ডোপ টেস্টের সিরিয়াল পেতেই ৬ মাস

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ৯ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ

পেশাদার চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়নের ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট সনদ বাধ্যতামূলক করে গত ১২ জানুয়ারি পরিপত্র জারি করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের স্বাক্ষরে জারিকৃত পরিপত্রে ৩০ জানুয়ারি থেকে নতুন এ নিয়ম কার্যকরের কথা উল্লেখ করা হয়।
পরিপত্র অনুযায়ী, পেশাদার মোটরযান চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়নকালে প্রার্থীর আবেদনপত্রের সাথে সরকারি হাসপাতাল কর্তৃক সম্পাদিত ডোপ টেস্ট রিপোর্ট বা সনদ দাখিল করতে হবে। ডোপ টেস্ট রিপোর্ট/সনদ পজিটিভ হলে (মাদক সেবনের আলামত পাওয়া গেলে) বা এতে কোনও বিরূপ মন্তব্য থাকলে সেক্ষেত্রে পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু বা নবায়ন করা যাবে না। ঢাকা মহানগরের ৬টি প্রতিষ্ঠান এবং সারাদেশে সকল পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালে এ ডোপ টেস্ট করা যাবে বলে পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়। পরিপত্র অনুযায়ী গত ৩০ জানুয়ারি থেকে নতুন এ নিয়ম কার্যকর করা হয়েছে।
তবে নতুন এ নিয়ম চালুর পর থেকে বড় ধরনের ভোগান্তিতে পড়েছেন চট্টগ্রামের পেশাদার চালকরা। লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে গিয়ে সহসাই ডোপ টেস্টের সুযোগ মিলছে না তাদের। টেস্টের সিরিয়াল মিলছে ৬ থেকে ৭ মাস পর! আবার টেস্ট রিপোর্ট/সনদ ছাড়া লাইসেন্সও মিলছে না। লাইসেন্স না থাকলে সড়কেও প্রতিনিয়ত ভোগান্তি। এমন পরিস্থিতিতে পেশাদার চালকরা এখন নিদারুণ অসহায়।
সৈয়দ মোস্তফা নামে এক চালক তার লাইসেন্স নবায়নে আবেদন করেছেন বিআরটিএ-তে। গত ২২ মার্চ তার ডোপ টেস্টের জন্য একটি চিঠি ইস্যু করে বিআরটিএ। চমেক হাসপাতালের পরিচালক বরাবর ইস্যু করা এ চিঠিতে ডোপ টেস্টের তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে চলতি বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর; যা অন্তত ৬ মাস পর। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই সময়ে যাদের চিঠি ইস্যু হচ্ছে, তারা সিরিয়াল পাচ্ছেন আরো পরে। অবশ্য, ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে আবেদন করা অনেকেই এর মাঝে ডোপ টেস্ট করতে সক্ষম হয়েছেন। সরকারি ভাবে এই টেস্ট ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৯০০ টাকা। চালকদের ভোগান্তির কথা স্বীকার করে বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত কেবল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পেশাদার চালকদের এই ডোপ টেস্ট হচ্ছে। তাও দিনে ২৫ জনের বেশি নয়। কিন্তু লাইসেন্সের জন্য দৈনিক কয়েকশ আবেদন জমা পড়ছে। মূলত এ কারণে ডোপ টেস্টের সিরিয়াল পেতেও চালকদের দীর্ঘ সময় লাগছে। চট্টগ্রামে অন্তত আরো কয়েকটি হাসপাতালে এ টেস্ট হলে চালকরা এ ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতেন বলে মনে করেন বিআরটিএ, চট্টগ্রাম কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) রায়হানা আক্তার ঊর্থী। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কাছে চিঠি দিয়েছেন জানিয়ে বিআরটিএ’র এ কর্মকর্তা বলেন, আমরা চিঠির মাধ্যমে বিষয়টি জানিয়েছি। স্বাস্থ্য বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে চালকদের এ ভোগান্তি লাঘব হবে।
বিআরটিএ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ৩০ জানুয়ারি নতুন নিয়ম কার্যকরের পর তারা (বিআরটিএ) ৩১ জানুয়ারি থেকে ডোপ টেস্টের জন্য চিঠি ইস্যু শুরু করেন।
ওই সময় থেকে গত বুধবার (৬ এপ্রিল) পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৫ হাজার চালকের ডোপ টেস্টের জন্য চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। আর একই সময়ে রিপোর্ট পাওয়া গেছে প্রায় দেড় হাজার জনের। হিসেবে আরো চার হাজার চালক ডোপ টেস্টের অপেক্ষায় দিন পার করছেন। যদিও দিন দিন এ সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে বলে জানালেন বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) রায়হানা আক্তার ঊর্থী।
জানতে চাইলে বিষয়টি অবগত আছেন জানিয়ে চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর গতকাল আজাদীকে বলেন, এটা ঠিক যে- বর্তমানে কেবল চমেক হাসপাতালে এ টেস্ট হচ্ছে। তাও উনারা ২৫ জনের বেশি করতে পারছেন না বলে আমাদের জানিয়েছেন। এ কারণে চালকদের এ টেস্টে সময় লাগছে। অন্য হাসপাতালগুলোতে এই টেস্ট চালু না হওয়ার কারণ সম্পর্কে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক বলেন, এখানে কিট কেনার একটি বিষয় আছে। স্থানীয় ভাবে (লোকালি) কেবল চমেক হাসপাতালই চাইলে এ ধরণের কেনাকাটা করতে পারে। অন্য হাসপাতালের ক্ষেত্রে এ সুযোগ নেই। মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে। তাছাড়া যে খাতে এসব কেনাকাটা হবে, সে খাতের বরাদ্দ শেষ বা কেনাকাটা হয়ে গেলে নতুন বরাদ্দ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এরপরও আমরা ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি এবং চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে চিঠি দিয়েছি। তাদেরও এই টেস্ট চালুর জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে বিআইটিআইডিতে কিট কেনার প্রক্রিয়া অনেকদূর এগিয়েছে। সেখানে খুব শীঘ্রই হয়তো এই টেস্ট চালু করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন বলেও জানান বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর।
হাসপাতালগুলো যা বলছে : আনুষঙ্গিক সব ধরণের সক্ষমতা থাকলেও কেবল জনবল সংকটের কারণে টেস্টের সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান। হাসপাতাল পরিচালক বলেন, প্যাথলজিতে আমাদের এমনিতেই জনবল কম। তাও হাসপাতালের রোগীদের প্যাথলজিক্যাল যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখানে চলছে। এর মাঝে চালকদের ডোপ টেস্ট স্বাভাবিক ভাবেই অতিরিক্ত লোড তৈরি করেছে। অবশ্য, আমাদের রি-এজেন্ট, কিটসহ আনুষঙ্গিক সব সুবিধা আছে। কিন্তু মেডিকেল টেকনোলজিস্টের সংকট রয়েছে। এই জনবল (টেকনোলজিস্ট) পেলে চালকদের ডোপ টেস্টের সংখ্যা আমরা আরো বাড়াতে পারবো। ২৫টির কথা বলা হলেও দিনে ৪০/৫০টি টেস্ট করে দেয়া হচ্ছে বলেও জানান হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান। একই ভাবে প্যাথলজিস্ট ও টেকনোলজিস্ট সংকটের কথা বলেছেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি। তিনি আজাদীকে বলেন, আমরা সীমিত পরিসরে ডোপ টেস্ট শুরু করেছি। দিনে ৫/৬টি। কিন্তু বেশি সংখ্যায় এই টেস্ট করার মতো লোকবল আমাদের নেই। হাসপাতালে একজন প্যাথলজিস্টও নেই বলে জানান ডা. সেখ ফজলে রাব্বি।
যা বলছেন সিভিল সার্জন : বিআরটিএ কর্তৃক পরিপত্র জারির আগে চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি দেশের সকল পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালে চালকদের ডোপ টেস্ট সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিঞার স্বাক্ষরে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু নির্দেশনার তিন মাসেও সরকারি সব হাসপাতালে ডোপ টেস্ট চালু হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী আজাদীকে বলেন, উপজেলা পর্যায়ে ওই রকম টেকনোলজিস্ট নেই। তবে বিদ্যমান জনবল দিয়ে ডোপ টেস্ট চালু করা যায় কী না, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে আমি কথা বলবো। সিটি কর্পোরেশনেরও বেশ কয়টি হাসপাতাল আছে, তাদের জনবলও আছে। সেখানেও এই টেস্ট হতে পারে। প্রয়োজনে সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের সাথেও কথা বলবেন বলে জানান সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী।
উল্লেখ্য, পরিবহন চালকদের মাদকাসক্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো বন্ধ করতে ২০২০ সালের ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চালকদের ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ওই নির্দেশনা বাস্তবায়নে পেশাদার চালকদের লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়নে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করে অবশেষে পরিপত্র জারি করে বিআরটিএ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাহে রমজানের সওগাত
পরবর্তী নিবন্ধ২৩৮ স্ট্রিট লাইটে আলোকিত সন্দ্বীপ