বাংলাদেশের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন: ‘প্যারাডক্স’ মনে হলেও এর ভাল ব্যাখ্যা রয়েছে
বাংলাদেশের প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রতীচ্যের কিছু উন্নয়ন–বিশেষজ্ঞ ‘প্যারাডক্স’ অভিহিত করতে দ্বিধা করেন না। দেশের কিছু অর্থনীতিবিদকে এই মতের সাথে সহমত জানাতে দেখে আমার খুবই রাগ হয়। কারণ, ‘প্যারাডক্স’ কথাটির বাংলা অর্থ হলো ‘আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী’। এর মানে, প্রচলিত তথ্য–উপাত্তের বিচারে এই দ্রুত উন্নয়নের ব্যাখ্যা পাওয়া দুরূহ। পাশ্চাত্যের উন্নয়ন–বিশেষজ্ঞগণের অনেকের পক্ষে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিশীলতার পেছনে অবদান রাখা অনেক উপাদান সম্পর্কে যথাযোগ্য জ্ঞান–আহরণ অনেক সময় সম্ভব হয় না বলে তাঁরা এ–ধরনের মতামত পোষণ করলে সেটাকে হয়তো তেমন দোষণীয় বলা যাবে না, কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ কেউ এহেন ভুল অভিধা মেনে নিলে বলতে হবে তিনি বা তাঁরা বিষয়টির গভীরে না যাওয়াতেই এই ভুল অনুসিদ্ধান্তের সাথে ঐকমত্য পোষণ করে দায় এড়াতে চাচ্ছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান গতিশীলতার অত্যন্ত ভাল ব্যাখ্যা রয়েছে, এখানে স্ববিরোধী কিছুই নেই। বক্ষ্যমাণ কলামে আমি বিষয়টি আলোচনা–বিশ্লেষণে নিয়ে আসছি।
২০২৩ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশের ১ কোটি ৪৯ লাখ অভিবাসী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন ও কর্মরত রয়েছেন বলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বিবৃতি দিয়েছেন। তাঁরা ২০২২–২৩ অর্থ–বছরে ২১.৬১ বিলিয়ন ডলার ফর্মাল চ্যানেলে দেশে পরিবারের সদস্যদের কাছে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রায় অর্ধেক রেমিট্যান্স এখন হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশে আসছে। আমি মনে করি বাংলাদেশের সিংহভাগ রেমিট্যান্স–প্রেরকরা হুন্ডি পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। অতএব, ২১–২২ বিলিয়ন ডলার যদি ফর্মাল চ্যানেলে দেশে রেমিট্যান্স আসে তাহলে কমপক্ষে আরো ২১–২২ বিলিয়ন ডলার বা তার চাইতেও বেশি রেমিট্যান্স (টাকার আকারে) হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশের অর্থনীতিতে ঢুকছে। এহেন হুন্ডি পদ্ধতিতে কোন কাগজ–পত্র স্বাক্ষর করার প্রয়োজন হয় না। হুন্ডিওয়ালাদের স্থানীয় এজেন্ট প্রায়শ রেমিট্যান্স–প্রেরক এবং রেমিট্যান্স–গ্রহীতাদের পূর্ব–পরিচিত থাকার কারণে এসব লেনদেনে ঠকে যাওয়ার আশংকাও তেমন থাকে না। আরো যেটা গুরুত্বপূর্ণ তাহলো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের বাইরের কেউ জানতেও পারে না যে পরিবারে রেমিট্যান্স এসেছে। টেলিফোনে খবর পেয়ে যথাস্থানে গিয়ে বা নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা পেয়েই রেমিট্যান্স–গ্রহীতারা যথাসম্ভব দ্রুত তা নিকটবর্তী ব্যাংকের একাউন্টে আমানত হিসেবে জমা করে দেন, তাই আগের দিনের মত চোর–ডাকাত–মাস্তানদের আক্রমণের শিকার হতে হয় না পরিবারকে। যেহেতু বিশ্বস্ততাই হুন্ডি ব্যবসার সাফল্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তাই সাধারণত পাঠানো রেমিট্যান্সের টাকা মার যায় না, লেনদেনের গোপনীয়তাও রক্ষা করা হয় সযতনে।
