লেখাপড়ার দৌঁড় তার ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত। সংসারের টানাপোড়েনের কারণে ৮/১০ বছর বয়সেই বহদ্দারহাট মাছের আড়তে কাজ নেয়। পিতা ইউসুফ আলী প্রকাশ বাম্পার ইউছুফ টেম্পু চালক ছিলেন। মাছের আড়ত থেকে টেম্পুর হেলপার হিসেবে পিতাকে সাহায্য করতে শুরু করে। সেই থেকে তার নামের আগে টেম্পু শব্দটি জুড়ে যায়। তখন থেকে আর কিছু থাক বা না থাক অসম্ভব সাহস ছিল তার। বন্ধুদের কেউ মার খেলে দ্রুত অন্য বন্ধুদের সংগঠিত করে সে ছুটে যেত প্রতিশোধ নিতে। প্রতিপক্ষ কে? তার প্রভাব প্রতিপত্তি কতটুকু– তা নিয়ে ভাবতো না কখনো। তার এই আগ্রাসী আচরণ দৃষ্টি কাড়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের। তাদের ছায়ায় বেড়ে উঠে ইসমাইল। ধীরে ধীরে হয়ে উঠে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ। সেই ইসমাইল ওরফে টেম্পু ইসমাইল অবশেষে ধরা পড়ে চান্দগাঁও থানা পুলিশের হাতে। গতকাল বুধবার রাতে এই রিপোর্ট লেখার সময় চান্দগাঁও থানার ওসি আতাউর রহমান খন্দকার আজাদীকে বলেন, টেম্পু ইসমাইল ধরা পড়েছে। তবে এখনো অভিযান টীম তাকে নিয়ে থানায় আসেনি। এলে বিস্তারিত জানাতে পারব।
প্রসঙ্গত: ইতঃপূর্বে পাঁচলাইশ থানায় গ্রেপ্তার হয়ে টেম্পু ইসমাইল আজাদীকে জানিয়েছিল তার নামের আগে টেম্পু শব্দ জুড়ে থাকার রহস্যসহ তার অপরাধ জীবনের নানা কিছু।
লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট পড়েই ছাত্রনেতা : টেম্পু ইসমাইল জানায়, ছোট থেকেই সে লুঙ্গি পড়ত। মাছের আড়তে কাজ করা কিংবা টেম্পুর হেলপারী করতে গিয়েও লুঙ্গি চিল তার প্রিয়। কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা মহিউদ্দিন ও এসরালের সাথে সম্পর্ক হওয়ার পর লুঙ্গিতে তারা আপত্তি জানায়। তারা জানায়, লুঙ্গি পড়ে মিছিল মিটিংয়ে গেলে ছাত্র মনে হয় না, কুলি মজুর মনে হয়। তাই তাকে প্যান্ট পড়তে হবে। লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট পড়া শুরু তখন থেকেই। পরে দেখেছে, আসলেই ঠিক। প্যান্ট পড়লে ছাত্রনেতা হিসেবে এলাকার ছেলেরাও বেশ সম্মান করে। পরে অপরাধ জগতেও দেখে লুঙ্গির চেয়ে প্যান্টের কদরই বেশি।
গুরু মহিউদ্দিনের সাথে ঝামেলা করে উত্থান : ইসমাইল জানায়, বহদ্দারহাট বাজারে বেশ কিছু দোকান থেকে চাঁদা আদায় করত মহিউদ্দিন নামে স্থানীয় এক নেতা। একবার টাকা দিতে না পারায় কয়েকজন দোকানদারকে মারধর করে মহিউদ্দিন। কিন্তু এতে ইসমাইল প্রতিবাদ জানায়। এতে রাস্তায় তাকে মারধর করে মহিউদ্দিন। পরে ঐ দিন সন্ধ্যায় অস্ত্রশস্ত্রসহ ৪/৫শ ছেলে নিয়ে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে শোডাউন দেয় মহিউদ্দিন। ব্যানারে তার নামের আগে প্রথম বারের মতো ‘ছাত্রনেতা’ যুক্ত করে। ঐ শোডাউনে বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, ২নং গেইট, বাংলাবাজার, শেরশাহ, পলিটেকনিক থেকে ছেলে আসে। ঐ শোডাউনেই ‘টেম্পু ইসমাইল’ নামটা ছড়িয়ে পড়ে।
মা’কে মুক্ত করতে প্রথম চাঁদাবাজি : ইসমাইল জানায়, ২০১২ সালে তার মা’কে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। মাকে জামিন করানোর জন্য টাকা পয়সার দরকার ছিল। সঙ্গীদের নিয়ে প্রথমবারের মতো স্থানীয় একটি নির্মাণাধীন ভবনের কাজ বন্ধ করে দেয় সে। এক লাখ টাকা দাবি করে। পঞ্চাশ হাজার টাকা পায়। সে বলে, ঝাটকি দিলেই টাকা আসায় লোভে পড়ে যাই। শুরু হয় চাঁদাবাজি। নির্মাণাধীন ভবন শুধু নয়, ফুটপাতের পান দোকানদার থেকে রেস্টুরেন্টের প্রত্যেকের থেকেই চাঁদা আদায় নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়।
যেভাবে দুর্ধর্ষ ছিনতাইকারী : টেম্পু ইসমাইলের প্রথম কাজ বিকাশের টাকা ছিনতাই। বেদী (সোর্স) মারফত খবর পায় যে বিকাশের এক এজেন্ট টাকা নিয়ে হাটহাজারী যাচ্ছে। টাকার পরিমাণ ৩৭ লাখ। পরে অবশ্য পাওয়া যায় ৫ লাখ ৭০ হাজার। এরপর থেকেই নগরীর প্রায় সর্বত্র মোটরসাইকেল নিয়ে ছিনতাই করে বেড়াত ইসমাইল ও তার সহযোগীরা। একমাত্র আগ্রাবাদ এলাকায় ছিনতাই করত না। কারণ সে জানায়, ওই এলাকাটা হামকা আলম গ্রুপের। এটা নিয়ম আছে যে, একজনের এলাকায় অন্যজন যাবে না। সে একবার ভুলে আগ্রাবাদ কাজের জন্য ঢুকে পড়েছিল। হামকা আলমের সহযোগী হাতকাটা জাহাঙ্গিরসহ অন্যরা তার মোটর সাইকেল কেড়ে রেখে দেয়। ওটা বাদ দিলে আলমাস সিনেমার সামনে, পলোগ্রাউন্ড, তিন পোলের মাথা, নতুন ব্রিজ এলাকা, সাগরিকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাইয়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার ঝুলিতে।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর নিজে কাজে যায় না : টেম্পু ইসমাইল জানায়, ২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল শমসের নগর রেললাইন এলাকায় পুলিশের সাথে তার গ্রুপের গোলাগুলি হয়। সে দুই পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ধরা পড়ে। এরপর থেকে ভালো ভাবে হাঁটতে পারে না। তাই সশরীরে কাজেও যায় না। তার অনুসারীরা কাজ করে তাকে একটা ভাগ দেয়। যেমন এক লাখ টাকার কাজ হলে সে পায় ৩৫ হাজার টাকা। বাকিটা কাজে অংশ নেওয়া সকলের মাঝে ভাগ করে দেয়।
টেম্পু নামটাই এখন ব্র্যান্ড : ইসমাইল নিজেই জানায় তার নামটা এখন পরিচিত হয়ে গেছে। সে ফোন করে নিজের পরিচয় দিলে মানুষ এমনকি অপরাধ জগতেও বিভিন্ন গ্রুপ ভয় পায়। বিনিময়ে ঐসব গ্রুপ তাকে টাকা দেয়। যেমন হামকা গ্রুপের শরীফ তাকে খুব মানে। সেও যতটুকু সম্ভব সাহায্য করে। ফলে মাঝে মধ্যেই ১০/২০ হাজার টাকা পাঠায়।
পঙ্গু হলেও ক্র্যাচ ব্যবহার করে না : ইসমাইল আক্ষেপ করে জানায় পুলিশের সাথে গোলাগুলিতে তার দুই পায়ে গুলি লাগে। এক পা মোটামুটি ভালো হলেও অন্য পা এখনো ভালো হয়নি। ক্র্যাচ ছাড়া হাঁটতে পারে না। তবু ক্র্যাচ ব্যবহার করে না সে। কারণ জানতে চাইলে সে জানায়, ক্র্যাচ ব্যবহার করলে সে যে পঙ্গু তা ধরা পড়ে যাবে। দলে কেউ আর মানবে না তাকে। এজন্য কষ্ট হলেও ক্র্যাচ ছাড়াই চলাফেরা করে নিজেকে অন্যদের কাছে স্বাভাবিক দেখায়।
পরিবারের সদস্যরাও অপরাধে জড়িত : ইসমাইলরা চার ভাই। প্রত্যেকেই ছিনতাইয়ের সাথে জড়িত। সে ছাড়া আরো দুই ভাই আইয়ুব ও ইদ্রিস ছিনতাই মামলায় জেলে আছে। ছোট ভাই সোহাগ বর্তমানে নগরী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। টেম্পু ইসমাইলের ভাই হিসেবে অপরাধ জগতে দ্রুত পরিচিতিও পেয়েছে। তার মা মাহফুজা বেগম ইসমাইলের নির্দেশে টাকা নিয়ে আসে।
পাঁচলাইশ ওসি (তদন্ত) ওয়ালী উদ্দিন আকবর আজাদীকে জানান, টেম্পু ইসমাইলের কাজ হচ্ছে ব্যবসায়ী–দোকানদারদের কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদা আদায় করা। বায়েজিদ ও চান্দগাঁও এলাকায় বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে তার মা মাহফুজা বেগমকে পাঠায়। মা গিয়ে সেলফোনে ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে টেম্পুর কথা বলিয়ে দেয়। টেম্পু টাকার পরিমাণ বললে ওই ব্যবসায়ী তার মায়ের হাতে টাকা তুলে দেন। ভয়ে তারা কখনও এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ করেন না।