ডিজিটাল যুগে অ্যানালগ ট্রাফিক সিস্টেম

চট্টগ্রাম নগরে গাড়ি চলে হাতের ইশারায় রাত-দিন লাইট জ্বললেও মানে না কেউ

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১১ মার্চ, ২০২৩ at ৪:৩৫ পূর্বাহ্ণ

ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া লেগেছে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরীর ট্রাফিক সিগন্যাল এখনো নিয়ন্ত্রিত হয় অ্যানালগ পদ্ধতিতে। ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারা, লাঠির আঘাত ও বাঁশির হুইসেলে থেমে যায় যানবাহন। অনেক ক্ষেত্রে লেজার লাইটও ব্যবহার করছে ট্রাফিক পুলিশ। স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক কন্ট্রোল ব্যবস্থা চালু না থাকায় অসহনীয় যানজটসহ সড়কে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে বলে মনে করছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং নগরীতে চলাচলকারীরা। ক্রমবর্ধমান যানবাহনের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় ট্রাফিক পুলিশকে। আর এতে যানজট সৃষ্টি হলে জনসাধারণের ক্ষোভ দেখা দেয় ট্রাফিক পুলিশের ওপরই। এমন অবস্থায় সড়কের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে দ্রুত সিগন্যাল বাতি স্থাপনের তাগিদ ট্রাফিক বিভাগের। সিএমপির ট্রাফিক বিভাগের উপ কমিশনার (পশ্চিম) তারেক আহমেদ আজাদীকে বলেন, স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক কন্ট্রোল ব্যবস্থা চালুর বিকল্প নেই। এটার আর্থিক এবং কারিগরী সহায়তা দেওয়ার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। আমরা বেশ কয়েকবার তাদের বলেছি। কিন্তু প্রায় দেড় দুই যুগ ধরে এ অবস্থা বিরাজ করছে। এর ফলে গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে। মার্কেটগুলোর পার্কিং ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়, বাসট্রাকের স্ট্যান্ড নেই। সবকিছু মিলে হল অবস্থা এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। এখন তাই শুধু স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক কন্ট্রোল ব্যবস্থা চালু করলেই শৃঙ্খলা ফিরে আসবেই বলা যায় না। টোটাল একটা স্টাডি করে কোন খাতে কী করণীয় তা পূরণ করতে হবে।

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া বলেন, হাতের ইশারা থেকে সিগন্যাল বাতি ব্যবস্থাপনায় ফিরে যাওয়া ক্ষত জায়গায় মলম লাগানোর মতোই। তিনি আরো বলেন, নগরীতে গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে। একটি মোড় বা জংশনে কতটি গাড়ি প্রতি মিনিটে পারাপার হয়, তার ডিজাইন তৈরি করতে হবে। ডিজাইন না করে সিগন্যাল বাতিতে ফিরে গেলে উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হবে না। অর্থাৎ একটি জংশনে চারপাঁচ দিক থেকে গাড়ি পারাপার হয়। উত্তর বা দক্ষিণমুখী গাড়ি পারপার করলে পূর্ব ও পশ্চিমমুখী গাড়ির জট লেগে যাচ্ছে কি না, তা ডিজাইন করে বের করতে হবে। তবে সিগন্যাল ব্যবস্থায় ফিরে গেলে কিছুটা সুফল আসতে পারে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, তৎকালীন এরশাদ সরকারের আমলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় ৩৯টি মোড়ে সিগন্যাল বাতি স্থাপন করে। একই সরকারের আমলে পরে আরও পাঁচটি মোড়ে নতুন করে সিগন্যাল বাতি স্থাপন করা হয়। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে কিছু সিগন্যাল বাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু জোড়াতালি দিয়ে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত একটানা কয়েক বছর সিএমপি ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। ওই সময় কোনো বাতির কারিগরি ত্রুটি দেখা দিলে পুলিশ সিটি কর্পোরেশনকে জানাত। সিটি কর্পোরেশন তা মেরামত করে দিত।

