ড. আসমা সিরাজুদ্দিন : একজন মমতাময়ীর মহাপ্রয়াণ

ড. সালমা বিনতে শফিক | রবিবার , ৯ জানুয়ারি, ২০২২ at ৭:৫৪ পূর্বাহ্ণ

গেল শতকের সত্তর, আশি ও নব্বই’র দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের খাতায় নাম লেখানো শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনের গল্প অনেকটা একইরকম। একরাশ দ্বিধা, সংকোচ আর কিছুটা ভয়-ভীতি সঙ্গে নিয়ে পপ্রথম শ্রেণীকক্ষে প্রবেশের মুহূর্তে হাস্যকৌতুকে স্বাগত জানান চিরসবুজ অধ্যাপক মোকাদ্দেসুর রহমান। ভয় কাটতে শুরু করে অল্প অল্প করে। তবে ইতিহাসের প্রতি ভালোবাসা জন্মাতে শুরু করে একটু পর, যখন শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করেন অধ্যাপক আসমা সিরাজুদ্দিন। দীর্ঘাঙ্গী, মার্জিত, বিনয়ী এত বিশেষণকে সঙ্গে রেখেও ‘একজন মমতাময়ী’ অভিধায় মানায় বেশী তাঁকে। শিক্ষার্থীদের প্রতি সীমাহীন মমতা বা ভালোবাসাই শুধু নয়, তিনি সম্মান করতেন প্রতিটি শিক্ষার্থীকে, এমনকি পেছনের সারিতে বসা সবচেয়ে অমনযোগী ছাত্র বা ছাত্রীটিকেও। পাঠদান শুরুর আগে উপস্থিতির খাতা নিয়ে রোলনম্বর নয়, নাম ধরে ডাকতেন তিনি ছেলেমেয়েদের। অবাঙালি উচ্চারণে সাধারণ নামগুলোই তাঁর মুখে অসাধারণ শোনাতো।
হ্যাঁ, তিনি অবাঙালি ছিলেন। জন্ম তাঁর অবিভক্ত ভারতের লাহোরে, ১৯৩৭ সালে। তাঁর বয়স যখন দশ, তখন ভাগ হয় ভারত। তাঁর জন্মভুমির নতুন নাম হয় পশ্চিম পাকিস্তান। বিশ বছর বয়সে তিনি লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিএ পাশ করেন। ১৯৫৯ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেন চারুকলায়। লাহোর মহিলা কলেজে প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা জীবন শুরু হয় তাঁর ১৯৬০ সালে। কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজে পড়তে যান তিনি ১৯৬২ সালে। ১৯৬৫ সালে দেশে ফিরে গিয়ে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। স্থাপত্বিক অলংকরণের ওপর ডিপ্লোমা করেন (১৯৬৫) তিনি লন্ডনের হর্নজী আর্ট কলেজ হতে। এরপর প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেন ১৯৬৮ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় হতে।
ইংরেজি, উর্দু, ছাড়া আরবি ও ফার্সি ভাষায় দক্ষতা ছিল তাঁর গবেষণার প্রধান শক্তি। ইন্দো-মুসলিম কলা ও স্থাপত্য, মুসলিম আমলে বাংলার প্রত্নতত্ত্ব বিশেষত মুদ্রা ও লিপি, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ছিল তাঁর গবেষণা ও পাঠদানের প্রধান বিচরণক্ষেত্র। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টোরাল করেন (১৯৭৪-৭৫), হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে সহযোগী গবেষক হিসেবে কমর্রত ছিলেন (১৯৮৬-৮৭), রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটির রিসার্চ ফেলো (১৯৬৮-৬৯) হিসেবে কাজ করেন, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর (১৯৯৬) হিসেবে শিক্ষকতা করেন অধ্যাপক আসমা সিরাজুদ্দিন।
তবে উচ্চ শিক্ষার জন্য ইউরোপে গিয়ে আর হয়নি তাঁর ঘরে ফেরা। পূর্ব পাকিস্তান থেকে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজে পড়তে যাওয়া তরুণ আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিনের সঙ্গে জীবনের গাঁটছাড়া বেঁধে আসমা হক হয়ে যান আসমা সিরাজুদ্দিন। ভালোবাসার টানে পশ্চিম পাকিস্তানী কন্যা বসত গড়েন এই বাংলায়। তখন ষাটের দশক। তীব্র ঘৃণায় বাঙালি ফুঁসে উঠতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানী অপশাসনের বিরুদ্ধে। সেইদিনগুলো মোটেও সহজ ছিলেনা তাঁর জন্য। সব প্রতিকুলতা জয় করেন তিনি ভালোবাসা দিয়ে। বাংলা ভাষা শেখেন, বাঙালি রান্না শেখেন, বাঙালি মেয়েদের মতো করে শাড়ি পরা শেখেন ।
ড. আসমা সিরাজুদ্দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন ১৯৬৯ সালে। ১৯৭৫ সালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন ইতিহাস বিভাগে এবং অধ্যাপক পদে পদন্নোতি লাভ করেন ১৯৮৩ সালে। ইতিহাস বিভাগের সভাপতির পদ অলংকৃত করেন ১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি কেবল মমতাই নয়, তাদের নিয়ে গৌরবেরও শেষ ছিলনা তাঁর। একাত্তরের পর আরও টানা তিনদশক শিক্ষকতা করেছিলেন তিনি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কত মত পথ এলো গেল! অদৃশ্য শক্তির ছত্রছায়ায় দিন দিন সহিংস হয়ে উঠল সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ কোমলপ্রাণ ছাত্ররা। উত্তপ্ত হয়ে উঠল বিশ্ববিদ্যালয়, রক্তাক্ত হল বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা। কিন্তু পাঞ্জাবী নারী বলে কোনদিন কোন দলের কোন বেপরোয়া ছাত্র তাঁকে অসম্মান বা বিদ্রুপ করেনি।
তাঁর বদান্যতার কথা বলেও শেষ করার নয়। অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিনের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করার সময় একবার পাহাড়ের ওপর উপাচার্যের বাসভবন অবরোধ করে রাখে ছাত্ররা। ছেলেরা অভুক্ত আছে, এই ভেবে অধ্যাপক আসমা সিরাজুদ্দিন অবরোধের দায়িত্বে নিয়োজিত বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের জন্য উপাচার্যের হেঁসেল হতে খাবার ও পানি পাঠিয়ে মমতার অমর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ওপর তাঁর ছিল অগাধ আস্থা আর স্নেহাশিস। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, শিক্ষকদের যত্ন ও ভালোবাসা পেলে কোন ছাত্রই বিপথে যেতে পারেনা। তাঁর প্রতিও সীমাহীন মুগ্ধতা শিক্ষার্থীদের। তাঁর কথায় এমনই মায়া ছিল যে প্রত্যেকেরই মনে হত, আমাকেই বোধহয় তিনি সবচেয়ে বেশী ভালোবাসেন। প্রথম বর্ষে তিনি পড়াতেন ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের ইতিহাস। হাতে প্রায়ই থাকত আবদুল করিমের বই। চারুকলার শিক্ষার্থী আসমা সিরাজুদ্দিন বুঝি ইতিহাসের প্রেমেই পড়েছিলেন লন্ডনে গিয়ে। ভালোবাসার সীমাহীন শক্তি নিয়ে বাংলাদেশকেই ভালোবেসেছিলেন তিনি। ইচ্ছে করলেই লন্ডন, আমেরিকা, লাহোরে কিংবা উন্নত বিশ্বের যে কোন নামকরা শহরে থিতু হয়ে বসবাস করতে পারতেন। তিনি তা করেননি। তিনি জানতেন তাঁর ভালোবাসারই জয় হবে। এ ভালবাসা কেবল একজন ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়। ভালোবাসার মানুষটির সমগ্র জগতটাকে ভালোবেসে আপন করে নেন তিনি। চেনা পৃথিবী ছেড়ে পাড়ি জমান এক অচেনা ভুবনে। একজন মমতাময়ী নারী পথ চলায় কতটা শক্তি রাখতে পারেন, অধ্যাপক আসমা সিরাজুদ্দিন তারই স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন পৃথিবীর বুকে। নজরুলের সেই অমোঘ বাণী যেন অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায় এই যুগলের ঐন্দ্রজালিক জীবনযাপনের সঙ্গে।
“কোন কালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়লক্ষী নারী”।
সেদিনের সেই তরুণ গবেষক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন লন্ডন থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন (১৯৬৪), লিঙ্কন্স ইন থেকে ‘বার এট ল’ ডিগ্রী লাভ করেন (১৯৬৭) এবং দেশে ফিরে এসে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। এরপর একে একে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ অলংকৃত করেন (১৯৮৮-১৯৯১), এমেরিটাস প্রফেসর নিযুক্ত হন (২০১২), একুশে পদক লাভ করেন (২০১৭)। জীবনসঙ্গীকে একজন শিক্ষাবিদের জন্য সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ জাতীয় অধ্যাপক পদে (মে, ২০২১) সমাসীন দেখে চোখ বোজেন অধ্যাপক আসমা সিরাজুদ্দিন ২১/১২/২১ প্রত্যুষে।
প্রায় দু’বছর বার্ধক্যজনিত রোগে শয্যাশায়ী ছিলেন অধ্যাপক ড. আসমা সিরাজুদ্দিন। তবে কোন দুঃখবোধ ছিলনা তাঁর মনে। তাঁরই সেবায় শিয়রে সর্বক্ষণ তাঁর প্রাণের মানুষ, ডাকসাইটে শিক্ষাবিদ হিসেবে যাঁর সুনাম দেশে বিদেশে। শিশুর মতো করে সহধর্মিণীর যত্ন নেন, নিজ হাতে তৈরি করা খাবার মুখে তুলে দেন একজন জাতীয় অধ্যাপক। এমন ভাগ্য পৃথিবীর ক’জন মেয়ের হয়! এই মমতাময়ীর মহাপ্রয়াণের মধ্য দিয়ে প্রায় ছয় দশকের এক মহাকাব্যিক যুগলজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে সেই মঙ্গলবারে। খ্যাতি আর সাফল্যের চূড়ান্ত শিখরে অবস্থানকারী একজন ইতিহাসবিদ হাহাকার করে ওঠেন সর্বস্ব হারানোর বেদনায়।

অধ্যাপক আসমা সিরাজুদ্দিনের জীবনবৃত্তান্তের শুরুতে জাতীয়তার পাশে ‘বাংলাদেশী’ লেখা। এই বাংলাদেশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর প্রাণের জায়গা। তাইতো বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতেই পাতা হয়েছে তাঁর শেষ শয্যা। ধর্মপ্রাণ আসমা সিরাজুদ্দিনও নজরুলের মতো মসজিদের পাশেই ঘুমোতে চেয়েছিলেন। বিদ্বান পুত্র ড. ওমর সিরাজুদ্দিন শুভানুধ্যায়ীদের বিশাল বহর সঙ্গে নিয়ে সমাহিত করেন মহীয়সী মা কে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের আঙিনায়। আপনার ভালোবাসারই জয় হয়েছে। এ শূন্যতা পূরণ হবার নয়। তবে আপনি বেঁচে থাকবেন ইতিহাসের প্রাঙ্গণে, আপনার অগণিত সন্তানের প্রাণে। ওপারে ভাল থাকবেন, ম্যাডাম।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধসত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর : লেখক, সাহিত্যিক
পরবর্তী নিবন্ধজীবনে বন্ধু থাকুক; থাকুক, বন্ধুত্বের বন্ধন