শিক্ষার্থীদের নিয়ে অভিভাবকগণের অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ হওয়া উচিত

মো. দিদারুল আলম | সোমবার , ৩ জুলাই, ২০২৩ at ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত প্রায় পরিবারে সন্তান জন্মের দিন মাবাবা তাদের সন্তানকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্ন দেখা শুরু করে। শিশুদের বড় হওয়ার সাথে সাথে অভিভাবকগণের স্বপ্নেরও পরিবর্তন হতে থাকে। জীবনের বাঁকে বাঁকে স্বপ্নের পরিবর্তন হয়। প্রথম দিনের স্বপ্ন যদি বাস্তব হতো তবে এদেশে পেশাজীবীর সংখ্যার দিক থেকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারের কাছাকাছি অন্য কোনো পেশাজীবী থাকতো না। অন্য পেশাজীবীদের হয়তো মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজে নিতে হতো। পেশার যে কত বৈচিত্র্য তা অনুধাবন করাও শুরু হয় অনেক সময় পার হওয়ার পরে। বর্তমানে আবার ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারদের মাঝে ছাত্র জীবনের কঠিন পাঠ শেষ করে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে অন্যান্য ক্যাডার সার্ভিসে যোগ দেওয়ার প্রবণতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্যারিয়ার, পেশা ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রাণপণ প্রচেষ্টার মাঝেই আমরা ভুলে যাচ্ছি সন্তানদের বড় কোনো পেশাজীবীতে পরিণত করার চেয়ে সত্যিকারের মানুষ বানানোর গুরুত্বের কথা।

বেসরকারি স্কুল ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়ে আমার একটি অভিজ্ঞতা শেয়ারের সুযোগ নিতে চাই। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সাভারে প্রায় ২১ টি ক্যাডার (প্রশাসন, পুলিশ, পররাষ্ট্র, আনসার, কর, নিরীক্ষা ও হিসাব, সড়ক ও জনপথ, তথ্য ইত্যাদি) সার্ভিসের ও জুডিশিয়াল সার্ভিসের অফিসারদের নিয়ে ৪ মাস মেয়াদী ৫৫তম বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সের একজন প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলাম। মোট প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা ছিল ২৪৭ জন। একদিন একটি উন্মুক্ত সেশনে স্পিকার ছিলেন তৎকালীন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শ্যামল কান্তি ঘোষ স্যার। প্রশিক্ষণার্থীরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নানা সমস্যা যেমননিয়মিত ক্লাস হয় না, স্কুলের অবকাঠামো ভালো নেই, ভালো শিক্ষকরা বদলি হয়ে যান, স্কুলের মাঠে গরুছাগল প্রবেশ করে, ক্লাসরুমে ফ্যান নেই ইত্যাদি স্যারের সম্মুখে তুলে ধরলেন। স্যার তখন সবকিছু বিনয়ের সাথে মেনে নিলেন। তারপর স্যার বললেন তোমাদের মধ্যে যারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাইরে পড়ালেখা করেছ তারা হাত উঠাও। হাত উঠানোর পর যা ঘটল তা দেখে আমি নিজেই হতবাক সে সংখ্যা মাত্র ১ জন। বাকি ২৪৬ জন কর্মকর্তা সরকারি প্রাথমিকে পড়ালেখা সম্পন্ন করা। স্যার এবার বললেন তোমরা যখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছ তখন এসব বিদ্যালয়ের অবস্থা হয়তো আরো খারাপ ছিল।

মাঠ প্রশাসনে কাজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপনে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এ প্রতিযোগিতাগুলোতে ১ম, ২য় ও ৩য় হওয়া নিয়ে কী যে প্রতিযোগিতা। সন্তানদের পজিশনে থাকতে না পারার কারণে কিছু কিছু অভিভাবকের প্রতিক্রিয়ায় কতবার যে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে আমাকে বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

