কোন প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক উদ্বৃত্ত হয়ে গেলে মালিক শ্রম আইনের ২০ ধারা বলে শ্রমিক ছাঁটাই করতে পারে। কোন শ্রমিক শারীরিকভাবে কাজ করতে অক্ষম হলে শ্রম আইনের ২২ ধারা বলে মালিক শ্রমিককে ডিসচার্জ করতে পারে। কোন শ্রমিক প্রতিষ্ঠানের শৃংখলা ভঙ্গ করলে শ্রম আইনের ২৩ ধারা বলে মালিক তাকে বরখাস্ত বা অপসারণ করতে পারে। একজন শ্রমিককে চাকুরিচ্যুতি করার এতগুলি অপশন থাকা সত্ত্বেও মালিকের হাতে ২৬ ধারা তুলে দেয়া হল। এটি পাকিস্তান আমলে প্রণীত শিল্প সম্পর্ক অধ্যাদেশের ১৯(ক) ধারার অনুরূপ।
এই ধারা বলে একজন শ্রমিককে কোন কারণ ছাড়াই শুধুমাত্র “আপনার প্রয়োজন নাই” উল্লেখ করে যে কোন সময় চাকরি থেকে বের করে দেয়ার অধিকার মালিককে দেয়া হয়েছে। এ ধারাটি কেবল অমানবিক নয় বরং অনৈতিকও বটে। দুর্ভাগ্য এই ধারার বিরুদ্ধে আমাদের দেশে কোন তীব্র শ্রমিক আন্দোলন বা জনমত গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ফলে দেখা যাচ্ছে, ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে শ্রম আইনের বড় ধরনের সংশোধনীর পরেও এই ধারাটি শ্রম আইনে বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে। কিন্তু যতদিন এই ধারাটি শ্রম আইনে থাকবে ততদিন এই ধারা সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা রাখতে হবে। কেননা এই ধারার সুযোগ নিয়ে শ্রমিকদের চাকরি অবসান করা হলেও মালিক পক্ষ এই ধারায় বর্ণিত পাওনাদিও অনেক সময় দিতে চাই না। তাই শ্রমিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের এই ধারাটি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়। নিম্নে ধারাটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা হলোঃ
১) স্থায়ী শ্রমিকের চাকরির অবসানঃ
(ক)শ্রমিকের চাকরি যদি মাসিক মজুরি ভিত্তিক হয় তাহলে শ্রমিককে ১২০ দিন পূর্বে নোটিশ দিয়ে তার চাকরি অবসানের বিষয়টি জানাতে হবে। অথবা ১২০ দিনের মূল মজুরির সম পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে।
(খ) শ্রমিকের চাকরি মাসিক মজুরি ভিত্তিক না হলে, শ্রমিককে ৬০ দিন পূর্বে নোটিশ দিয়ে তার চাকরি অবসানের বিষয়টি জানাতে হবে। অথবা ৬০ দিনের মূল মজুরির সম পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে।
২) অস্থায়ী শ্রমিকের চাকরির অবসানঃ
(ক)শ্রমিকের চাকরি যদি মাসিক মজুরি ভিত্তিক হয় তাহলে শ্রমিককে ৩০ দিন পূর্বে নোটিশ দিয়ে তার চাকরি অবসানের বিষয়টি জানাতে হবে।
অথবা ৩০ দিনের মূল মজুরির সম পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে।
(খ) শ্রমিকের চাকরি মাসিক মজুরি ভিত্তিক না হলে, শ্রমিককে ১৪ দিন পূর্বে নোটিশ দিয়ে তার চাকরি অবসানের বিষয়টি জানাতে হবে। অথবা ১৪ দিনের মূল মজুরির সম পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে।
স্থায়ী শ্রমিকদের চাকরি অবসানের ক্ষেত্রে শ্রমিককে চাকরির ক্ষতিপূরন দিতে হয়। শ্রমিক প্রতি বছর চাকরির জন্য ৩০ দিনের মূল মজুরির সমপরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণ পাবে। শ্রমিক যদি ৩ বছর চাকরি করে থাকে তাহলে ক্ষতিপূরণ পাবে ৩০ দিনের মূল মজুরির সমপরিমাণ অর্থ। তবে ঐ প্রতিষ্ঠানে যদি গ্র্যাচুইটির প্রচলন থাকে এবং গ্র্যাচুইটির অর্থ যদি চাকরির ক্ষতিপূরণ থেকে বেশি হয় তাহলে শ্রমিককে চাকরির ক্ষতিপূরণের পরিবর্তে গ্র্যাচুইটি প্রদান করতে হবে।
উল্লেখ্য মূল মজুরির সাথে মহার্ঘ ভাতা এবং এডহক বা অন্তবর্তী মজুরি যদি তাকে তাও যোগ করতে হবে।
উপরোক্ত পাওনাদীর সাথে শ্রমিকের হিসাবে যদি অব্যায়িত অর্জিত ছুটি থাকে তাহলে উক্ত ছুটির টাকাও শ্রমিককে পরিশোধ করে দিতে হবে। অর্জিত ছুটির টাকা মোট মজুরির উপর হিসাব করতে হয়।
