টিকেটের সঙ্গে মিল নেই এনআইডির, ৭১ যাত্রী গুণলেন জরিমানা

সুবর্ণ ও সোনার বাংলা ট্রেনে টাস্কফোর্সের অভিযান

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ৬ মার্চ, ২০২৩ at ৬:০৮ পূর্বাহ্ণ

টিকেট করেও ‘বিনে টিকেটের যাত্রী’ হিসেবে জরিমানা গুণেছেন সুবর্ণ এবং সোনার বাংলা ট্রেনের ৭১ জন যাত্রী। তাদের কাছ থেকে প্রায় ৬০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এরমধ্যে বেশ কয়েকজন বয়োবৃদ্ধ এবং সরকারের অবসরপ্রাপ্ত পদস্থ কর্মকর্তাও রয়েছেন। বিরতিহীন সুবর্ণ এক্সপ্রেস এবং

 

সোনার বাংলা এক্সপ্রেসকে মাঝপথে থামিয়ে ‘বিনে টিকেটের যাত্রী’ ধরার ব্যাপারটিতে ট্রেনের ভিতরে ব্যাপক হৈ চৈ বেধে যায়। বিষয়টি নিয়ে রেলে বেশ তোলপাড়েরও সৃষ্টি হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টদের দাবি অভিযান না চালালে রেলের সেবা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করার সরকারের গণমুখী উদ্যোগ ভেস্তে যাবে।

সরকারি সিদ্ধান্তেই অভিযান পরিচালিত হচ্ছে বলেও তারা দাবি করেন। অবশ্য, সাধারণ যাত্রীরা বিষয়টিকে রেলকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র বলেও মন্তব্য করেছেন। তারা বলেছেন, কালোবাজারি বা দুর্নীতি ঠেকানোর নানা পথ থাকলেও এই ‘তুঘলকি পদক্ষেপে’ রেলের আয়ে ধস দেখা দেবে।

সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ রেলের টিকেটিং সিস্টেমে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে। টিকেটের কালোবাজারি ঠেকাতে নেয়া হয়েছে বেশ কিছু উদ্যোগ। ‘টিকেট যার ভ্রমণ তার’ কর্মসূচির আওতায় যার টিকেট তার নামে করা, এনআইডির সাথে টিকেটের মিল থাকাসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সন্নিবেশিত করা হয়েছে।

‘টিকেট যার ভ্রমণ তার’ শীর্ষক এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে ছয়টি টাস্কফোর্স কাজ করছে। রেলের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, জিআরপি পুলিশ, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে গঠিত টাস্কফোর্স টিকেটের সাথে এনআইডির মিল থাকার বিষয়টি নিশ্চিত তথা যার টিকেট তিনিই যাতে ভ্রমণ

করেন তা নিশ্চিত করতে অভিযান পরিচালনা করছে। আর এতেই রেলের টিকেট বিক্রি কমে গেছে, বেড়ে গেছে মানুষের ভোগান্তি। এরই ধারাবাহিকতায় পকেটে টিকেট রেখেও এনআইডির সাথে মিল না থাকায় ‘বিনে টিকেটের যাত্রী’ হিসেবে জরিমানা গুণতে হয়েছে দুইটি ‘ভিআইপি’ ট্রেনের বেশ কিছু যাত্রীকে।

এদের মধ্যে কয়েকজন অসুস্থ বয়োবৃদ্ধ এবং সরকারের সচিব পর্যায়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও ছিলেন।

গতকাল সকালে বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মিজ ইতি ধরের নেতৃত্বে গঠিত টাস্কফোর্স ঢাকাগামী সুবর্ণ এঙপ্রেস ট্রেনে অভিযান পরিচালনা করে। ‘বিনে টিকেটের যাত্রী’ ধরার এই অভিযানে সুবর্ণ এঙপ্রেস ট্রেনের ৪৭ জন যাত্রীর কাছে থাকা টিকেটের সাথে এনআইডির মিল ছিল

না। তাদের প্রত্যেককেই ‘বিনে টিকেটের যাত্রী’ হিসেবে চিহ্নিত করে জরিমানা করা হয়। উক্ত ৪৭ জন যাত্রীর কাছ থেকে ৩৯ হাজার ৪২০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।

রেলের বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা ইতি ধরের নেতৃত্বে বিরতিহীন সুবর্ণ এঙপ্রেস ট্রেনকে লাকসামে থামিয়ে দেয়া হয়। ট্রেনটি চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা করার পর ঢাকা এয়ারপোর্টের আগে আর কোথাও থামার সিডিউল নেই। অথচ ট্রেনটিকে লাকসামে থামিয়ে অভিযান পরিচালনাকারী দল নেমে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে

যাত্রীদের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বিষয়টিকে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং প্রচলিত নিয়মের পরিপন্থি বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন একাধিক যাত্রী।

পরে টাস্কফোর্স সদস্যরা ঢাকা থেকে আসা বিরতিহীন সোনার বাংলা এঙপ্রেস ট্রেনকেও একইভাবে লাকসামে থামান। সিডিউল না থাকলেও সোনার বাংলা

এঙপ্রেস ট্রেন লাকসামে থামিয়ে টাস্কফোর্স টিম অভিযান পরিচালনা করে। এই ট্রেনেও ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসা ২৪ জন যাত্রীকে বিনে টিকেটের যাত্রী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এদের কাছে থাকা টিকেটের সাথে এনআইডির মিল না থাকায় অভিযানকারী দল উক্ত ২৪ জনের কাছ থেকে ১৮ হাজার ৯০০ টাকা জরিমানা আদায় করে।

বিরতিহীন ট্রেনকে মাঝপথে থামিয়ে অভিযান পরিচালনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন একাধিক যাত্রী। মোহাম্মদ আহসানুল ইসলাম নামের সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমি বয়স্ক মানুষ, অসুস্থ। আমার বড় ছেলে টিকেট করে দিয়েছে। ওই টিকেট নিয়ে আমি

চট্টগ্রামে আসছিলাম। পথিমধ্যে আমাকে জরিমানা করা হলো। আমার কাছে টিকেট থাকার পরও জোর করে জরিমানা পরিশোধ করতে বাধ্য করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ট্রেনে ব্যাপক হৈ চৈ হলেও অভিযানকারী দল কারো কোনও কথাতে পাত্তা দেয়নি বলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বিষয়টি খুবই

দুঃখজনক। দুর্নীতি রোধ বা টিকেটের কালোবাজারি ঠেকানোর আরো বহু পন্থা রয়েছে। এভাবে মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে এরা ঠিক কি করতে চাচ্ছে কে জানে! তিনি বলেন, একটি জনপ্রিয় সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে বহুমুখী চেষ্টা চলে। এটিও তার একটি অংশ কিনা ভেবে দেখতে হবে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত

থাকলে বছর শেষে ট্রেন কোটি কোটি টাকা গচ্ছা দেবে। যাত্রীরা বাধ্য হয়ে চড়াদামে টিকেট করে বাসে চড়বে। এটি বাস মালিকদের ব্যবসা দেয়ার পন্থাও হতে পারে বলে মন্তব্য করে সরকারের সচিব পর্যায়ের অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা। তিনি বিষয়গুলো নিয়ে আরো ভাবা দরকার বলেও মন্তব্য করেছেন।

বিষয়টি নিয়ে অভিযান পরিচালনাকারী বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মিজ ইতি ধরকে বারবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। ক্ষুদে বার্তা দেয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

তবে অপর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকার গণমুখী কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যার টিকেট তিনিই ট্রেনে ভ্রমণ করবেন। টিকেটের কালোবাজারি ঠেকানোর পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষ যাতে টিকেট কিনতে পারে সেজন্য সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছে। শুরুতে কিছু সমস্যা হয়তো হবে।

অভ্যাস হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, নতুন এই সংস্কারে ট্রেনের টিকেট নিয়ে আর কোনও চক্রের কোনও ধরনের দুর্নীতি করার সুযোগ থাকবে না। ট্রেন ধ্বংস বা বাস মালিকদের ব্যবসা দেয়ার অভিযোগ ‘ বাজে কথা’ বলেও মন্তব্য করেন।

গতকালের অভিযান প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজমুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি টাস্কফোর্সের অভিযানের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, টিকেট যার ভ্রমণ তার কর্মসূচি নিশ্চিত করতে অভিযানের কোনও বিকল্প নেই। একজনের টিকেট

নিয়ে অন্যজনের ভ্রমণ নতুন পদ্ধতির পরিপন্থি। তাই এনআইডির সাথে মিল না থাকায় কিছু যাত্রীকে জরিমানা করা হয়েছে। একই সাথে বিনে টিকেটেরও কয়েকজন যাত্রী ছিল বলেও তিনি দাবি করেন। পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন ট্রেনে অভিযান পরিচালনার জন্য ছয়টি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিহত ৬ জনেরই পরিচয় মিলেছে পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর
পরবর্তী নিবন্ধগ্রাহকের প্রকাশ্য ছুরিকাঘাতে এনজিও কর্মী খুন