ড. মইনুল ইসলামের কলাম

| বৃহস্পতিবার , ২৫ মার্চ, ২০২১ at ৭:১৩ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সাবধানবাণীঃ উন্নয়ন দিয়ে গণতন্ত্রের বিপর্যয় আড়াল করা যায় না
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে জাতি। সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ এখন বিরাট বিস্ময়। ১৯৭১ সালের জন্মলগ্নে যে দেশটি বিশ্বের জনগণের দান-খয়রাত ছাড়া টিকে থাকতে পারবে না বলা হচ্ছিল সে দেশটি এই পঞ্চাশ বছরে উন্নয়নের মডেল হিসাবে বিশ্বের সকল উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের অনুন্নয়ন ও দারিদ্র্য মোকাবেলায় পথপ্রদর্শক হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারি আঘাত হানার আগে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে ৮.২ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল, যা ছিল বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ। করোনাভাইরাস মহামারির মরণ-ছোবল সত্ত্বেও বিশ্বের যে কয়েকটি দেশ জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ধনাত্মক রাখতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ তার অন্যতম, ২০১৯-২০ অর্থ-বছরেও আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫.২৪ শতাংশ। আরো বিষ্ময়কর হলো, মহামারি সত্ত্বেও ২০২০ সালে বাংলাদেশে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স ২৩ শতাংশ বেড়ে ২১.৭৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। ফলে, চলমান ২০২০-২১ অর্থ-বছরেও বাংলাদেশের লেনদেন ভারসাম্যের কারেন্ট একাউন্টে ক্রমবর্ধমান উদ্বৃত্ত থাকার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের মার্চে ৪৪ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। কিন্তু সুবর্ণ জয়ন্তীর এই আনন্দলগ্নে আমাকে যে বিষয়টা বিষাদের গ্লানিতে নিমজ্জিত করছে তা হলো দেশের নির্বাচনী গণতন্ত্রের লাইনচ্যুতি।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের সংসদীয় নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণমূলক হলেও ক্ষমতাসীন মহাজোট ঐ নির্বাচনকে ব্যালট-ডাকাতির প্রহসনে পরিণত করে দেশের নির্বাচনী গণতন্ত্রকে বিপর্যয়ের মহাগহ্বরে নিমজ্জিত করেছে। চাণক্যবুদ্ধির খেলার শিকার হয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটিও ছিল ক্ষমতাসীন জোটের যেনতেনভাবে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার প্রহসন। ২০১৪ সালে বেগম জিয়া এবং তাঁর পুত্রের মারাত্মক চালের ভুলে বিএনপি-নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন বয়কট করায় মহাজোট একতরফা নির্বাচনে জেতার সুযোগ পেয়েছিল। ১৯৯১ সালে নির্বাচনী গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে চারটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার কোনটিতেই ক্ষমতাসীন দল বা জোট পুনর্নির্বাচিত হয়নি, কারণ দুর্নীতি ও পুঁজি লুন্ঠনের কারণে প্রতিবারই ক্ষমতাসীন সরকার দ্রুত জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেছিল। ২০১৮ সালে বিএনপি আর এহেন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়নি। অতএব, অবাধ ও জালিয়াতিমুক্ত নির্বাচন হলে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ জিততে পারবে কিনা সেটা নিয়ে আবারো শংকা দেখা দিয়েছিল। কারণ, ঐ পর্যায়েও মহাজোটের প্রধান শরীক আওয়ামী লীগের নয় বছরের মেয়াদে দুর্নীতি ও পুঁজি লুন্ঠনের ব্যাপারে জনগণের কাছে তাদের ভূমিকাকে ইতিবাচক মনে হচ্ছিল না। নিত্যদিনের দুর্নীতির শিকার জনগণের মনে ওসব স্মৃতি তখন ছিল তুলনামূলকভাবে তরতাজা, ২০০১-২০০৬ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত জোটের দুর্নীতির কাহিনীগুলো এক যুগে অনেকটুকু ফিকে হয়ে গিয়েছিল। ঐ নয় বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জনগুলো দেশটির অতীতের নেতিবাচক ইমেজকে ক্রমেই পরিবর্তন করতে শুরু করলেও এর সুফল আওয়ামী লীগ নির্বাচনী বিজয়ের মাধ্যমে ঘরে তুলতে পারবে কিনা সেটা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ মনে হওয়ায় হয়তো সুষ্ঠু নির্বাচনের ঝুঁকি নেয়ার পরিবর্তে তাঁরা ব্যালট জবরদখলের ন্যক্কারজনক পথটিই বেছে নিয়েছিলেন!
আমার আজকের কলামটি যে জন্য লিখছি তাহলো, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরে উন্নয়নের সাফল্যগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখার তাগিদে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে ছাড় দেওয়া যায় বলে কিছু পন্ডিতম্মন্য ব্যক্তির কিছু লেখালেখি আমার নজরে এসেছে, যেখানে ড. মাহাথির মোহাম্মদের আমলের মালয়েশিয়ার নজির টেনে বলা হচ্ছে তাঁর দীর্ঘ শাসনামলে গণতন্ত্রের কিছু ঘাটতি পরিলক্ষিত হলেও মালয়েশিয়ার উন্নয়নের জোয়ার অব্যাহত থাকায় মালয়েশিয়া এখন উন্নত দেশের কাতারে উত্তীর্ণ হওয়ার অবস্থানে পৌঁছে গেছে। কেউ কেউ আবার সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ’র নজির টেনে বলতে চান বিশ্বের মধ্যে সিঙ্গাপুর অর্থনৈতিক উন্নয়নের সফলতম উদাহরণ সৃষ্টি করার প্রধান কারণ প্রয়াত লি কুয়ান তাঁর জীবদ্দশায় সিঙ্গাপুরে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেননি। আমার মতে, এই দুটো নজির তুলে ধরে বাংলাদেশে উন্নয়নের স্বার্থে নির্বাচনগুলোতে শেখ হাসিনাকে যেনতেনভাবে জিতিয়ে আনার থিসিস যাঁরা উপস্থাপন করছেন তাঁরা শেখ হাসিনার সাথে শত্রুতা করছেন। জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে গতিশীল করার কৃতিত্ব শেখ হাসিনাকে দেওয়ার ব্যাপারে কার্পণ্য করছে না বিশ্ব। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ২০১৯-২০ অর্থ-বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার কমে ৫.২৪ শতাংশে দাঁড়ালেও সেটাকে বিশ্বের উন্নয়ন-চিন্তাবিদরা অত্যন্ত প্রশংসনীয় হিসেবে অভিহিত করেছেন। কারণ, ২০২০ সালে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে গেছে করোনা মহামারির মরণ-ছোবলে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এই প্রবৃদ্ধির সুফল অনেকটুকুই রাজনৈতিক দুর্নীতি ও পুঁজি লুন্ঠন এবং আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির ফায়দাভোগীদের দখলে চলে যাচ্ছে। আমার মতে, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে শেখ হাসিনার পুনর্নির্বাচিত হওয়ার চাবিকাঠি ধারণ করছে এই দুর্নীতি ও পুঁজি লুন্ঠনের বিরুদ্ধে তিনি যে সত্যিই আপসহীন সেটা জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি চাইলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী ও বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবেন। তিনি চাইলে জনগণকে এই ম্যাসেজটা পৌঁছে দিতে পারবেন যে তিনি দুর্নীতির ব্যাপারে সত্যিসত্যিই ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিয়েছেন। তাহলে, তাঁর আমলে অর্জিত অর্থনৈতিক সাফল্যকে জনগণ যথাযথভাবে মূল্যায়ন করবে।
সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই, বাংলাদেশের প্রান্তীয় পুঁজিবাদী, আমলাতান্ত্রিক এবং পুঁজি লুন্ঠনমূলক রাষ্ট্রচরিত্রই অনুন্নয়ন দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রে’ রূপান্তরিত করা। সেজন্যেই এ-রাষ্ট্রের চারটি মূল নীতি নির্দিষ্ট করা হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র। ১৯৭৫ সালের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পথ ধরে রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলকারী সমরপ্রভুদের অবৈধ ও অসাংবিধানিক কাটা-ছেঁড়ার পর্ব পেরিয়ে ২০১০ সালে রাষ্ট্রের এই চারটি মৌলনীতি আবারো সংবিধানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন জাতির প্রধান আরাধ্য এবং দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রকে সত্যিকার অর্থে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে’ রূপান্তরিত করা। গণতন্ত্রকে দৃঢ়মূল করতে না পারলে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ কীভাবে অর্জিত হবে? গণতন্ত্রই উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে, উন্নয়নের দোহাই দিয়ে গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে জালিয়াতির শিকারে পরিণত করা গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে পাকিস্তানী আদলের উন্নয়ন কৌশল আবারো মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়েছিল। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পুঁজিবাদ গড়ে তোলার যে পাকিস্তানী মডেলটা চালু হয়েছিল তাতে যে ধরনের পুঁজির বিকাশ এদেশে ঘটেছে তার চরিত্র প্রধানত মুৎসুদ্দি পুঁজির। সেজন্যেই, শিল্প স্থাপনের জন্য উদার ব্যাংক ঋণ প্রদান করা হলেও পাচার হয়ে যাচ্ছে বাণিজ্যে, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চোরাচালানে। ব্যাংক ঋণের সহায়তায় আমদানিকৃত শিল্প প্ল্যান্ট-যন্ত্রপাতির খরচ ওভার-ইনভয়েসিং করে বিদেশে পুঁজি পাচার করে দেওয়া হচ্ছে। ৪৬ বছর ধরে গেড়ে বসা রাজনৈতিক দুর্নীতি এবং আমলাতান্ত্রিক দুর্র্নীতির মাধ্যমে লুট করা অর্থও দেদার পাচার হচ্ছে বিদেশে। বিংশ শতাব্দীর শেষ ২৫ বছর ‘নব্য-উপনিবেশ’ হিসেবে বাংলাদেশ শুধু অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বই যে হারিয়েছিল তা-ই নয়, বরং এর রাজনৈতিক স্বাধীনতাও ঐ সময়ে নাম্‌কা-ওয়াস্তে হয়ে গিয়েছিল। অথচ, ২০১৮ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার শর্ত পূরণকারী বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। ১৯৮১-৮২ অর্থ-বছরে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান এদেশের জিডিপি’র ১৩.৭ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। ২০১১ সাল থেকে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান-নির্ভরতা ক্রমশ কমে এখন জিডিপি’র এক শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। পাকিস্তানকে উন্নয়নের প্রায় সকল সূচকে পেছনে ফেলে এক দশক আগেই বাংলাদেশ জানান্‌ দিয়েছিল বাংলাদেশ এখন হেনরি কিসিঞ্জার কথিত ‘আন্তর্জাতিক তলাবিহীন ঝুড়ি’ নেই, ২০২১ সালের বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার ‘ইমার্জিং টাইগার’ অভিহিত করা হচ্ছে। ২০২০ সালে মাথাপিছু জিডিপি’র বিচারে বাংলাদেশ ভারতকে টপকে যাবে বলে পূর্বাভাস দিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে আইএমএফ।
এতদ্‌সত্ত্বেও, এই বাংলাদেশের উন্নয়নকেই পিছনে টেনে রাখছে সর্বনাশা দুর্নীতি ও পুঁজি লুন্ঠন। আর, দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূল কারণ নিহিত রয়েছে রাষ্ট্রচরিত্রের মধ্যে। উপরন্তু, রাষ্ট্রক্ষমতা যেসব দেশে শাসকদের এবং তাদের আত্মীয়-স্বজন, দলীয় নেতা-কর্মী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীদের পুঁজি লুন্ঠনের লোভনীয় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেসব দেশে অনুন্নয়ন গেড়ে বসে থাকে। উন্নয়ন তত্ত্বে এর নাম ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ বা স্বজনতোষী পুঁজিবাদ। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর ২০০৭-৮ সালের সামরিক বাহিনী-সমর্থিত সরকার ছাড়া গত ৪৬ বছর ক্ষমতায় থাকা এদেশের কোন সরকারি দল স্বজনতোষণের বদখাসলতমুক্ত ছিল না। ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ ক্লাসিক নজির এখন বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সাল থেকেই এদেশে মুক্ত বাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার ধারা এগিয়ে চলেছে। ২০১০ সালে সমাজতন্ত্র আবার বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও গত এগার বছরের রাষ্ট্রীয় নীতিতে সমতাকামী সমাজ বিনির্মাণের তেমন কোন নিষ্ঠাবান প্রয়াস আজো পরিলক্ষিত হয়নি। বর্তমান মহাজোট সরকার শুধু জিডিপি/জিএনআই’র প্রবৃদ্ধির হার নিয়েই মাতামাতি করছে, আয় ও সম্পদ বন্টনের বৈষম্য যে বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে গেছে তা স্বীকারও করা হচ্ছে না। বিভিন্ন অকাট্য তথ্যের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে পুঞ্জীভূত হয়ে যাওয়ার এবং তাদের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার বিপদ সংকেত পাওয়া যাচ্ছে। সাধারণ জনগণের কাছে বোধগম্য যেসব বিষয় বৈষম্য বৃদ্ধি এবং আয় ও সম্পদের পুঞ্জীভবনের এই বিপদটার জানান্‌ দিচ্ছে সেগুলো হলো: ১) দেশে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে মাতাপিতার বিত্তের নিক্তিতে সন্তানের স্কুলের এবং শিক্ষার মানে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে; ২) দেশে চার ধরনের মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে; ৩) ব্যাংকের ঋণ সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে ্‌এবং ঋণখেলাপি বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে; ৪) দেশের জায়গা-জমি, এপার্টমেন্ট, প্লট, ফ্ল্যাট, মানে রিয়াল এস্টেটের দাম প্রচন্ডভাবে বেড়েছে; ৫) মানি লন্ডারিং মারাত্মক ভাবে বাড়ছে; ৬) ঢাকা নগরীতে জনসংখ্যা এক কোটি পঁচাত্তর লাখে পৌঁছে গেছে, যেখানে আবার ৪০ শতাংশ বা ৭০ লাখ মানুষ বস্তীবাসী; ৭) দেশে গাড়ী, বিশেষত বিলাসবহুল গাড়ী আমদানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে; ৯) বিদেশে পুঁজি পাচারের হিড়িক পড়েছে, বেগমপাড়া ও সেকেন্ড হোম এখন দেশের সবচেয়ে মুখরোচক খবর; ১০) ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশ ভ্রমণ বাড়ছে; ১১) উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রবাহ বাড়ছে; ১২) উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঘনঘন বিদেশে যাওয়ার খাসলত বাড়ছে; ১৩) প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিলাসবহুল ক্লিনিক দ্রুত বাড়ছে; ১৪) প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়েছে; ১৫) দেশে ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট স্কুল, পাবলিক স্কুল এবং ও লেভেল/এ লেভেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার মোচ্ছব চলছে: এবং ১৬) প্রধানত প্রাইভেট কারের কারণে সৃষ্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক-জ্যাম নাগরিক জীবনকে বিপর্যস্ত করছে।
অথচ, ‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি’ কৌশল অবলম্বন করে এখনো সমতাকামী সমাজ প্রতিষ্ঠা খুবই সম্ভব। কৃষিতে গণমুখী নীতি প্রণয়ন, শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্য হ্রাস, দরিদ্র জনগণকে সুলভে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, সুলভে উৎপাদনশীল জনগণের কাছে ব্যাংক ঋণ পৌঁছানো, অগ্রাধিকার সহকারে প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, কঠোরভাবে দুর্নীতি দমন এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাকে জোরদার করা এই কৌশলের মূল স্তম্ভ। সর্বোপরি, আয় পুনর্বন্টনকে রাষ্ট্রের মূল মিশন হিসেবে গ্রহণ করতেই হবে। ১৯৯১-২০২১ পর্বে দু’বছর বাদে বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার পদ্ধতি চালু রয়েছে মনে হলেও আদতে এদেশে চালু রয়েছে ‘প্রধানমন্ত্রীর একনায়কত্ব’। আরো দুঃখজনক হলো, ২০১৪ সাল থেকে নির্বাচনী গণতন্ত্র লাইনচ্যুত হয়ে রয়েছে। যতই ত্রুটিপূর্ণ হোক্‌ নির্বাচনী গণতন্ত্রকে প্রতিনিধিত্বশীল এবং জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক করে তোলা এখন জাতির প্রধান চ্যালেঞ্জ। উন্নয়নকে গণতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে তুলে ধরার অপপ্রয়াস অচিরেই পরিত্যাজ্য।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর,
অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল আজকাল
পরবর্তী নিবন্ধমারা গেলেন মার্কিন অভিনেতা জর্জ সিগাল