চাকরি অবসানের নোটিশে যদি কোন কারণ উল্লেখ করা হয় তাহলে উক্ত অবসান আদেশ বেআইনি হিসাবে বিবেচিত হবে। তাছাড়া শ্রম আইনের ৩৩(৯) ধারা অনুযায়ী অবসান আদেশটি সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন করার কারণে বা অন্য কোন কারণে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে দেওয়া হয়েছে বলে প্রমাণিত হয় তাহলেও উক্ত অবসান আদেশ বৈধ হবেনা। শ্রম আইনের ১৯৫(খ) অনুযায়ী কোন শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য বা কর্মকর্তা হওয়ার কারণে মালিক যদি তাকে চাকরিতে নিয়োজিত রাখতে অস্বীকার করেন তাহলে তা মালিকের অসৎ শ্রম আচরণ হিসাবে পরিগনিত হবে। শ্রম আইনের ২৯১ ধারা মোতাবেক কোন মালিক শ্রম আইনের ১৯৫ এর বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি ১ বৎসর পর্যন্ত কারাদন্ডে, অথবা ১০ হাজার পর্যন্ত অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। ২০০৬ সালে শ্রম আইন প্রণয়নের সময় ধারা ১৯৫ লঙ্ঘন করা হলে ২ বৎসর কারাদণ্ডের বিধান ছিল যা ২০১৮ সালে সংশোধনীর সময় কমিয়ে ১ বৎসর করা হয়েছে।
সমপ্রতি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, একটি স্বনামধন্য বহুজাতিক টেলি কমিনিকেশন কোম্পানীর শ্রমিকদের ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদককে শ্রম আইনের ২৬ ধারায় টার্মিনেশন করা হয়েছে। উক্ত ইউনিয়নটি ২০১২ সালে রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করে। কিন্তু রেজিট্রার অফ ট্রেড ইউনিয়ন্স রেজিষ্ট্রেশন দিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরবর্তীতে দীর্ঘ ৭ বছর আইনী লড়াই করে তারা ২০১৯ সালে আদালতের মাধ্যমে ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন পায়। দুঃখজনকভাবে রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার ১ বছরের মধ্যে ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদককে শ্রম আইনের ২৬ ধারার দোহাই দিয়ে টার্মিনেশন করা হয়।
উক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের এমন আচরণ ইউনিয়ন বিরোধী কার্যকলাপ হিসাবেই প্রতীয়মান হয়। এটা শ্রম আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
আমাদের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘগঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে। একইভাবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর কনভেশন ৮৭ এবং ৯৮ তে প্রত্যেক শ্রমিকের সংগঠন করা, সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা ও দরকষাকষির অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং ইউনিয়ন বিরোধী যে কোন কার্যকলাপ সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ এবং আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ এর সাথে সাংঘর্ষিক।
শিল্পের প্রধান দুই পক্ষ হচ্ছে মালিক এবং শ্রমিক। শিল্পে যেমন মালিকের বিনিয়োগ রয়েছে তেমনি শ্রমিকের শ্রম যুক্ত নাহলে মালিকের বিনিয়োগ অর্থহীন। সুতরাং শিল্প পরিচালনায় শ্রমিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার স্বার্থে শ্রমিককে মত প্রকাশ, দরকষাকষি ও সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা দিতে হবে।
শিল্পে মালিক এবং শ্রমিকের সমান এবং সম্মানজনক অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলে টেকসই শিল্প সম্পর্ক নিশ্চিত হবে। এতে মালিক শ্রমিক কেউ হারবে না কিন্তু শিল্পের উৎপাদনশীলতা বাড়বে। আর শিল্পের উৎপাদনশীলতা বাড়লে দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুদ হবে।
লেখক : সংগঠক, টিউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি