বাংলাদেশে এখন রাষ্ট্রহীন মানুষদের ভার বহন করে চলেছে। মূলত আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কারণেই বাংলাদেশে রাষ্ট্রহীন মানুষের সংখ্যাধিক্য। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার তার নাগরিক হিসেবে স্বীকার না করায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে তারা স্টেইটলেস (রাষ্ট্রহীন) হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরেছে। ২০২২ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রহীন মানুষ ছিল ৯ লাখ ৫২ হাজার ৩০ জন। ১৪ জুন ২০২৩ ইং তারিখ ইউএনএইচসিআর এ প্রকাশিত ‘২০২২ সালের বৈশ্বিক জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির প্রবণতা’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। ২০১৬ সালে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বড় অংশকে বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য করে মিয়ানমার সরকার।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী মিয়ানমারের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। যা বাংলাদেশের জন্য আসন্ন মহাসংকট হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞমহল। এতে বাংলাদেশের পরিবেশ জলবায়ু এবং স্থানীয় জনসাধারণের জীবনযাত্রা হুমকির মধ্যে রয়েছে।
সংঘাত, নিপীড়ন, বৈষম্য, সহিংসতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ ঘটনাগুলো ঘটছে। তাদের মতে, বিশ্বে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিত্বের ৯৬ শতাংশকেই আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশের মতো নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ার শংকা দেখা দিয়েছে।
হিউম্যানিটি মাদার হিসেবে খ্যাত বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, খাদ্য ও সার্বিক নিরাপত্তা দিয়ে রাষ্ট্রনায়কোচিত ও মানবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে এ বিষয়ে কোনো মিমাংসায় না পৌঁছানোর কারণে বাংলাদেশের জন্য এটি এখন বিপজ্জনক হিসেবে দেখা দিয়েছে। ‘মানবতার মা’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া শেখ হাসিনার বিষয়ে পশ্চিমা বিশ্ব নতুনভাবে যে ষড়যন্ত্রের জাল বিছানোর চেষ্টা করছে তা দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সফলতা এবং তৃতীয় বিশ্বে নিপিড়িত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে পরিচিতি পাওয়াটাই তাদের জন্য মাথা ব্যথার কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেনেভায় ‘ওয়ার্ল্ড অব ওয়ার্ক সামিট ২০২৩’ শীর্ষক শীর্ষ সম্মেলনে সামাজিক ন্যায় বিচারে বিনিয়োগ করতে বিশ্ববাসির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
১৪ জুন ২০২৩ সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় প্যালাইস ডি নেশনসে ‘ওয়ার্ল্ড অব ওয়ার্ক সামিট ২০২৩’ এর গ্যালারিতে বলেন, ‘সামাজিক ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে আমরা স্থায়ী শান্তি ও টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে পারি। বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি সেখানে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ প্রদান করেন। যা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
শেখ হাসিনা তাঁর পরামর্শে বলেন, ‘(১) কোয়ালিশনকে একটি আদর্শ নির্ধারণ বা আলোচনার ফোরামের পরিবর্তে একটি পরামর্শমূলক বা অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফরম হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। (২) বর্তমান ভূ–রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কোয়ালিশনকে সামাজিক ন্যায় বিচারে অস্ত্র প্রয়োগের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। (৩) কোয়ালিশনকে নিশ্চিত করা উচিত যে সুরক্ষাবাদী হাতিয়ার হিসেবে না করে একটি নিয়মভিত্তিক বহু পাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থার অধীনে সামাজিক ন্যায় বিচারকে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। (৪) কোয়ালিশনকে শালীন কাজ এবং উৎপাদনশীল কর্ম সংস্থানের জন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত করার লক্ষ্যে আইএলওর নিজস্ব উপাদানগুলোর কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন নিশ্চিত করতে হবে। (৫) জোটের উচিত যুব সমাজকে সামাজিক ন্যায় বিচারে চ্যাম্বিয়ন করার দিকে মনোযোগ দেয়া। বর্তমান শতাব্দীর বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের বিশ্বের জন্য একটি নতুন সামাজিক চুক্তি তৈরি করতে হবে। এই সামাজিক চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হবে সবার জন্য সামাজিক ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা।
১৫ জুন ২০১৩ জেনেভায় বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম কার্যালয়ে ‘স্মার্ট বাংলাদেশের নতুন অর্থনীতি এবং সমাজ’ শীর্ষক আলাপচারিতার এক প্রশ্নের জবাবে ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের হাতিয়ারগুলো যাতে মানবতাকে আঘাত বা অবজ্ঞা করার কাজে ব্যবহৃত না হয় তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমাদের সম্মিলিতভাবে সাইবার আক্রমণ, গুজব এবং অন্যান্য অপকর্মের বিরুদ্ধে সুরক্ষাকবচ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এটাও নিশ্চিত করতে হবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আমাদের সমাজে আর যেন বিভাজন সৃষ্টি না করে। এ উদ্দেশ্যে আমাদের বৈশ্বিকভাবে কার্যকর সরকারি–বেসরকারি অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, বাংলাদেশের ছেলে মেয়েরা শুধু চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ট্রেন্ডকে অনুসরণ করবে না, তারা নেতৃত্ব দেবে।