এদিকে বর্তমান সরকারের আমলে নগরীর উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়। অর্থাৎ বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থার সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ২০১২ সালে ২১টি মোড়ের সিগন্যাল বাতি পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়ে। বাকি ২৫টি মোড়ের বাতিগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। এতে ওই সময় খরচ হয় দেড় কোটি টাকা। ২৫টি মোড়ের মধ্যে ১০টিতে ১৫ ওয়াটের এলইডি এবং ১৫টিতে ৫০ থেকে ১০০ ওয়াটের হ্যালোজেন বাতি লাগানো হয়েছিল। সেই বাতিগুলোও এখন পুরোপুরি অকার্যকর। এ অবস্থায় নগরীর ট্রাফিক পুলিশ আবার নতুন করে সিগন্যাল বাতির ব্যবহার শুরু করে। সিটি কর্পোরেশন এতে সহযোগিতাও করে। কিন্তু কিছুদিন পরেই হয়ে যায় ‘যেই লাউ সেই কদু’ অবস্থা।

সিএমপির দক্ষিণ বিভাগের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই প্রসিকিউশন) অনিল চাকমা আজাদীকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই হাতের ইশারায় ট্রাফিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। নগরীর বড় জংশনগুলোতে ট্রাফিক পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়। সিগন্যাল বাতি দিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শুরু হলে জনবলও কম লাগবে।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, দীর্ঘ ২২ বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৯ সালের শেষের দিকে বর্তমান সময়ে সব কিছুতেই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে। তাই সিএমপির ট্রাফিক পুলিশের চেষ্টা ছিল কীভাবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে আধুনিকতা আনা যায়। ট্রাফিক বিভাগ নিজেদের প্রচেষ্টায় চট্টগ্রামের ৪৪ টি স্পটের মধ্যে ১০টি স্পট অটোমেটিক ট্রাফিক সিগন্যাল লাইটের আওতায় এনেছিল। ফলে যানবাহনের চাপ দেখে সে অনুসারে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতেন ট্রাফিক সদস্যরা। চট্টগ্রাম নগরীর টাইগারপাস মোড় থেকে শুরু করে চৌমুহনী, আগ্রাবাদ, বারেক বিল্ডিং, ওয়াসাসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পাইলট প্রকল্প হিসেবে চালু করা হয়েছিল এ প্রকল্পটি। পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রাম শহরকে সিগন্যাল লাইটের আওতায় আনা হবে এমনটাই আশা করেছিলেন নগরীর ট্রাফিক সদস্যরা। জনসাধারণ ও চালকদের মাঝে ট্রাফিক সিগন্যাল লাইটের সচেতনতাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে করোনার কারণে বন্ধ হয়ে যায় সেই প্রকল্প।

নগর বিশেষজ্ঞদের মতে বিশ্বমানের বাসযোগ্য একটি নগরীতে রাস্তার পরিমাণ থাকতে হয় অন্তত ৩০ শতাংশ। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরীর রাস্তার পরিমাণ ৯ শতাংশ। রাস্তায় যানবাহনের চাপ অত্যধিক। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শাহ আমানত সেতু কিংবা কালুরঘাট পর্যন্ত রাস্তাটিই মূলত প্রধান সড়ক। এর বাইরে অলংকার মোড় থেকে ট্রাংক রোড, বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে স্ট্যান্ড রোড, কাপাসগোলা রোড, পোর্ট কানেক্টিং রোড, বায়েজিদ বোস্তামী রোডসহ ৫১৭টি পিচ ঢালা সড়ক রয়েছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ইট বিছানো রাস্তা রয়েছে ৬৭৮টি। বেশ কিছু কাঁচা রাস্তাও রয়েছে। নগরীর মোড়গুলোর অধিকাংশেই রয়েছে ট্রাফিক সিগন্যাল। সিগন্যালে লাইটও রয়েছে। কিন্তু এ সিগন্যাল তেমন কাজে লাগে না। রাতদিন লাইট জ্বললেও গাড়ি চলে পুলিশের হাতের ইশারায়। আবার অনেক সময় পুলিশ না থাকলে চালকরা নিজেদের মতো করে ফাঁকফোকর বের করে মোড় পার হয়ে চলাচল করে। নগরীতে প্রতিদিন সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে (কোন কোন পয়েন্টে সাতটা) রাত সাড়ে এগারটা পর্যন্ত ট্রাফিক পুলিশ ডিউটি করে। কয়েকটি পয়েন্টে রাতেও ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসারা দেশে মুক্তি আন্দোলন আরও উত্তাল হয়ে ওঠে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রথম পাথরবিহীন রেলপথ, কাজ শেষ এক সপ্তাহের মধ্যে