়েছে শ্রমজীবী জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি। ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল নির্ধারিত ‘স্বল্পোন্নত দেশের’ ক্যাটেগরি থেকে ‘উন্নয়নশীল দেশের’ ক্যাটেগরিতে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে, এবং ঐ প্রক্রিয়ার সফল পরিসমাপ্তির পর ২০২৬ সালে বাংলাদেশ বিশ্বে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে। এর আগে ২০১৫ সালে বিশ্ব ব্যাংকের ‘নিম্ন আয়ের দেশ’ ক্যাটেগরি থেকে বাংলাদেশ ‘নিম্ন–মধ্যম আয়ের দেশ’ ক্যাটেগরিতে উত্তীর্ণ হয়েছিল। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০১৮–১৯ অর্থ–বছরে ৮.১৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। ২০২০–২২ পর্বে করোনা ভাইরাস মহামারি এবং রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার কমে গেলেও তা ৫ শতাংশের কাছাকাছি ছিল এবং ২০২৩–২৪ অর্থ–বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫.৮ শতাংশ ছিল। ২০২০ সালে আইএমএফ ঘোষণা করেছে যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ভারতের চাইতে বেশি হয়ে গেছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি পাকিস্তানের চাইতে ৬৫ শতাংশ বেশি হয়ে গেছে। অতএব এটা অনস্বীকার্য, জিডিপি ও জিএনআই প্রবৃদ্ধি সহ নানাবিধ অর্থনৈতিক সূচক গত দুই দশক ধরে জানান্ দিয়ে চলেছে যে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনুন্নয়ন ও পরনির্ভরতার ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়ে টেকসই উন্নয়নের পথে যাত্রা করেছে।
কিন্তু, মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে যদি দেশে আয়বৈষম্যও বাড়তে থাকে তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের উচ্চবিত্ত ও উচ্চ–মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠির কাছে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে, যার ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন–মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। আয়বৈষম্য বৃদ্ধির এই মহাবিপদ এদেশের ১৯৭৫–পরবর্তী শাসকমহল তাদের ভ্রান্ত অর্থনৈতিক দর্শন ও উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে ডেকে এনেছে। দুঃখজনকভাবে আশির দশক থেকেই এদেশে আয় ও সম্পদ বৈষম্য ক্রমশ বাড়তে বাড়তে এখন বাংলাদেশ একটি ‘উচ্চ–আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হয়েছে। অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পরিমাপ করার জন্য নানা পরিমাপক ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে লরেঞ্জ কার্ভ এবং জিনি সহগ অন্যতম। কোন অর্থনীতির জিনি সহগ যখন দ্রুত বাড়তে থাকে এবং ০.৫ এর কাছাকাছি পৌঁছে যায় বা ০.৫ অতিক্রম করে তখন নীতি–নির্ধারকদের বোঝার কথা যে আয়বৈষম্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত হাউজহোল্ড ইনকাম এন্ড এঙপেন্ডিচার সার্ভে মোতাবেক বাংলাদেশের জিনি সহগ নির্ধারিত হয়েছে ০.৪৯৯, যা ১৯৭৩ সালে ছিল মাত্র ০.৩৬। আরেকটি পরিমাপকের গতি–প্রকৃতির মাধ্যমে ২০১০ ও ২০১৬ সালের মধ্যে আয়বৈষম্য বিপজ্জনকভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠির বিপক্ষে এবং ৫–১০ শতাংশ ধনাঢ্য গোষ্ঠিগুলোর পক্ষে চলে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি ফুটে উঠেছে: ২০১০ সালে দরিদ্রতম ৫ শতাংশ জনসংখ্যার মোট আয় ছিল মোট জিডিপি’র ০.৭৮ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে মাত্র ০.২৩ শতাংশে নেমে গিয়েছিল। ২০১০ সালে দরিদ্রতম ১০ শতাংশ জনসংখ্যার মোট আয় ছিল মোট জিডিপি’র ২ শতাংশ, ২০১৬ সালে তা মাত্র ১.০১ শতাংশে নেমে গিয়েছিল। সমস্যার আরেক পিঠে দেখা যাচ্ছে, দেশের ধনাঢ্য ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠির দখলে ২০১০ সালে ছিল মোট জিডিপি’র ৩৫.৮৫ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে বেড়ে ৩৮.১৬ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। আরো দুঃখজনক হলো, জনগণের সবচেয়ে ধনাঢ্য ৫ শতাংশ জনগোষ্ঠির দখলে ২০১৬ সালে চলে গিয়েছিল মোট জিডিপি’র ২৭.৮৯ শতাংশ, যা ২০১০ সালে ছিল ২৪.৬১ শতাংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র–ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এঙ’ এর প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট–২০১৮ মোতাবেক ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ এই পাঁচ বছরে অতি ধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে সারা বিশ্বে এক নম্বর স্থানটি দখল করেছিল বাংলাদেশ। ঐ পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭.৩ শতাংশ হারে, বাংলাদেশে ২০১৭ সালে ধনকুবেরের সংখ্যা ছিল ২৫৫ জন।। ঐ গবেষণা প্রতিবেদনে ত্রিশ মিলিয়ন বা তিন কোটি ডলারের (প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা) বেশি নীট–সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিদেরকে ‘আল্ট্রা–হাই নেট–ওয়ার্থ’ (ইউ এইচ এন ডব্লিউ’) ইন্ডিভিজুয়াল হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল।
বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানে সমাজতন্ত্রকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হলেও ১৯৭৫ এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন মার্কিনপন্থী খোন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমানের সরকার পাকিস্তানী স্টাইলে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম (স্বজনতোষী পুঁজিবাদ) প্রতিষ্ঠাকে এই রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ফিরিয়ে এনেছিল। আশির দশকে বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংকের ‘কাঠামোগত বিন্যাস কর্মসূচী’ ‘নিউ লিবারেল’ নীতিমালা সংস্কারের ধারাবাহিকতাকে জোরদার করার জন্যই পরিচালিত হয়েছিল। আমদানি উদারীকরণ, বিরাষ্ট্রীয়করণ, ব্যক্তিখাতে সরকারী নিয়ন্ত্রণ হ্রাস ও অর্থনীতিতে সরকারী ভূমিকার সংকোচন এবং বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ তাদের প্রেসক্রিপশনগুলোর মূল ফোকাস ছিল। ১৯৯১ সাল থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সরকার পালাক্রমে এদেশে গত ৩৩ বছরের মধ্যে ৩১ বছর সরকারে আসীন থাকলেও দেশে আয়বৈষম্য নিরসনে তাদের কোন ভূমিকা ছিল না। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে নাম–কা–ওয়াস্তে সমাজতন্ত্রকে সংবিধানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হলেও ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এব্যাপারে নীরবতা পালনকেই নিরাপদ মনে করতো।
সাধারণ জনগণের কাছে বোধগম্য যেসব বিষয় আয়বৈষম্য বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছানোর জানান দিচ্ছে সেগুলো হলো: ১) দেশে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে মাতাপিতার বিত্তের নিক্তিতে সন্তানের স্কুলের এবং শিক্ষার মানে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে; ২) দেশে চার ধরনের মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে; ৩) দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পুরোপুরি বাজারিকরণ হয়ে গেছে; ৪) ব্যাংকের ঋণ সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে ্এবং ঋণখেলাপি বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে; ৫) দেশের জায়গা–জমি, এপার্টমেন্ট, প্লট, ফ্ল্যাট, মানে রিয়াল এস্টেটের দাম প্রচন্ডভাবে বেড়েছে; ৬) বিদেশে পুঁজি পাচার মারাত্মক ভাবে বাড়ছে; ৭) ঢাকা নগরীতে জনসংখ্যা দুই কোটি ত্রিশ লাখে পৌঁছে গেছে, যেখানে আবার ৪০ শতাংশ মানুষ বস্তীবাসী; ৮) দেশে গাড়ী, বিশেষত বিলাসবহুল গাড়ী আমদানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে; ৯) বিদেশে বাড়ীঘর, ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক পড়েছে; ১০) ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশ ভ্রমণ বাড়ছে; ১১) উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রবাহ বাড়ছে; ১২) উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঘনঘন বিদেশে যাওয়ার খাসলত বাড়ছে; ১৩) প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিলাসবহুল ক্লিনিক দ্রুত বাড়ছে; ১৪) প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়েছে; ১৫) দেশে ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট স্কুল, পাবলিক স্কুল এবং ও লেভেল/এ লেভেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার মোচ্ছব চলছে। আবার অন্যদিকে দরিদ্র জনগণের সন্তানদের জন্য মাদ্রাসা গড়ে তোলার হিড়িক চলছে; ১৬) প্রধানত প্রাইভেট কারের কারণে সৃষ্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক জ্যাম নাগরিক জীবনকে বিপর্যস্ত করছে; এবং ১৭) দেশে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি বেড়ে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে পদে পদে। দুর্নীতিলব্ধ অর্থের সিংহভাগ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
২০১৬ সালের খানা আয়–ব্যয় জরিপে বাংলাদেশের দারিদ্র্য সীমার নিচের জনসংখ্যার হার ২৪.৫ শতাংশ পাওয়া গিয়েছিল, ২০২২ সালের খানা আয়–ব্যয় জরিপে তা ১৮.৭ শতাংশে নেমে গেছে বলে দাবি করা হয়েছে। দারিদ্র্য সীমার নিচের জনসংখ্যার এই ক্রমহ্রাসমান হার প্রশংসনীয় হলেও আয়বৈষম্য বৃদ্ধিকে অশনি সংকেত বিবেচনা করতেই হবে। ২০১৬ সাল থেকে ২০২২ সালে দারিদ্র্য হ্রাসের গতি স্তিমিত হয়ে গেছে। এর মানে, আয়বৈষম্য না বাড়লে হয়তো দারিদ্র্য নিরসন আরো জোরদার হতো! কিন্তু, হাসিনার সরকার শুধু মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়েই মাতামাতি করতো। আয়বৈষম্য বাড়তে থাকলে শুধু মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে প্রান্তিক অবস্থানের শ্রমজীবী জনগণের দারিদ্র্য নিরসন করা যায় না। উচ্চ ও ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি শ্রমজীবী জনগণের জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে, তারা জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল যতখানি পাওয়ার কথা অতোখানি পাচ্ছে না। সুতরাং, আয়বৈষম্যের ব্যাপারে হাসিনার সরকারের দুঃখজনক অমনোযোগ আমার কাছে বরাবরই অগ্রহণযোগ্য ছিল। বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তে প্রয়োজন ‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি মডেল’। এই মডেলের মূল কথা হলো, আয়বৈষম্য নিরসনকারী অবস্থান গ্রহণ করলে কোন দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে যে ধারণা সাইমন কুজনেৎস অর্থনৈতিক উন্নয়ন তত্ত্বে চালু করেছিলেন সেটা একটা ‘ভুয়া ধারণা’। পুঁজিবাদের পক্ষে তাঁর অবস্থানকে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যেই বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে কুজনেৎস ঐ তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন, যেখানে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিভিন্ন দেশ ও সেগুলোর উন্নয়ন–পথের সময়কালকে সুপরিকল্পিতভাবে বাছাই করেছিলেন তিনি। ঐ তত্ত্ব মানবজাতির বড় ধরনের ক্ষতি সাধন করেছে। গত ছয় দশকের অনেকগুলো আলোড়ন–সৃষ্টিকারী গবেষণা ঐ তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করেছে, যার মধ্যে বাঙালি নোবেল পুরস্কার–বিজয়ী অভিজিৎ ব্যানার্জির গবেষণা–প্রাপ্ত ফলাফলও অন্যতম। এখন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে যেসব দেশ আয়বৈষম্য বাড়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বৈষম্য নিরসনে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে জনগণের খাদ্য–বস্ত্র–বাসস্থান–শিক্ষা–স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার প্রদান করে বৈষম্য–বিরোধী অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে সেসব দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমার পরিবর্তে বেড়ে যাচ্ছে। চীন, ভিয়েতনাম, ব্রাজিল, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা এই ‘বৈষম্য–নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি মডেলের’ সফল কয়েকটি উদাহরণ।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়