চট্টগ্রাম শহরের জামাল খান রোড এলাকার একটি স্বনামধন্য স্কুলে আমার মেয়েকে পড়ানোর সুযোগ পেয়েছি। প্রতিদিন ভোর ৫.০০ টায় ঘুম হতে উঠেই আমাদের দুই সন্তান নিয়ে ব্যস্ততা শুরু। স্কুলের টিফিন প্রস্তুত করা, সকালের নাস্তা প্রস্তুত করা ও খাওয়ানো, ১ম জনকে সকাল ৭.০০ টার মধ্যে স্কুলে পৌঁছানো এরপর ২য় জনকে ৮.০০ টার মধ্যে পার্শ্ববর্তী স্কুলে পাঠানো। সকাল সকাল স্কুলে পাঠাতে ভালোই লাগে। ১ম জন ৩য় শ্রেণিতে এবং ২য় জন কেজি ওয়ানে পড়ে। কিন্তু মাঝে মধ্যে ১১.৩০ মিনিটে স্কুল থেকে আনতে গেলে যেন রীতিমত একটি যুদ্ধে যাওয়া। স্কুলের গেইটে প্রচণ্ড ভিড়। বাচ্চাকে আনতে গিয়ে কিছু সময়ের জন্য স্কুল গেইটের সামনে দাঁড়ালে স্কুলের পড়া, পরীক্ষার প্রস্তুতি, খাতার পড়া তুলতে না পারার নানা সিরিয়াস গল্পগুলো শুনতে পাওয়া যায়। প্রায় সময় অভিভাবকগণ বিশেষ করে মায়েরা স্কুল কর্তৃপক্ষের সমালোচনায় মুখর থাকেন। সম্পূর্ণ গেইটটি খুলে দিলে কী হতো, পুরো পড়া তুলতে সময় দেয় নি কেন, গেইটের সামনে ঢালাই করে দিলে কী হয়, স্কুল ব্যবসা শুরু করেছে কেন, দুটি পরীক্ষার মাঝখানে বন্ধ নেই কেন, রোদের মধ্যে এসেম্বলি না করালে কী হয়, স্কুলে এত বাচ্চা ভর্তি করানোর সমালোচনা ইত্যাদি। স্কুল গেইটে শিক্ষার্থী ও স্কুলের পড়ার বিষয় নিয়ে অভিভাবকগণের সকল আলাপ নিষিদ্ধ করা গেলে হয়তো অশুভ প্রতিযোগিতা কিছুটা কমতো। ৩য় শ্রেণির ১ম ক্লাস টেস্টে ৩ টি পরীক্ষায় আমার মেয়ে জ্বর ও বমির জন্য অংশ নিতে পারেনি। ১ম দিন অসুস্থতার মধ্যেও স্কুলে পাঠালাম, স্কুলে কয়েকবার বমি করার কারণে পরীক্ষা দিতে পারে নি। এ কারণে স্কুল গেইটে অন্য অভিভাবকগণের নিকট হতে কত কথা শুনতে হয়েছে। এমন একটি অবস্থা যেন আমার বাচ্চার কারণে তাদের বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে যাবে। আমি অবচেতন মনেই অসুস্থ প্রতিযোগিদের একজনে পরিণত হয়ে গেলাম। একইভাবে আমার মেয়ে ১ম সাময়িক পরীক্ষার সময়ও অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরিবেশ পরিচিতি পরীক্ষায় সে ৬৫ নম্বরের মতো উত্তর দিতে পেরেছিল। আমি রীতিমত টেনশনে পড়ে গেলাম সে পাস মার্কস পাবে কিনা? আবার স্কুল গেইটে শুনেছি এবারের রেজাল্ট হবে নাকি সবগুলো সাময়িক পরীক্ষার গড় নাম্বারের ভিত্তিতে। শেষ পর্যন্ত সে আমার টেনশনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পাস করেছিল।

আমার মেয়ে ২য় শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার এক বান্ধবীর সাথে অনেক দিন পর স্কুল গেইটে দেখা। কথা বলতে বলতে জানতে পারলাম তার মেয়েও ২য় শ্রেণিতে পড়ে। সে নিজ থেকেই বলল তার মেয়ে ১ম সাময়িক পরীক্ষায় ৬ষ্ঠ স্থান ও ২য় সাময়িক পরীক্ষায় ১ম স্থান অর্জন করেছে। আমিও প্রশংসা করলাম। এরপর আমার মেয়ের খবর জিজ্ঞেস করলেন আমি বললাম আমার মেয়ে ১ম সাময়িকে ২৮তম এবং ২য় সাময়িকে ১৮তম হয়েছে। তার পরবর্তী প্রশ্ন তোমার মেয়ের অবস্থান এত দূরে কেন? হয়তো তার প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক ছিল কারণ দুইজন ক্যাডার অফিসারের মেয়ের রেজাল্ট এত দূরে হবে কেন? আমি খুব কষ্ট পেয়েও উত্তর দিলাম তাকে আমি এত দূরে থাকতে বলেছি। আমি নিজে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোনো শ্রেণিতে ১ম স্থান অর্জন করতে পারিনি এরপরও প্রশাসন ক্যাডারে আমার ব্যাচের শুরুর দিকের একজন হিসেবে যোগদানের সুযোগ পেয়েছি। ক্যারিয়ারের এ পর্যন্ত আসতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোনো শ্রেণিতে ১ম স্থান অর্জন করতে না পারার কারণে কোনো সমস্যায় পড়তে হয় নি।

