কক্সবাজারের টেকনাফে থামছে না অপহরণ বাণিজ্য। গত বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) ভোরে উপজেলার হ্নীলা পশ্চিম পানখালি পাহাড়ের পাশের সবজিক্ষেত থেকে পাঁচজনকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। এখনো তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। চলতি মাসের প্রথম থেকে শুক্রবার (২২ মার্চ) পর্যন্ত শিশুসহ ২০ জন অপরণের শিকার হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই মুক্তিপণে বাড়ি ফিরেছেন।
ভুক্তভোগীদের মতে, গত তিন বছরে দেড় শতাধিক মানুষ অপহরণকারীদের কবলে পড়ে। তাদের মধ্যে ছিল স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থী, কাঠুরিয়া, জেলে, কৃষক ও প্রবাসীও। অপহরণের পর দাবিকৃত মুক্তিপণ দিতে না পেরে খুন হয়েছেন পাঁচজন। দিনের পর দিন অপহরণ বাণিজ্য বেড়ে চলায় এ অঞ্চলের মানুষ অপহরণ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার টেকনাফে পরিবারের সবজিক্ষেত পাহারা দিতে গিয়ে এক কিশোরসহ পাঁচজন অপহরণের শিকার হন। তারা হলেন, টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম পানখালির মৃত সৈয়দ উল্লাহের ছেলে মো. শামীম (১৯), একই এলাকার ফকির মোহাম্মদের ছেলে মোহাম্মদ রফিক (১৯), শাহজাহানের ছেলে মোহাম্মদ জিহান (১৮), আব্দুর রহিমের ছেলে মোহাম্মদ নুর (২২) ও নুরুল আমিনের ছেলে আব্দুর রহিম (১৪)। অপহৃত শামীমের বড় ভাই সোনা মিয়া বলেন, পশ্চিম পানখালি পাহাড়ের পাশের জমিতে আলু, মরিচ, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি চাষ হয়েছে। শামীমসহ অপহৃত বাকি চারজন তাদের নিজ ক্ষেতে কাজ করতেন। গত বৃহস্পতিবার ভোরের দিকে তারা ক্ষেতে গেলে অপহরণকারীদের কবলে পড়েন। এ ঘটনার পর বৃহস্পতি থেকে শনিবার পর্যন্ত পাহাড়ের বিভিন্ন অংশে তাদের খোঁজ করেও পাওয়া যায়নি।
আগে অপহৃত হয়ে মুক্তিপণে ফেরত আসা টেকনাফের বাহারছড়ার বাসিন্দা ছৈয়দ আলম (৪০) বলেন, গত ৮ মার্চ জাহাজপুরার আলী আহমদসহ আমরা দুজন পানের বরজে কাজ করছিলাম। হঠাৎ ৮–১০ জনের অস্ত্রধারী দল আমাদের জিম্মি করে পাহাড়ের ভেতরে নিয়ে বেঁধে রাখে। পরে তাদের নির্যাতনে নিরূপায় হয়ে এক লাখ টাকা মুক্তিপণে অপহরণকারীদের কবল থেকে বেঁচে ফিরি।
হ্নীলার বাসিন্দা নুরজাহান। তিনি জানান, তার ছেলে সোয়াত বিন আব্দুল্লাহ (৬)। সে গত ৯ মার্চ মাদরাসা থেকে বাড়ি ফেরার পথে অপহরণকারীরা তাকে ধরে নিয়ে যায়।
হোয়াইক্যংয়ের বাসিন্দা মির কাসেম বলেন, ১০ মার্চ সকালে আমার দুই ছেলে নুর কবির ও জসিমসহ সাতজন উনচিপ্রাং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে পাহাড়ি বাগানে কাজ করতে যায়। সেখানে আরও পাঁচজন কাঠ সংগ্রহ ও গরু চড়াতে গেলে ১০–১৫ জনের সশস্ত্র দল অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদেরকে পাহাড়ের দিকে নিয়ে যায়। তারা জনপ্রতি দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরে অনেক দেন–দরবারে নগদের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা পৌঁছানোর পর রাতে তাদের ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা।
বাহারছড়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ফরিদ আলম জানান, গত ১২ ফেব্রুয়ারি সকালে মারিশবনিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র আব্দুল আলিম মায়ের সঙ্গে পানের বরজে কাজ করতে যায়। এসময় সন্ত্রাসীরা ৪–৫ রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে তাকে অপহরণ করে। এ ঘটনার পাঁচদিন পরে ৬০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে তাকে ফেরত আনে তার পরিবার। তিনি বলেন, এর আগে বাহারছড়ার অটোরিকশাচালক মাহমুদুল করিম ও হ্নীলার ইজিবাইক চালক মুহাম্মদ হোসেন মুক্তিপণের টাকা দিতে না পেরে খুন হয়েছিলেন। পরে শামলাপুর ঢালা থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনার পর কঙবাজারের ইউসুফ, জমির হোসেন ও ইমরান নামের তিন বন্ধু বাহারছড়া নোয়াখালী পাড়ায় বেড়াতে গেলে তারাও অপহরণের শিকার হন। পরে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিতে না পারায় তাদেরকেও হত্যা করে অপহরণকারীরা। এ পর্যন্ত বাহারছড়া থেকে ৭০–৮০ জনেরও বেশি অপহরণের কবলে পড়ে মুক্তিপণ দিয়ে প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন।
দিনের পর দিন অপহরণের ঘটনা বেড়েই চলছে। সাধারণ মানুষ এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে না। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে বিভিন্নভাবে হুমকি–দমকি দেওয়া হয় বলে উল্লেখ করেন এ ইউপি সদস্য।
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ নুর আহমেদ আনোয়ারী বলেন, গত কয়েক বছরে এ অঞ্চলের বিভিন্ন পেশার দেড় শতাধিক মানুষ অপহরণের শিকার হয়েছেন। তারা প্রত্যেকে মুক্তিপণের মাধ্যমে ছাড়া পেয়েছেন। দিনের পর দিন যেভাবে অপহরণের ঘটনার বাড়ছে এতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারীরা বাড়ি ফিরতেও ভয় পান।
হ্নীলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, বৃহস্পতিবার অপহৃত পাঁচজনকে শনিবারও উদ্ধার করা যায়নি। অপহরণকারীদের নিয়ন্ত্রণে সবার সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
এ বিষয়ে টেকনাফ মডেল থানার ওসি মুহাম্মদ ওসমান গণি বলেন, এরইমধ্যে অনেককে উদ্ধারসহ অপহরণকারী চক্রের অনেক সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাহাড়ি দুর্গম পথ হওয়ায় সহজে মুভ করাও কষ্টের। এরপরও অপহরণ চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা ও পুলিশ সদস্যরা মাঠে কাজ করছেন বলে জানান তিনি।