বর্তমান অস্থিতিশীল বিশ্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্রহীন মানুষগুলোর বাসস্থান, আশ্রয় ও ভরণপোষণে অর্থনীতি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাহাড়, জঙ্গল, জলাভূমির উজাড় হয়ে যাওয়ায় পরিবেশ মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বণ্যপ্রাণির আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের কারণে দেশে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, মাদক, চোরাচালান সহ নানাবিধ অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সোজা কথা সাধারণভাবে বলতে গেলে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা ও ডলার সংকটে জ্বালানি খাত হতে শুরু করে দেশের শিল্প বাণিজ্য এবং স্বাভাবিক চালচলনে প্রভাব পড়ছে প্রতিনিয়ত। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বর্তমানে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের ধারাবাহিক উন্নয়ন ঈঙ্গ মার্কিন জোটের নিকট চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছে। ঈঙ্গ মার্কিন জোট কোনো সময়ই বাংলাদেশের উন্নতিকে মেনে নিতে পারেনি। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে এদেশটিকে অংকুরেই বিনাশ করতে চেয়েছিল। ১৯৭৪ সালে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ তৈরি করে এদেশের মানুষকে ভুখা মারতে চেয়েছিল তারা।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট কালো রাত্রিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পিছনে তাদের কালো হাতের ষড়যন্ত্র ছিল। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে ১৯৭৪ সালে অনাহারে মারার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করে যেভাবে বাংলাদেশকে মিটিয়ে দিতে চেয়েছিল তারাই আবার বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করার জন্য একই কায়দায় নতুনভাবে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। কিন্তু ১৯৭১–১৯৭৫ এবং বর্তমানে ২০২৩ দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ এখন পরিপক্ষ। তারা সকল ষড়যন্ত্রকে জয় করে এগিয়ে যাওয়ার অনেক মনোবল ও সাহস সঞ্চয় করেছে। তারা সকল ষড়যন্ত্রকে জয় করতে পারে। ইতিমধ্যে জানা গেছে বাংলাদেশ অতি শীঘ্রই ব্রিকসের সদস্যপদ লাভ করতে পারে। দেশের জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করতে কাজ করছে সরকার। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অনেক ষড়যন্ত্র ও বাধা বিপত্তির মাঝেও অর্থনৈতিক সূচকগুলোতে বিস্ময়কর উন্নয়ন ঘটেছে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসহ অন্যান্য খাতে সাফল্যের পেছনে কয়েক দশকের জনসংখ্যার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বড় ভূমিকা রেখে চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগের হার বেড়েছে। এতে কার্যক্ষম মানুষের জন্য যেমন নতুন কর্ম ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে তেমনি অর্থনৈতিক খাতেও গতিশীলতা বেড়েছে।
বর্তমানে তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রযুক্তি, পুঁজি ও নিবিড় উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিল্পায়নের ফলে প্রতিবছর দেশে প্রায় ২১ লাখ তরুণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সারাদেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলমান। প্রতিবছর দেশে নতুন নতুন কল–কারখানা গড়ে উঠছে। তাতে বৃদ্ধি পাচ্ছে শ্রমশক্তির কর্মসংস্থান।
শিল্প কারখানা ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠানে কিছু সংখ্যক নৈরাস্যবাদি কর্মকর্তা কর্মচারিদের অদক্ষতা এবং দায়িত্ব পালনে অনীহা দেশের উন্নয়নে কিছু বিরূপ প্রভাব ফেললেও ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়ন সহ ২০৪১ সাল নাগাদ স্মার্ট উন্নত বাংলাদেশে পরিণত হওয়ার যে স্বপ্ন তা নির্ভর করছে যথাযথ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর।
সুতরাং বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে যাওয়ার যে ইতিহাস সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তার গতি সচল রাখতে দেশের ভিত্তি মজবুত করা খুবই প্রয়োজন। টেকসই উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা থাকা জরুরি। রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল রাখার জন্য আমাদের প্রত্যেককে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে এবং সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিক প্রক্রিয়াকে কোনো ষড়যন্ত্রের কাছে মাথা নত না করে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাই বলতে হয় সময় থাকতেই সাধু সাবধান।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদক–শিল্পশৈলী












