টুঙ্গিপাড়ার সেই ছেলেটি

রেজাউল করিম | বুধবার , ১৫ মার্চ, ২০২৩ at ১০:৩৮ পূর্বাহ্ণ

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশুদের ভালোবাসতেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।

শৈশব থেকেই তার বড় হৃদয় এবং ছোটবড় সবার জন্য দরদি মনের পরিচয় পাওয়া যায়। মানুষের প্রতি দরদী হওয়ার কারণেই নিপীড়িত বাঙালিকে তিনি অধিকার আদায়ে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছেন। পেরেছেন সচেতন করতে, সংগ্রামী করতে। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আইয়ুব খান জোর করেই দেশের ক্ষমতা দখল করে নেন। শেখ মুজিবসহ বহু নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে জেলে আটকে রাখেন। পাঁচ বছরের জন্য পুরো দেশে রাজনীতি বন্ধ করে দিলে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বমুহূর্তে শেখ মুজিবুর রহমান তরুণদের এক যুগান্তকারী নির্দেশ দিয়ে গেলেন। বললেন, ‘এই পাঁচ বছর তোমরা শিশু সংগঠন কচিকাঁচার মেলার মাধ্যমে কাজ করো। নিজেদের সচল রাখো।’

আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাইবেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটাতে চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই। আমি একজন মানুষ, আর আমার জন্মদিবস! দেখে হাসলাম। মাত্র ১৪ তারিখে রেণু ছেলেমেয়েদের নিয়ে দেখতে এসেছিল। আবার এত তাড়াতাড়ি দেখা করতে অনুমতি কি দেবে! মন বলছিল, যদি আমার ছেলেমেয়েরা ও রেণু আসত ভালই হত। ১৫ তারিখেও রেণু এসেছিল জেলগেটে মণির সাথে দেখা করতে।’ (কারাগারের রোজনামচা : পৃষ্ঠা২০৯)

শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬দফা ও পরবর্তীতে ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং বঙ্গবন্ধু উপাধি লাভ করেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জিত হলেও তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালি জাতির ওপর নানা নির্যাতন শুরু করে। বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। যা ইউনেস্কোর ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’এ অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। অন্যদিকে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে (২৬ মার্চ) তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালির কাঙ্ক্ষিত বিজয় ও স্বাধীনতা অর্জিত হয়।

শেখ মুজিবুর রহমান তদানীন্তন ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার (যিনি আদালতের হিসাব সংরক্ষণ করেন) ছিলেন এবং মায়ের নাম সায়েরা খাতুন।

মুজিবের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সালে মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। এ বছর স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন তদানীন্তন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং পরবর্তীতে বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং এমনকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী। তিনি স্কুলের ছাদ সংস্কারের দাবির উপর ভিত্তি করে একটি দল নিয়ে তাদের কাছে যান। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়াারি প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, যার মাধ্যমে তিনি এ প্রদেশের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন।

শেখ হাসিনা তার ‘আমাদের ছোট্ট রাসেল সোনা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘রাসেল আব্বাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করত। আব্বাকে মোটেই ছাড়তে চাইত না।’ শেখ হাসিনা আরো লিখেছেন, ‘রাসেলের সব থেকে আনন্দের দিন এলো যেদিন আব্বা ফিরে এলেন। এক মুহূর্ত যেন আব্বাকে কাছ ছাড়া করতে চাইত না। সব সময় আব্বার পাশে ঘুরে বেড়াত।’

১৯৭২ সালের শেষের দিকের কথা। একদিন সকালে বঙ্গবন্ধু হাঁটতে বেরিয়েছেন। সঙ্গে বড় ছেলে শেখ কামাল। হঠাৎ বঙ্গবন্ধু দেখলেন, একটি বাচ্চা ছেলে। তার কাঁধে বইয়ের ব্যাগ ঝোলানো। ছেলেটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। বঙ্গবন্ধু ছেলেটিকে কাছে ডাকলেন। জানতে চাইলেন কেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে? ছেলেটি জানাল তার পায়ে কী যেন ফুটছে, এজন্য ব্যথা করছে। বঙ্গবন্ধু ছেলেটির পায়ের জুতা খুলে দেখেন জুতার ভেতর লোহার সুচালো মাথা বের হয়ে আছে। যার খোঁচায় পা দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তখনই ছেলেটির চিকিৎসার জন্য তার দেহরক্ষী পুলিশকে নির্দেশ দিলেন। শিশুদের প্রতি তাঁর আলাদা দরদ ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি ধানমন্ডির বাসভবনে কতিপয় বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নিহত হন। ‘বাংলাদেশে জন্ম তোমার, বাংলাদেশ/ তোমার ঘর/ বাংলা তোমার তুমি বাংলার, তুমি/ বাংলার মুজিবর’। (‘বিশ্বজোড়া তোমার নাম’ : মহাদেব সাহা)। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা তাঁরই হাতে। তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজাতির পিতার জন্মদিন
পরবর্তী নিবন্ধমাইজভাণ্ডারে ‘লোকায়ত বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব