বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের আসরে যাঁরা গৌরবের সাথে অধিষ্ঠিত করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন মৃণাল সেন। সত্যজিৎ রায় এবং ঋত্বিক ঘটকের মতো মৃণাল সেনও স্বমহিমায় মহিমান্বিত। সত্যজিৎ, ঋত্বিক এবং মৃণাল এই তিনজনের কাজের ধরণ সম্পূর্ণ আলাদা। মৃণাল সেন কেবল প্রতিবাদীই ছিলেন না, নিরীক্ষাধর্মী কাজও করেছেন। সুদীর্ঘ শিল্প যাত্রায় নিজেকে তিনি ভেঙেছেন। গড়েছেন। নিত্যনতুন সৃষ্টি করায় প্রচন্ড আগ্রহী ছিলেন।
তাঁর পরিচালিত ৩৪টি সিনেমা– দর্শক মনে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ ও অভিজ্ঞতা এনে দেয়। সিনেমা পরিচালনার পাশাপাশি মৃণাল সেন চিত্রনাট্য ও বই লেখাতেও নিবিষ্ট ছিলেন। বলা চলে, তিনি সবসময়ই সৃষ্টিশীল কাজের মধ্যেই জীবন কাটিয়েছেন।
তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৪ মে ১৯২৩। সেই হিসেবে এই বছর মৃণাল সেনের জন্ম শতবর্ষ। চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউট এই মহান চলচ্চিত্রাকারকে স্মরণ করেছে তাঁর নির্মিত চারটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, আলোচনা এবং প্রকাশনার মাধ্যমে। চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের মুখপত্র ‘ডিপ ফোকাস’–এর দ্বিতীয় সংখ্যা করা হয়েছে মৃণাল সেনকে নিয়ে। এই সংখ্যায় বাংলাদেশ ও ভারতের আঠারো জন লেখক লিখেছেন। মৃণাল সেনের নিজের একটি লেখাও ‘ডিপ ফোকাস’–এ আছে। মৃণাল সেনের জন্ম শতবর্ষ উপলক্ষে ঢাকা, কোলকাতায় বিভিন্ন আয়োজন করা হয়েছে। এবার চট্টগ্রামেও হলো।
গত ২৮ জুলাই ও ৩০ জুলাই ২০২৩ চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউট এবং আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, চট্টগ্রামের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত হলো ‘মৃণাল সেন জন্ম শতবর্ষ রেটরোসপেকটিভ।’ ২৮ জুলাই ২০২৩ তারিখ আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, চট্টগ্রাম মিলনায়তনে এই আয়োজন উদ্বোধন করেন স্থপতি বিধান বড়ুয়া। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনের সহকারী হাইকমিশনার ড. রাজীব রঞ্জন। অনুষ্ঠানে মূল আলোচক ছিলেন চলচ্চিত্র গবেষক সৈকত দে। এছাড়া বক্তব্য রাখেন আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক ড. গুরুপদ চক্রবর্তী এবং চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সভাপতি শৈবাল চৌধূরী। অনুষ্ঠানে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের মুখপত্র ‘ডিপ ফোকাস’ মৃণাল সেন সংখ্যা প্রকাশিত হয়।
অনুষ্ঠানে ২৮ জুলাই ২০২৩ তারিখে প্রদর্শিত হয় মৃণাল সেন পরিচালিত ‘চালচিত্র’ এবং ‘আকালের সন্ধানে’। ৩০ জুলাই ২০২৩ তারিখে প্রদর্শিত হয় ‘অন্তরীণ’ এবং ‘আমার ভুবন’।
শৈবাল চৌধূরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত
ডিপ ফোকাসে মৃণাল সেনের বর্ণাঢ্য চলচ্চিত্র জীবনের নানান বৈচিত্র্যময় বিষয় নিয়ে লিখেছেন সঞ্জয় মুখ্যোপাধ্যায়, সোমেশ্বর ভৌমিক, পল্লল ভট্টাচার্য, কমলেশ দাশগুপ্ত, আলম খোরশেদ, সৈকত দে, ড. মো: মোরশেদুল আলম, শাহরিয়ার আদনান শান্তনু, শহিদুল ইসলাম রিয়াদ, অপূর্ব রঞ্জন বিশ্বাস, সঞ্জয় বিশ্বাস, গোকুল চাঁদ কুন্ডু, মনিরুল মনির, নাজমুল আলম ইমন, বিশ্বজিত চক্রবর্তী, রূপম সেন, শৈবাল চৌধূরী এবং শাহীন মাহমুদ। একই সাথে এই সংখ্যায় সন্নিবেশিত হয়েছে মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রপঞ্জি, রচিত গ্রন্থের নাম, চিত্রনাট্যের নাম। বলা যায়: ডিপ ফোকাস– এর মৃণাল সেন সংখ্যা সংগ্রহে রাখার মত।
মৃণাল সেন এমনই একজন শিল্পী, যিনি কারোর দ্বারা প্রভাবিত নন। যিনি তাঁর প্রতিটি সিনেমায় নিজেকে ভেঙেছেন। কারণ, তিনি নিজেকে ভাঙতে ভালবাসেন। শৈবাল চৌধূরীর লেখা ‘মৃণাল সেন : শতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শীর্ষক প্রবন্ধে এই দিকটি উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘পরিবর্তনশীলতা সৃষ্টিশীলতার অন্যতম একটি শর্ত। এটা মৃণাল সেনের মধ্যে বেশি পরিমাণেই ছিল।’
আলম খোরশেদ তাঁর ‘খণ্ডহর, মৃণাল সেন ও তাঁর দুটি সৎ স্বীকারোক্তি’ প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘এতকাল যে ধরনের সমাজবোধ ও শ্রেণিচেতনা নির্ভর প্রত্যক্ষ বক্তব্য সমৃদ্ধ সরব ছবি নির্মাণে অভ্যস্ত ছিলেন মৃণাল সেন তা থেকে সরে এসে এখানে এমন এক বিষয় ও চিত্রভাষার আশ্রয় নেন, যা ব্যক্তির মনোজগৎ, ক্ষয়িষ্ণু সমাজের মূল্যবোধ ও মনস্তত্ব বিষয়ে আগ্রহী ও সহানুভূতিশীল।’
সোমেশ্বর ভৌমিকের লেখায় (আখ্যানের অন্দরমহল) আমরা জানতে পারি মৃণাল সেন সম্পর্কে আরেক তথ্য। তিনি লিখেছেন: ‘সমসাময়িক কিংবা উত্তরসূরী পরিচালকদের কাহিনীচিত্রের আদল থেকে মৃণাল সেনের তৈরি কাহিনীচিত্রের আদল প্রথম থেকেই আলাদা। ছবিগুলি কাহিনী নির্ভর হয়েও হয়ে ওঠেনি গতানুগতিক কাহিনীচিত্র।’
আসলেই তাই। মৃণাল সেনকে বিশদ জানতে হলে তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্র দেখতে হবে। এবং মনুষ্য জীবনের পরাবাস্তববাদী দর্শন খুঁজে পাওয়া যায় মৃণাল চলচ্চিত্রে। চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের মুখপত্র ‘ডিপ ফোকাস’ মৃণাল সেন সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো পাঠে তাঁকে জানার সুযোগ আছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের মুখপত্র ‘ডিপ ফোকাস’ – এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জাঁ লুক গোদারকে নিয়ে।
আশা করি চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউট বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতের বরেণ্য চলচ্চিত্রকার, চলচ্চিত্র নিয়ে এমন সমৃদ্ধ প্রকাশনা ‘ডিপ ফোকাস’ নিয়মিত করবে।