আমার ছেলেটি ক্লাস শুরু হওয়ার প্রথম দিকে খুব খুশি মনে নিয়মিত স্কুলে যেত। মাঝখানে দেখি স্কুলে যেতে প্রতিদিন কান্না করে। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর আমি ক্লাস টিচারের সাথে দেখা করে তার কান্নার বিষয়টি অবহিত করি। তিনি আমাকে বললেন আগে আমরা বাচ্চাদের খেলতে নিয়ে যেতাম, একটি দুর্ঘটনার পর খেলাধুলা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তিনি বললেন খেলাধুলা পুনরায় চালু করার ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করবেন। কিছুদিন পরে খেলাধুলা পুনরায় চালু করা হলো আবার হাসিমুখে আমার বাচ্চার স্কুলে যাওয়াও শুরু হলো।

বেসরকারি স্কুলগুলোতে সরকারি পাঠ্য বইসমূহের বাইরে একগাদা বই পড়ানো হচ্ছে। প্রতিদিন অনেক হোম ওয়ার্ক। বাসায় হাউস টিউটর। হাউস টিউটরের আবার হোম ওয়ার্ক। কয়দিন পরপর ক্লাস টেস্ট, সাময়িক পরীক্ষা আবার শুক্র ও শনিবারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এক্সট্রা কারিকুলামের পরীক্ষা নিয়ে তাদের ব্যস্ততা। বিনিময়ে পরীক্ষার সময় অসুস্থতা। প্রাথমিক স্তরের মৌলিক কিছু বিষয় ছাড়া ৩০ বছর পর তেমন কিছুতো আমাদের মনেও নেই, কাজেও লাগে না। প্রাথমিক স্তরের বেশির ভাগ অর্জন আসলে অভিভাবকগণের গল্পের খোরাক ছাড়া তেমন কী আর?

কিছু কিছু প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের গত বছর দেখেছি একটি স্কুলে ৩য় শ্রেণিতে পড়তে। এ বছর দেখছি তারা কোনো একটি সরকারি স্কুলের ৫ম শ্রেণিতে পড়ছে অর্থাৎ ৪র্থ শ্রেণিতে তার পড়া লাগেনি। সে শিক্ষার্থীদের আমরা অভিভাবকগণ কী শেখালাম? অভিভাবকগণের কিছু কিছু ফেসবুক গ্রুপে প্রবেশ করলে দেখা যায় কত বেশি প্রতিযোগিতা। গৃহিণীরা স্কুলের গেইট থেকে বাসায় ফিরে নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে গৃহকর্তার সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন।

শুক্রবার ও শনিবার এক্সট্রা কারিকুলাম নিয়ে অভিভাবকগণের দৌড়ঝাঁপ শিশু একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, নানা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সামনে। কোমলমতি এ বাচ্চাগুলোর উপর আমাদের অসুস্থ প্রতিযোগিতার ভার চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, নিজেরা যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছিলাম তখন কতটুকু চেষ্টা করেছি, কতটুকুই বা শিখেছি। ৩০ বছর পর আজ আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে প্রাথমিকের অভিভাবক। আজকে আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয় জীবনের অর্জিত জ্ঞানের কতটুকুই মনে করতে পারি। ১ ঘণ্টার চেষ্টায় হয়তো ২০৩০টি ইভেন্ট। তাহলে আমাদের সন্তানদের কেন ঠেলে দিচ্ছি অসুস্থ সব প্রতিযোগিতার মধ্যে। অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে জীবনকে উপভোগের সুযোগ হতে বঞ্চিত হচ্ছি সাথে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি এবং সন্তানদেরও মানসিক ক্ষতি সাধন করছি। যৌথ পরিবার থেকে বের হয়ে একক পরিবারের দিকে ঝুঁকছি। সন্তানকে সুসন্তান করার কথা ভুলে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার চেষ্টায় ডুবে যাচ্ছি। আসুন সন্তানদের মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ার চেষ্টা করি।

লেখক: নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা পরিষদ, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধটেকসই উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আবশ্যক
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম জেলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ ১৪ জুলাই শুরু