এই হুন্ডি পদ্ধতিতে প্রেরিত অর্থ রেমিট্যান্স–প্রেরকের পরিবারের সদস্যবৃন্দ ও আত্মীয়স্বজনরা যেহেতু পেয়ে যাচ্ছেন তাই এই অর্থ প্রবাসীদের পরিবারের সদস্যদের ভোগ, সঞ্চয় ও বিনিয়োগে ব্যাপক অবদান রাখছে। এক কোটি টাকার বেশি আমানত রক্ষাকারী ব্যাংক–একাউন্টের সংখ্যা দেশে এখন এক লক্ষ এগার হাজার ছাড়িয়ে গেছে, এবং এসব একাউন্টের উল্লেখযোগ্য অংশই গ্রামীণ এলাকার ব্যাংক–শাখাগুলোতে। বিবেচনা করুন, সারা দেশে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে প্রবাসীদের পরিবারের পাকা বাড়ি নির্মাণের যে হিড়িক চলেছে তার খরচের কত শতাংশ ফর্মাল চ্যানেলে দেশে এসেছে? স্বীকার করতেই হবে, ফর্মাল চ্যানেল বা হুন্ডি পদ্ধতি—যেভাবেই রেমিট্যান্সের অর্থ অর্থনীতিতে প্রবাহিত হোক্ তার বহুবিধ সুফল পাচ্ছে অর্থনীতি। হুন্ডি পদ্ধতিতে প্রেরিত রেমিট্যান্সের বৈদেশিক মুদ্রা (প্রধানত ডলার) যদিও দেশ থেকে বিদেশে অর্থ–পাচারের জন্য পুঁজিপাচারকারীরা অপব্যবহার করে চলেছে তবুও এই ব্যাপারটা অর্থনীতির জন্য পুরোপুরি নেতিবাচক নয়। বিপুল পরিমাণ খেলাপিঋণ সত্ত্বেও বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো যে বড়সড় সংকটে পড়ছে না তার পেছনে ফর্মাল চ্যানেলে কিংবা হুন্ডি পদ্ধতিতে প্রেরিত রেমিট্যান্স থেকে উদ্ভূত বিশাল আমানত প্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এক অর্থে এই বিপুল রেমিট্যান্সের অর্থ বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের একটা তাৎপর্যপূর্ণ বিকল্পের ভূমিকা পালন করছে। চীন ও ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ যে ভূমিকা পালন করেছে তার অনুরূপ ভূমিকা বাংলাদেশে পালন করছে ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স প্রবাহ। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের চমকপ্রদ উল্লম্ফনও ঘটাচ্ছে প্রবাসীদের ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স। বাংলাদেশের অনেক এলাকার গ্রামীণ ও শহুরে অর্থনীতিতে যে বিপুল গতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে প্রধান অবদান রেখে চলেছে এলাকার প্রবাসী–বাংলাদেশীদের সংখ্যাধিক্য। জেলা হিসেবে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে ঢাকা জেলায়, তারপর কুমিল্লায়, চট্টগ্রামে এবং সিলেটে। আমার মতে হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হওয়া রেমিট্যান্স ও অন্যান্য ব্যবস্থায় দেশে নিয়ে আসা বিদেশে উপার্জিত আয়–উপার্জন ৩০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে প্রতি বছর। (তার মানে, প্রবাসী বাংলাদেশীদের ফর্মাল–ইনফর্মাল চ্যানেলে মোট রেমিট্যান্স ও দেশে নিয়ে আসা বৈদেশিক মুদ্রার যোগফল প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার)। দেশী–বিদেশী বিশেষজ্ঞ যাঁরা বাংলাদেশের প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ‘প্যারাডক্স’ আখ্যায়িত করে থাকেন তাঁদের ত্রুটি হলো তাঁরা বৈদেশিক অভিবাসনের গুরুত্বকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারছেন না। এত দুর্নীতি সত্ত্বেও বাংলাদেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকে তাঁদের কাছে আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী মনে হয়। ৫০ বিলিয়ন ডলারের সম–পরিমাণ অর্থ প্রতি বছর অর্থনীতিতে যুক্ত হওয়া কি সামান্য ব্যাপার? আমার মতে তাঁরা দেশের অর্থনীতিতে যোগ হওয়া এই বিপুল অর্থ–প্রবাহের ইতিবাচক অভিঘাতকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করেন না বলেই ব্যাপারটাকে ‘আন্ডার–এস্টিমেট’ করছেন। এখন বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিএনআই পশ্চিমবঙ্গের চাইতে বেশি। (জিএনআই হলো জিডিপি ও নীট রেমিট্যান্সের যোগফল)। পশ্চিমবঙ্গের মেগা–সিটি কোলকাতাকে জনসংখ্যার দিক্ থেকে অনেকখানি পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। ঢাকার জনসংখ্যা এখন দুই কোটি কুড়ি লাখ আর কোলকাতার জনসংখ্যা এক কোটি ষাট লাখ। এমনকি জিডিপি’তে শিল্পখাতের অবদান এখন পশ্চিমবঙ্গের চাইতে বাংলাদেশে বেশি।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুবাতাস বইয়ে দিচ্ছে তাহলো চলমান কৃষি বিপ্লব। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ধান উৎপাদিত হতো মাত্র এক কোটি দশ লক্ষ টন। গত পঞ্চাশ বছরে ধান উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন কোটি আশি/নব্বই লক্ষ টনে, ভুট্টার উৎপাদন এবং গম উৎপাদন যোগ করলে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে প্রায় চার কোটি ত্রিশ লক্ষ টন। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছে গেছে। তরি–তরকারী, শাক–সব্জি ও হাঁস–মুরগী উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এমনকি, গরু–মহিষের মাংস উৎপাদনেও দেশ এখন স্বয়ম্ভরতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। সতের কোটির বেশি মানুষের খাদ্যশস্য যোগান দিয়েও এখন প্রায় প্রতি বছর মোটা ধান উদ্বৃত্ত হচ্ছে আমাদের। (অবশ্য প্রতি বছর আমরা ৬০/৬৫ লাখ টন গম আমদানি করি)। সত্তর লাখ টন আলুর অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিপরীতে ২০২২ সালে বাংলাদেশে এক কোটি দুই লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। হাঁস–মুরগীর ডিম ও মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। দুধ উৎপাদনে দেশে এখনো ঘাটতি রয়ে গেলেও গরু–মহিষের মাংস উৎপাদনে আমরা স্বয়ম্ভরতার দ্বারপ্রান্তে। ঈদুল আজহার সময় অতীতে চোরাচালানে আসা ভারতীয় গরু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এখন তার প্রয়োজন হয় না, বরং ২০২৩ সালের ঈদুল আজহার সময় কোরবানীর গরু উদ্বৃত্ত ছিল। আম, আনারস, কলা, পেয়ারা ও কাঁঠালের মত কয়েকটি প্রধান ফল উৎপাদনেও বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাদ্যসাহায্য এখন আমাদের বৈদেশিক ঋণ/অনুদানের এক শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। উচ্চফলনশীল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার, সেচ ব্যবস্থার আওতায় আসায় দেশের অধিকাংশ জমিতে বোরো চাষের সম্প্রসারণ, যথাযথ ভর্তুকি প্রদান, কৃষিঋণ পদ্ধতির সহজীকরণ, ফসলের বহুধাকরণ, কৃষির লাগসই যান্ত্রিকীকরণ, উচ্চফলনশীল ফসল, তরিতরকারী, মাছ, হাঁস–মুরগী ও ফলমূল চাষের ব্যাপক প্রচলন, রাসায়নিক সার, বীজ ও কীটনাশকের সহজলভ্যতা, ইত্যাদি কৃষিখাতের উল্লেখযোগ্য সাফল্য। অতএব, জনগণের খাদ্য যোগানে অর্থনীতির এই সক্ষমতা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট অবদান রেখে চলেছে। একসময় বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন আন্তর্জাতিক ভিক্ষার ঝুড়ি’ আখ্যায়িত করা হতো এই দেশটি কখনোই খাদ্য সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্তি পাবে না ধরে নিয়েই।
তৃতীয় যে সফলতা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করে তুলেছে তাহলো তৈরি পোশাক শিল্পের দ্রুত প্রসার। গত ৪৫ বছরে বাংলাদেশ চীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশের অবস্থানে পৌঁছে গেছে। ফলে, ১৯৮০–৮১ অর্থ–বছরে যেখানে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিল মাত্র ৭৫ কোটি ডলার সেখানে ২০২২–২৩ অর্থ–বছরে দেশের রফতানি আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫.৫৬ বিলিয়ন (৫,৫৫৬ কোটি) ডলারে, যার ৮২ শতাংশ আসছে তৈরি পোশাক রফতানি থেকে। চামড়াজাত পণ্য, কৃষিজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য এবং ডিজিটাল পণ্য প্রতিটি থেকেও এখন বাংলাদেশ এক বিলিয়ন ডলারের বেশি রফতানি আয় নিয়ে আসছে। শিল্পখাতের উৎপাদন এখন বাংলাদেশের জিডিপি’র প্রায় ৩৫ শতাংশে পৌঁছে গেছে, শিল্পখাতে কর্মসংস্থানও মোট জনশক্তির ১৮ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে। এর মানে, জিডিপি’তে এখন শিল্পখাতের অবদান কৃষিখাতের অবদানের প্রায় আড়াই গুণ। অর্থনীতির এই প্রশংসনীয় কাঠামোগত রূপান্তর স্বল্পোন্নত অন্য কোন দেশে ঘটেনি।
চতুর্থ যে বিষয়টি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিশ্বের মধ্যে অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে তাহলো ডঃ ইউনূসের উদ্ভাবিত ক্ষুদ্র ঋণের অভাবনীয় প্রসার। এই ক্ষুদ্রঋণ সরবরাহ ব্যবস্থায় গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক এবং কয়েক হাজার এনজিও’র অংশগ্রহণের ফলে দেশের দুই কোটি ত্রিশ লাখের বেশি প্রান্তিক অবস্থানের গ্রামীণ নারী ক্ষুদ্র ঋণের আওতায় আসায় এবং এই ঋণগ্রহীতাদের প্রায় ২৮ শতাংশ ক্ষুদ্রঋণের সহায়তায় দারিদ্র্য নিরসনে সফল হওয়ায় দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে একেবারে প্রান্তিক অবস্থানের জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক দৈন্য অনেকখানি কমে গেছে। খোদ বাংলাদেশের শাসকমহল কর্তৃক এই ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের ইতিবাচক অবদানকে অস্বীকার করার অপপ্রয়াস সত্ত্বেও জাতিসংঘ এবং বিশ্ব ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণকে দারিদ্র্য নিরসন ও উন্নয়নের সহায়ক উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০৬ সালে ডঃ ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংককে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে।
পঞ্চম যে বিষয়টি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিপ্লবাত্মক ভূমিকা পালন করে চলেছে তাহলো নারীর ক্ষমতায়ন। তৈরি পোশাক শিল্পের প্রায় ৬৫–৭০ শতাংশ শ্রমিক নারী, ক্ষুদ্রঋণের ৯৫ শতাংশ ঋণগ্রহীতা গ্রামীণ নারী, উচ্চশিক্ষা ব্যতীত বাংলাদেশের সকল স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীরা ছাত্রদের চাইতে সংখ্যায় বেশি। এমনকি, বাংলাদেশের মোট নারী সমাজের প্রায় ৪১ শতাংশ এখন বাড়ীর বাইরে কর্মরত রয়েছেন, যেটা দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ হার। নারীর ক্ষমতায়নে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বও তাঁদের প্রণোদনামূলক ভূমিকা অক্ষুণ্ন রেখে চলেছেন।
আরেকটি বিষয়েও বাংলাদেশ পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে উঠছে তাহলো ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার। একইসাথে, দেশের ভৌত অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারের আগ্রহ ইতোমধ্যেই সুফল দিতে শুরু করেছে। দেশের শতভাগ জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় নিয়ে আসার বিষয়টিকে এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য অভিহিত করতেই হবে। কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে নির্মীয়মাণ গভীর সমুদ্রবন্দর, পায়রায় নির্মীত দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর, মোংলা সমুদ্রবন্দরের উন্নয়ন, পদ্মা বহুমুখী সেতু, নির্মীয়মাণ যমুনা রেলসেতু, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মীত টানেল, ঢাকার মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আগামী বছর–দু’বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরো অনেকখানি এগিয়ে দেবে নিঃসন্দেহে। অতএব, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে সন্দেহের চোখে দেখা নেহাতই অজ্ঞতাপ্রসূত বলা চলে। এটা স্বীকার করতেই হবে যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বহুদিন ধরেই সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি ও পুঁজি লুন্ঠন। এর মানে, যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার সত্যিসত্যিই ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি বাস্তবায়ন করতো তাহলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ইতোমধ্যেই ১০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে যেতো। দুর্নীতির কারণে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রায় দুই/তিন শতাংশ কম হচ্ছে। আর, এই দুর্নীতি ও পুঁজিলুন্ঠন দেশের আয়বৈষম্যকে মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতি বছর।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়